বীর আকবরের গল্প
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০১:৪২ পিএম, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ মঙ্গলবার
আকবর আলী। বিশ্ব দরবারে গর্বিত বীর। লাল-সবুজের মশাল হাতে দেশের মর্যাদা রক্ষায় অনন্য নেতৃত্ব দিয়ে জয় করেছেন ক্রিকেটকে। দরিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করা জীবনের শিক্ষাই তাকে আজ সম্মানের সূচকে শীর্ষে অবস্থান করার পথ দেখিয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে গেছেন মাঠে। বাংলাদেশকে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ শিরোপা জিতিয়েছেন এ নায়ক। তাকে নিয়ে গর্বিত বাংলাদেশ, কোটি বাঙালি।
১৮ বছরের এ টিনএজারকে এরই মধ্যে ক্রিকেটবিশ্ব ‘আকবর দ্য গ্রেট’ নামে আখ্যা দিয়েছে। তবে আজকের এ সাফল্য একদিনে আসেনি। পাহাড় চূড়ায় উঠতে তাকে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। এ জন্য করতে হয়েছে অসাধ্য সাধন। প্রতিনিয়ত দরিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে আকবরকে। তবুও দমে যাননি তিনি।
২০০২ সালের কথা। রংপুর মহানগরীর পশ্চিম জুম্মাপাড়া হনুমানতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আকবর। তার বাবা মোহাম্মদ মোস্তফা একজন ফার্নিচার ব্যবসায়ী। পরিবারে পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আকবর সবার ছোট। মাত্র ছয় বছর বয়সে পাড়ার গলিতে টেপ টেনিস বল আর ভাঙা ব্যাটে খেলা শুরু করেন আকবর। খেলতে খেলতে বড় ভাইয়ের পরামর্শে একাডেমিতে অনুশীলন শুরু করেন।
ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি আসক্ত ছিলেন তিনি। ক্রিকেটে ছেলের আসক্তি দেখে বাবা তাকে রংপুর জেলা স্কুল মাঠে অসীম মেমোরিয়াল ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করে দেন। একাডেমির কোচ অঞ্জন সরকারের হাত ধরে ক্রিকেটে তার হাতেখড়ি। সেখানে তিনি তিন বছরের অধিক সময় প্রশিক্ষণ নেন।
২০১২ সালে দেশের সেরা ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিকেএসপিতে ভর্তি হন আকবর। এর পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। শুধুই এগিয়ে গেছেন। প্রথমে খেলেন বিকেএসপির বয়সভিত্তিক দলে। সেখানে দারুণ পারফরম্যান্সের বদৌলতে সুযোগ পেয়ে যান জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৭ দলে। সঙ্গে নেতৃত্ব দেয়ার অভিজ্ঞতা বাড়তে থাকে তার।
শুধু ক্রিকেট নিয়েই পড়ে থাকেননি আকবর। পড়াশোনাটাও দুর্দান্তভাবে সামলেছেন তিনি। রংপুর বেগম রোকেয়া উচ্চবিদ্যালয়ের শিশু নিকেতন থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেন তিনি। পরে ভর্তি হন লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেখানে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় বিকেএসপিতে সুযোগ পান।
বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া ও খেলাধুলা একসঙ্গে চালান আকবর। ২০১৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পান তিনি। এইচএসসির রেজাল্টও মন্দ নয়। ২০১৮ সালে এতে জিপিএ-৪.৪২ পান ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিক। শুধু খেলাধুলা নয়, পড়ালেখায়ও চ্যাম্পিয়ন তিনি।
বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বজয়ের নায়ক আকবর আলীকে নিয়ে এতো আলোচনার কারণ একটি দুটি নয় অসংখ্য। আকবরের যোগ্য নেতৃত্বেই প্রথম বিশ্বকাপ জিতল বাংলাদেশ।
আকবরের বাড়ি রংপুর শহরের জুম্মাপাড়ায়। তিনটি কক্ষ বিশিষ্ট বাসা। যেখানে বাস করেন আকবরের মা, বাবা ও তিন ভাই। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আকবর সবার ছোট। বিশ্বকাপ চলাকালে গত ২২ জানুয়ারি যমজ বাচ্চা প্রসব করতে গিয়ে মারা যান একমাত্র বোন। আকবরের বাবা পেশায় ব্যবসায়ী, মা গৃহিণী।
বড় ভাই মুরাদ হোসেনকে দেখে ক্রিকেটার হওয়ার ইচ্ছে জাগে আকবরের। অঞ্জন সরকারের হাত ধরে রংপুর জিলা স্কুলের মাঠে হয় একাডেমিক ব্যাটে-বলে হাতেখড়ি। তত দিনে তার কানে পৌঁছে যায় নিজ জেলা ও বিকেএসপির ছাত্র জাতীয় দলের দুই ক্রিকেটার সোহরাওয়ার্দী শুভ ও নাসির হোসেনের নাম। ব্যস, মনের মধ্যে বাসা বেঁধে যায় বড় ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন। জেলা পর্যায়ে বাছাই পরীক্ষায় নাম লিখিয়ে বিকেএসপিতে ভর্তি হন ২০১২ সালে। এরপর শুধুই এগিয়ে চলা। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের আগে খেলেছেন অনূর্ধ্ব-১৭ দলেও। আছে বিকেএসপির বয়সভিত্তিক দলগুলোকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতাও।
একজন ভালো ক্রিকেটার হওয়ার জন্য আকবর অনেক পরিশ্রম করেছেন। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই ছুটতে হয়েছে খেলার মাঠে। হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে হোস্টেলে ফিরে সময়মতো খাবার খেয়েই ক্লাসে হাজিরা দিতেন। ২২ গজ সামলে পরীক্ষার হলও সামলেছেন দক্ষ হাতে।
৫ ফুট ১১ ইঞ্চি উচ্চতার এ ছেলেটি উইকেটরক্ষক। তার ব্যাটিং-সামর্থ্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। হোক না ছোটদের, তার হাত ধরেই যে বাংলাদেশ জিতেছে কোন বিশ্বকাপ। বাংলাদেশ যুব দলের অধিনায়ক আকবর আলি দেশকে বিশ্বকাপ পাইয়ে দিতে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে খেলেন ৭৭ বলে ৪৩ রানের ইনিংস।
প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ফাইনালে ৭৭ বলে ৪৩ রানের ইনিংস খেলা নিয়ে আকবর বলেন, ‘অতো বেশি চিন্তা করিনি। একদম সহজ পরিকল্পনা করেছি। যেহেতু অনেকগুলো উইকেট পড়ে গিয়েছিল কাজেই ঝুঁকি নেওয়ার সুযোগ ছিল না, সেইফ ক্রিকেট খেলতে হতো। আমাদের জন্য সুবিধা হয়েছে দ্রুত রান নেওয়ার কোন তাড়াও ছিল না, বল অনেক ছিল হাতে। সেদিক থেকে বলব যে শুধু উইকেট আঁকড়ে পড়ে থাকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।’
তার এমন অসাধারণ পারফরম্যান্সের পুরস্কার হিসেবে ফাইনাল সেরা হিসেবেই বেছে নিলেন বিচারকরা। যে দুর্দান্ত ইনিংস তিনি খেলেছেন, তাতে অন্য কাউকে সেরা হিসেবে বেছে নেয়াটাও ছিল অসম্ভব।
তিনি যে চাপ সামলাতে পারেন তা কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনেও প্রমাণ রেখেছেন। চাপা কষ্ট বুকে নিয়ে খেলে গেছেন এই টাইগার যুবা। গ্রুপ পর্বে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের দুই দিন আগে মাতৃতুল্য একমাত্র বোনকে হারিয়েছেন তিনি! বড় বোনের সঙ্গে আকবরের সম্পর্ক ছিলো মায়ের মতোই। ছোট ভাইয়ের কোনো আবদারই অপূর্ণ রাখেননি তিনি। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে বো্ন ছিলেন সবার বড়।
২৪ জানুয়ারি গ্রুপ পর্বে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের দুই দিন আগে জমজ সন্তান প্রসব করতে গিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান আকবরের বড় বোন। খবরটি আকবরের পারিবার তাকে দেননি। পারফরম্যান্সে প্রভাব পড়তে পারে এ ভয়েই দুঃসংবাদটি আকবরের কানে পৌঁছায়নি। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের পরেই আকবরকে জানানো হয়, তার বোনের মৃত্যুর সংবাদ। শোনার পর ভেঙে পড়েছিলেন যুবা অধিনায়ক। কিন্তু দলের অন্যান্য সদস্যরা তাকে মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখতে সাহায্য করেন।
পুরো দলের দাযিত্ব আকবরের ওপর। তাই তিনিও আর দল ছেড়ে আসেননি। তবে বড় বোন হারানোর কষ্ট কি ভোলা যায় আর! তারপরও ঠান্ডা মাথায় দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্বকাপের শিরোপা ঠিকই ঘরে তুলেছেন তরুণ এই ক্রিকেটার।
এভাবেই বাংলাদেশ একদিন সর্ব ক্ষেত্রে হয়ে উঠবে অনন্য। এভাবেই তরুণরা জয় করবে পৃথিবী।
এসএ/