ঢাকা, বুধবার   ২৭ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর সমর দর্শন ও প্রতিরক্ষা চিন্তা

মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.)

প্রকাশিত : ১২:৪৬ পিএম, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ রবিবার | আপডেট: ১২:৪৫ পিএম, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সোমবার

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃীত

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃীত

বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে ইতিমধ্যে শত শত নিবন্ধ, প্রবন্ধ ও বই প্রকাশিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে। মাত্র ৫৫ বছরের স্বল্পতম জীবনকালে একজন সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী থেকে একেবারে রাষ্ট্রনায়কে উন্নীত হওয়ার ঘটনা সমসাময়িক ইতিহাসে বিরল।

ইতিহাসে অনেক সফল রাজনৈতিক নেতা, সফল রাষ্ট্রপ্রধান ও রাষ্ট্রনায়কের উদাহরণ রয়েছে। তবে একজন রাষ্ট্রনায়কের যেসব বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি থাকে, তার সব দিকের পরিস্ফুটন ও বহিঃপ্রকাশ সাধারণত সবার ক্ষেত্রে দেখা যায় না এবং সে সুযোগ সবার জন্য আসেও না। বিশেষ করে সমর-দর্শনের দিকটা বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই থেকে যায় প্রায় সুপ্ত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আলেখ্য ছিল সাধারণের চেয়ে ভিন্ন। 

দীর্ঘ সংগ্রাম, তারপর সশস্ত্র যুদ্ধ ও যুদ্ধের ধবংসস্তূপ থেকে দেশকে গড়ে তোলার সব দর্শন ও প্রজ্ঞার পরিস্ফুটনই ঘটেছে বঙ্গবন্ধুর জীবনে। আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে যা কিছু সামরিক বা সমর ও যুদ্ধসম্পর্কীয় তার সব কিছু বুঝি শুধু সামরিক বা সেনানায়কদের কর্মক্ষেত্র (domain)। কিন্তু বাস্তবতা ও আধুনিক যুদ্ধের যে ইতিহাস তাতে দেখা যায়, একটি জাতির সমর দর্শন ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কতখানি সফল ও বিফল তা পূরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল সে দেশের রাষ্ট্রনায়কদের দূরদৃষ্টির ওপর। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যুদ্ধ হচ্ছে, More of Art than profession। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী গণযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এই রাষ্ট্রের স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম, তাঁর চিন্তাচেতনা, আদর্শ, দর্শন ও দিকনির্দেশনা একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের জন্য সমগ্র জাতিকে প্রস্তুত করেছে, যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে এবং সেই যুদ্ধে অভাবনীয় বিজয় অর্জিত হয়েছে। 

বঙ্গবন্ধুর সমগ্র কর্মজীবন ঘিরে আমরা যে সমর দর্শন ও প্রতিরক্ষা চিন্তার পরিচয় পাই তাকে প্রধানত তিনটি ধাপ বা স্তরে বিশ্লেষণ করা যায়। প্রথম ধাপটি একাত্তরপূর্ব, বিশেষ করে ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধোত্তর তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা। দ্বিতীয়ত, ৯ মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর সমর কৌশল, যেটির বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ভেতর। আর তৃতীয়টি, স্বাধীনতা-উত্তর সদ্য স্বাধীন একটি দেশের ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে বঙ্গবন্ধুর প্রতিরক্ষাবিষয়ক চিন্তাচেতনা ও তার প্রতিফলন। তিনটি পর্বের পৃথক আলোচনা নিচে তুলে ধরছি।

একাত্তরপূর্ব বঙ্গবন্ধুর সমর চিন্তা

এখন এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। ছয় দফার লক্ষ্য ও তা অর্জনের জন্য যে সংগ্রাম, সেটি বাঙালিকে ধাপে ধাপে নিয়ে যায় স্বাধীনতাযুদ্ধে। এই দফাগুলোর ষষ্ঠ দফায় পূর্ব পাকিস্তানে মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারি গঠনসহ পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ নিরাপত্তাকল্পে অন্যান্য বিষয়কেও তিনি সন্নিবেশিত করেন। যেমন- ১. আনসার বাহিনীকে ইউনিফর্মধারী সশস্ত্রবাহিনীতে রূপান্তর; ২. ইপিআর অর্থাৎ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (বর্তমান বিজিবির পূর্বরূপ) বাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অধীনস্থ করা; ৩. পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা স্থাপন করা এবং ৪. পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীর তিনটি শাখার ভেতর নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে রাখা।

এই দাবির প্রকাশ্য যুক্তি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করা। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত অন্য একটি দিক ছিল। কোনো এক সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে হলে বাঙালিদের দ্বারা গঠিত এসব প্যারামিলিটারি ফোর্স পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। যার প্রমাণ আমরা মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে দেখেছি। বাঙালি সেনা ইউনিটগুলো ইপিআর, আনসার, পুলিশ বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলেছিলেন।

এর থেকে বোঝা যায়, গত শতকের ষাটের দশকের শুরু থেকে বঙ্গবন্ধু যা কিছু করেছেন এর অন্তর্নিহিত চিন্তা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাংলাদেশের ভূবিন্যাস হচ্ছে নদীবহুল, জলাশয়পূর্ণ ও নিচু জমির সংমিশ্রণ। ষাটের দশকে এটা ছিল বর্তমান সময়ের চেয়ে আরো প্রকট। সামরিক বাহিনীর ভারী যান চলাচলের জন্য সড়কপথ ছিল অনুপযুক্ত। যার কারণে যেকোনো আক্রমণকারী বা দখলদার বাহিনীর জন্য সারা বাংলাদেশ হবে রীতিমতো বদ্ধভূমি। ফলে ইউনিফর্মধারী আনসার ও ইপিআর বাহিনীকে যদি যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রচলিত ও অপ্রচলিত যুদ্ধকৌশলের সংমিশ্রণে একটি নাতিদীর্ঘ প্রতিরোধ যুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রস্তুত করা যায় তাহলে পর্যায়ক্রমে তারা বিপুল জনগোষ্ঠীকে তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারবে।

তখন প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের সঙ্গে বাঙালি যুবকদের সম্পৃক্ততায় যে সম্মিলিত প্রতিরোধ শক্তির উদ্ভব হবে তাতে আক্রমণকারী বা দখলদার বাহিনী শহরকেন্দ্রিক ও বাংকারকেন্দ্রিক হয়ে পড়বে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে এসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই অবস্থা হয়েছিল।

আর এই যুদ্ধ পরিচালনার জন্য যে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দরকার হবে তা যেন পূর্ব পাকিস্তানেই তৈরি হয়, তার জন্য এ অঞ্চলে অস্ত্র কারখানা স্থাপনের দাবি ছিল ছয় দফার ভেতর।

মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় সামরিক দিকনির্দেশনা

বঙ্গবন্ধুর সার্বক্ষণিক বিশ্বস্ত ও নিবেদিত সহচর তাজউদ্দীন আহমদ অতি অল্প সময়ের মধ্যে যু্দ্ধকে যেভাবে সুসংগঠিত করেছিলেন ও যুদ্ধে দ্রুত জয়লাভের জন্য বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের যে সামরিক সহায়তা পেয়েছিলেন, তাতে এটা স্পষ্ট হয় যে এগুলো সবই ছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পূর্বপ্রস্তুতির ফল। তবে সেই নির্দেশনাগুলো কী, কখন ও কিভাবে ছিল, তা এখনো প্রকাশ্যে আসেনি। তাই আমার বিশ্লেষণটি সীমাবদ্ধ থাকবে শুধু ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে যে সামরিক নির্দেশনা ছিল তার ওপর। 

৭ মার্চের ভাষণের প্রায় শেষাংশে তাৎপর্যপূর্ণ সামরিক নির্দেশনা ছিল। যেমন- ১. 'প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রর মোকাবেলা করতে হবে; ২. জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু তোমরা বন্ধ করে দিবে; ৩. আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব; ৪. শক্র পিছনে ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে এবং ৫. প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। আমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন।'

বৃহৎ ও দীর্ঘমেয়াদি গেরিলা যুদ্ধের জন্য মাও জে দংয়ের খ্যাতনামা ম্যাক্সিম হলো, 'শক্র যখন ক্লান্ত হয়ে পিছু হটবে ও নিজেদের সংকোচিত করবে তখন তাকে ধাওয়া কর এবং আঘাত কর। আর শক্র যখন এগোবে তখন পথে অসংখ্য ছোট ছোট বাধা সৃষ্টি কর এবং নিজেরা চলে যাও নিরাপদ স্থানে।' ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা ও যার যা আছে তাই নিয়ে শক্রর মোকাবিলা করার নির্দেশ ছিল মাও জে দংয়ের উপরোক্ত সফল গেরিলা যুদ্ধের কৌশলের প্রতিফলন। 

আধুনিক কনভেনশনাল ও নন-কনভেনশনাল- উভয় ধরনের যুদ্ধেই Denial Plan কার্যকর করা যুদ্ধের একটি বড় গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই পরিকল্পনার মূল কথা হলো, নিজেদের কোনো সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধা শত্রু যেন ব্যবহার করতে না পারে। রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু বন্ধ করা এবং ভাতে মারব ও পানিতে মারব নির্দেশনার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সমর কৌশল Denial Plan বাস্তবায়ন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

ওপরে উল্লিখিত চতুর্থ নির্দেশনামার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু মূলত সমগ্র বাঙালি জাতি ও বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবেন তাঁদের সবার জন্য সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। যুদ্ধ চলাকালীন দেশের অভ্যন্তরে রাজাকার, আলবদর ও তাদের সহযোগী রাজনৈতিক দলের অনুসারীদের দ্বারা পঞ্চম বাহিনী (Fifth columnist) সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং তারা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের বাড়িঘর, ধনসম্পদ লুটতরাজে লিপ্ত হয়েছিল। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভেতর যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ছিল তা-ও এখন সবারই জানা।

পঞ্চম নির্দেশনার তাৎপর্য ছিল দেশব্যাপী যাতে বাঙালিরা সঠিক নেতৃত্বের অধীনে সুসংগঠিত হয় ও সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ২৬ মার্চের
পরপর বাঙালি সেনাসদস্যসহ অন্যান্য প্রশিক্ষিত বাহিনীর সদস্যরা একটা শক্ত প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস এসব প্রশিক্ষিত ইউনিটকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল বৃহত্তর গণবাহিনী বা মুক্তিফৌজ। একসময়ে সারা দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। আর সে কারণেই মাত্র ৯ মাসের মাথায় পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্য বাংলাদেশের মাটিতে অবনত মস্তকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

স্বাধীনতা-উত্তর প্রতিরক্ষা চিন্তা

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে দেশে ফেরত আসেন। তখন সম্পূর্ণ দেশটি ছিল একটি ভয়ানক ধ্বংসস্তূপ। সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯৭২ সালের মার্চ মাসেই ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাবর্তিত হয়। এ রকম উদাহরণ পৃথিবীতে বিরল। ১৯৭২ সালের প্রথম ভাগে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার ও দেশের নিরাপত্তা ছিল পরস্পরবিরোধী দুটি সিদ্ধান্ত। এ রকম একটি বহুমুখী সংকটের মুখে বঙ্গবন্ধু তাঁর বিরল নেতৃত্বের গুণাবলি, ভুবনমোহিনী ব্যক্তিত্ব, হিসাবি সাহস, প্রবল আত্মবিশ্বাস, গভীর দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞাপারমিতাপ্রসূত একটি মাত্র আন্তর্জাতিক সম্পর্কজনিত রাজনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে ওই সময় দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছিলেন। 

১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী স্বাক্ষর করেন ২৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী ও শান্তি চুক্তি। ওই চুক্তিতে মোট ১২টি অনুচ্ছেদ ছিল। তার মধ্যে নবম অনুচ্ছেদে ছিল, 'কোনো এক পক্ষের বিরুদ্ধে তৃতীয় পক্ষ সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হলে চুক্তিকারী প্রত্যেকে এতদুল্লিখিত তৃতীয় পক্ষকে যেকোনো ধরনের সাহায্যদানে বিরত থাকবে। তা ছাড়া যেকোনো পক্ষ আক্রান্ত হলে অথবা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে সেই আশঙ্কা নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে যথাযথ সক্রিয় ব্যবস্থা নিতে উভয় পক্ষ সঙ্গে সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হয়ে নিজেদের দেশের শক্তি এবং নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবে।' বলার অপেক্ষা রাখে না যে সে সময়ের বিরাজমান পরিস্থিতিতে ওই শান্তি চুক্তির উল্লিখিত অনুচ্ছেদই ওই দুর্বল মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যুহ হিসেবে কাজ করেছে। তখন আমাদের নিরাপত্তার প্রশ্নে চুক্তিটি ছিল একটা শক্তিশালী নিবারণ (Deterence)। 

পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু দেশ পুনর্গঠন ও পুনর্নির্মাণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকেও পুনর্গঠন করা শুরু করেছিলেন। সশস্ত্রবাহিনীকে বঙ্গবন্ধু যে একটি মর্যাদাবান বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, ওই সময়ের বিভিন্ন পদক্ষেপ থেকেই তা বোঝা যায়। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসের ৪ তারিখে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী গঠন করে। সেনাবাহিনীর মর্যাদার প্রতীক বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি বঙ্গবন্ধু উদ্বোধন করেন ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসের ৩ তারিখে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর মর্যাদা ও শক্তি বৃদ্ধির জন্য সেনাবাহিনীর জন্য ট্যাংক ও বিমানবাহিনীর জন্য তখনকার সময়ের অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান মিগ-২১ ক্রয় করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় প্রটোকলে তিনি সেনাবাহিনীকে সব বাহিনীর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন। 

১৯৭২ সালের ৬ অক্টোবর চোরাচালান রোধে জাতীয় রক্ষীবাহিনীসহ সব বাহিনীকে সেনাবাহিনীর অধীনে ন্যস্ত করেছিলেন। আপৎকালীন বা যুদ্ধের সময়ে সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধিকল্পে প্যারামিলিটারি হিসেবে জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন করেছিলেন। প্যারামিলিটারির উদাহরণ ভারত, পাকিস্তান, আমেরিকাসহ প্রায় সব দেশেই রয়েছে। শান্তিকালীন সময়ে যাদের কাজ থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, আর যুদ্ধের সময় তারা সেনাবাহিনীর অধীনে সংযুক্ত হয়ে সামগ্রিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে বহুগুণে শক্তিশালী করে তোলে। 

সেনাবাহিনী দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় যাতে অল্প সময়ে সক্ষমতা অর্জন করতে পারে সে জন্য বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা সব সেনা সদস্যকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনাসদস্যের সঙ্গে অঙ্গীভূত করে মাত্র দুই-আড়াই বছরের মাথায় সমগ্র সেনাবাহিনীকে ব্রিগেড গ্রুপ ফোর্সে বিন্যাস করে পুনর্গঠিত করেছিলেন। সব সেনানিবাসকে নতুন করে স্বাধীন দেশের চাহিদা মতো গড়ে তোলার কাজে হাত দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের মর্যাদাবান দেশের সঙ্গে মর্যাদাপূর্ণ দেশরক্ষা বাহিনী ছিল অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
sikder52@gmail.com