ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

দিল্লিতে কেন এতো জনপ্রিয় কেজরিওয়াল?

মঈন বকুল

প্রকাশিত : ০১:১৭ পিএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ বুধবার | আপডেট: ০১:৩৩ পিএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ বুধবার

তিনি নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ কিংবা সোনিয়া গান্ধীর মতো বড় মাপের কোনো রাজনৈতিক নেতা নয়, নয় কোনো বহু বছরের রাজনৈতিক পুরাধা ব্যক্তি। তিনি একজন সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তার নাম অরবিন্দ কেজরিওয়াল। বর্তমানে তিনি হ্যাটট্রিক জয় নিয়ে আবারও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর হিসেবে মসনদে বসতে যাচ্ছেন। 

সম্প্রতি ভারতের ক্ষমতাসীন সরকার বিজেপি ধর্মীয় মেরুকরণ, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ), জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি), জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্টারের (এনপিআর) আইন নিয়ে টালমাটাল। যেভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে তাতে যে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা কঠিন নয়। মোদি অমিতের কঠোরতায় অনেকেই ধারণা করছিলেন, ভারত কি তাহলে হিন্দুবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে? যেখানে দিল্লিসহ গোটা ভারতবর্ষে কট্টর হিন্দুত্ববাদীর শাসন সেখানে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতো একজন সাধারণ রাজনীতিবিদের জয়জয়কার একটি বিস্ময়কর ব্যাপার। 

গুঞ্জন ছিল, এবারের লোকসভা নির্বাচনে মোদি-ঝড়ে দিল্লির আম আদমী পার্টি (আপ) ভেসে যাবে। ‘ধর্ম নাকি উন্নয়ন?’ কাকে বেছে নেবেন দিল্লিবাসী? অবশেষে জয় হলো উন্নয়নের। সব জল্পনা-কল্পনাকে উড়িয়ে দিয়ে কেজরিওয়ালের আম আদমী পার্টিতেই (আপ) ভরসা রাখলেন দিল্লিবাসী। ফলে টানা তৃতীয়বারের মতো দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর মসনদে বসতে যাচ্ছেন কেজরিওয়াল।

কেজরিওয়ালের হ্যাটট্রিক জয়

দিল্লির বিধানসভা নির্বাচন গত ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। মোট ভোট পড়ে ৬২ দশমিক ৫৯ শতাংশ। মঙ্গলবার সকালে ইভিএম খোলা শুরু হতেই দিকে দিকে আপের জয়জয়কার। ৭০টি আসনের মধ্যে ৬২টিতে জয় পেয়েছে আপ। বিজেপি পেয়েছে ৮টি আসন। ভরাডুবির মধ্যে বিজেপির কাছে একমাত্র সান্ত্বনা, গতবারের চেয়ে আসন বাড়ানো। এবার কোনো আসনই জিততে পারেনি কংগ্রেস। ২০১৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আপ পেয়েছিল ৬৭ এবং বিজেপি ৩।

জয়ের পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এক টুইটে অভিনন্দন জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী লেখেন, ‘দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভের জন্য আপ এবং কেজরিওয়ালকে অভিনন্দন। দিল্লিবাসীর আকাঙ্খা পূরণের জন্য তাদেরকে শুভেচ্ছা জানাই।’

পাল্টা জবাবে মোদীর উদ্দেশে টুইট করেন কেজরিওয়ালও। তিনি লেখেন, ‘ধন্যবাদ স্যর। রাজধানীকে বিশ্বমানের নগরে পরিণত করতে কেন্দ্রের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার জন্য অধীর অপেক্ষায় রইলাম।’

এরআগে প্রাথমিকভাবে জয় নিশ্চিত হওয়ার পরই কেজরিওয়াল বলেছিলেন, ‘কাজ দেখেই মানুষ ভোট দিয়েছেন। এ জয় মানুষের জয়। কাজে বিশ্বাস রেখে ভোট দিয়েছেন সবাই। নতুন রাজনৈতিক যুগের সূচনা করেছেন।’

দিল্লিবাসীকে ধন্যবাদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘তৃতীয়বার আম আদমি পার্টির উপর ভরসা রাখার জন্য দিল্লিবাসীকে ধন্যবাদ। যারা আমাকে নিজের ছেলে বলে মনে করেন, যারা আমাদের ভোট দিয়েছেন, আজকের এই জয় তাদের জয়।’

কেন এতো জনপ্রিয় কেজরিওয়াল

কেজরিওয়াল একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি মানুষের মনে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। দিল্লিতে এতো জনপ্রিয় হওয়ার বেশ কিছু কারণও উল্লেখ করা যায়। 

গত পাঁচ বছরে বহু উন্নয়নমুখী প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপরেই আস্থা রেখেছেন দিল্লিবাসী। ২০১৫ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কেজরিওয়াল, সেগুলোর সবকটি ধরে ধরে বাস্তবায়ন করে দেখানোর রাজনীতিতে তার বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়েছে। দিল্লিবাসীর জন্য ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিল মওকুফ, দিল্লির সরকার চালিত স্কুল, নারীদের জন্য সরকারি বাসে বিনামূল্যে সফর, বিনা পয়সায় প্রতিদিন ৭০০ লিটার পর্যন্ত পানি দেয়ার মতো প্রকল্প বাস্তবে করেছে দিল্লি সরকার। নতুন নতুন স্কুল তৈরি এবং পুরনো স্কুলগুলোকে আধুনিক রূপ দিয়েছে। কেজরিওয়ালের মহল্লা ক্লিনিকগুলো বিনামূল্যে চিকিৎসা তো বটেই ওষুধও দেয়। ভোটে-প্রচারেও এই উন্নয়ন মডেলকেই হাতিয়ার করেছিলেন কেজরিওয়াল।

এছাড়া বর্তমানে আম আদমি পার্টি তথা সাত সদস্যের মন্ত্রিসভায় ভারতের তরুণদের অন্তর্ভুক্তিই হয়েছে সবচেয়ে বেশি। অনেক তরুণ পেশা ত্যাগ করে ভারতের রাজনীতিতে স্থবিরতা, দুর্নীতি আর পরিবারতন্ত্র ভাঙতে কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। এটা ভারতের আগামীর রাজনীতির গতি পরিবর্তন করবে।

কেজরিওয়ালের প্রথম সরকারের স্থায়িত্ব স্বল্প সময়ের হলেও দিল্লির নিম্ন আয়ের মানুষকে সস্তায় বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ করা, ভিআইপি কালচারকে বাতিলকরণ ইত্যাদি এবারও কেজরিওয়ালের পক্ষে গেছে। এসব নিয়ে আম আদমি পার্টি দিল্লি ‘ডায়লগ’ও করেছে। এরই ফলে শুধু নিম্ন আয়েরই নয়, দিল্লির বিশাল মধ্যবিত্তদেরও কেজরিওয়ালের সপক্ষে টেনেছে।

আম আদমি পার্টির এমন বিজয়ের কারণগুলো ভারতের রাজনীতিতে কিছুটা হলেও নতুন মাত্রা জোগাবে। 

আম আদমি পার্টি

ভারতের আম আদমি পার্টি হল একটি ভারতীয় রাজনৈতিক দল। ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে এই দল প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১১ সালে জন লোকপাল বিল পাস করানো নিয়ে দুই বিশিষ্ট দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনকর্মী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও অন্না হজারের মধ্যে জনপ্রিয় ‘ইন্ডিয়া এগেইনস্ট করাপশন’ আন্দোলনের রাজনৈতিকীকরণ নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এই দলের জন্ম হয়। আন্না হাজারে উক্ত আন্দোলনটিকে রাজনৈতিক পথে পরিচালিত করার বিরোধী ছিলেন। অন্যদিকে কেজরিওয়াল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন চালানোর পক্ষপাতী ছিলেন।

আপের প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই দল বিভিন্ন প্রতিবাদ আন্দোলন কর্মসূচিতে অংশ নেয়। দিল্লিতে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধি নিয়ে সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলির মধ্যে বেআইনি আঁতাতের অভিযোগ এনে আপ আন্দোলন চালায়। এছাড়া যৌন হেনস্থা ও ধর্ষণের শিকার মহিলাদের সুবিচার দেওয়া ও শক্তিশালী ধর্ষণ-বিরোধী আইন প্রণয়ন ছিল এই দলের অন্যতম এজেন্ডা। 

২০১৩ সালে এই দল দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দিল্লি বিধানসভার ৭০টি আসনের মধ্যে আপ পায় ২৮টি আসন। একক সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থনে এই দল দিল্লিতে সরকার গঠন করেছে।

এছাড়া ২০১৫ সালের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে ৭০টি আসনের মধ্যে ৬৭টি আসন পেয়ে তাক লাগিয়ে দেন। বাকি তিনটি আসন পেয়েছিল বিজেপি। 

কে এই অরবিন্দ কেজরিওয়াল

জীবনি ভারতের রাজনীতিতে অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব অরবিন্দ কেজরিওয়াল। একজন সমাজকর্মী হিসাবেও তিনি জনপ্রিয়। হরিয়ানার এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম কেজরিওয়ালের। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র ছিলেন, প্রথমবার পরীক্ষা দিয়েই তিনি পশ্চিমবঙ্গের আইআইটি খড়গপুরে পড়ার সুযোগ পান, বিষয় হিসাবে বেছে নেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-কে। ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিগ্রি অর্জন করার পর টাটা স্টিলে চাকরি পান কেজরিওয়াল, তবে নিজের হৃদয়ের কথা শুনে সেই চাকরি ছেড়ে দেন এবং সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। কালীঘাটের আশ্রমে মাদার টেরিজার সঙ্গে দু'মাস কাজ করার সুযোগও পেয়েছিলেন তিনি। 

১৯৯৩ সালে তিনি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯৯৫ সালে কেজরিওয়াল বিয়ে করেন ১৯৯৩ সালে তাঁর আইআরএস-এর ব্যাচমেট সুনিতাকে। ১৯৯৯ সালে জাল রেশন কার্ড কেলেঙ্কারির পর্দা ফাঁস করতে তিনি পরিবর্তন নামে একটি আন্দোলন শুরু করেন, এই আন্দোলন তাঁকে সামাজিক পরিচিতি এনে দেয়। আয়কর, বিদ্যুৎ এবং খাদ্য রেশনের মত বিষয়ে দুর্নীতি রুখতে দিল্লিবাসীকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন কেজরিওয়াল। বেশি করে সামাজিক কাজে মনোনিবেশ করতে ২০০৬ সালে তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দেন এবং পাবলিক কস রিসার্চ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। 

২০১০ সালের প্রথমের দিকে জন লোকপাল বিল পাস করাতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন বিশিষ্ট সমাজকর্মী আন্না হাজারে। এই আন্দলনে যুক্ত হয়ে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছেছিলেন কেজরিওয়াল। তবে ইন্ডিয়া এগেইনস্ট করাপশন আন্দোলনের রাজনৈতিকীকরণ নিয়ে আন্না হাজারের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য দেখা দেয়। তিনি নিজের রাজনৈতিক দল আম আদমি পার্টি (আপ) প্রতিষ্ঠা করেন। 

২০১৩ সালে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৭০টি আসনের মধ্যে ২৮টি আসনে জেতে আপ। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের শর্ত সাপেক্ষ সমর্থনে সরকার গড়েন কেজরিওয়াল ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন। কিন্তু জন লোকপাল বিল আলোচনার টেবিলে রাখতে না পারার ব্যর্থতার কারণে মাত্র ৪৯ দিনের মাথায় পদত্যাগ করেন কেজরিওয়াল।দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি শাসন চলাকালীন ১৬তম লোকসভায় তিনি বারাণসী কেন্দ্র থেকে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীর বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, যদিও তিনি এই নির্বাচনে হেরে যান। 

২০১৫ সালে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে ফের তাঁর দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং ৭০টি আসনের মধ্যে ৬৭টিতে জিতে সরকার গঠন করে। দিল্লির সপ্তম মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ফের দায়িত্ব গ্রহণ করেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। কেজরিওয়াল রাজনীতিতে তাঁর নিজস্ব মতাদর্শ এবং জনসেবার জন্য বিশেষ পরিচিত এবং ভারতীয় রাজনীতির এক অন্যতম চরিত্র।