ঐতিহাসিক খন্দকের যুদ্ধ
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১০:২৩ এএম, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ রবিবার
ইসলামের ইতিহাসে যতগুলো যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে তার মধ্যে খন্দক বা পরিখার যুদ্ধ ছিল অন্যতম। আজকের এই দিনেই ঐতিহাসিক খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মূলত, ওহুদের যুদ্ধকে কেন্দ্র করেই এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসলাম পূর্বের চেয়ে আরো বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠে।
খন্দক শব্দের অর্থ পরিখা বা গর্ত। যেহেতু এ যুদ্ধে অনেকগুলো পরিখা খনন করা হয়, তাই এর নাম দেওয়া হয় খন্দকের যুদ্ধ। যা আহজাব নামেও পরিচিত। আহজাব অর্থ সম্মিলিত বাহিনী। যুদ্ধটি সংঘটিত হয় ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে। মক্কার কুরাইশ, মদিনার ইহুদি, বেদুইন, পৌত্তলিকেরা সম্মিলিতভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করেছিল এ যুদ্ধে।
এক বছরকালব্যাপী উপর্যুপরি সামরিক অভিযান এবং কর্মকান্ডের প্রেক্ষাপটে আরব উপদ্বীপে শান্তি ও স্বস্তির বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছিল এবং সর্বত্র সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তার পরিবেশ বিরাজমান ছিল। কিন্তু যে সকল ইহুদীকে নিজেদের দুষ্কর্ম ও চক্রান্তের কারণে নানা প্রকার অপমান ও লাঞ্ছনার আস্বাদ গ্রহণ করতে হয়েছিল তখনো তাদের চৈতন্যোদয় হয়নি। বিশ্বাসঘাতকতা, শত্রুতা, অঙ্গীকারভঙ্গ, ধোকাবাজি, আমানতের খেয়ানত ইত্যাদি নানাবিধ অপকর্মের অশুভ ফলাফল থেকে কোন শিক্ষাই তাদের হয়নি।
কাজেই, মদীনা থেকে বহিস্কৃত হয়ে খায়বার যাওয়ার পর মুসলিম ও মূর্তিপূজকদের মধ্যে যে সামরিক টানাপোড়েন চলছিল তার ফলাফল কী দাঁড়ায় তা প্রত্যক্ষ করার জন্য তারা অপেক্ষমান থাকে। কিন্তু যখন তারা প্রত্যক্ষ করল যে, পরিস্থিতি ক্রমেই মুসলিমগণের অনুকূলে যাচ্ছে এবং তাঁদের শাসন ক্ষমতা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে তখন তারা হিংসার আগুনে জ্বলেপুড়ে মরতে লাগল এবং নানা প্রকার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। শেষ বারের মতো মুসলিমগণকে এমন এক চরম আঘাত হানার জন্য তারা প্রস্তুতি শুরু করে দিল যাতে তাঁদের জীবন প্রদীপ চিরতরে নির্বাপিত হয়ে যায়।
এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলো মদিনা অবরোধ করে রাখে। জোট বাহিনীর সেনাসংখ্যা ছিল প্রায় ১০,০০০ এবং সেসঙ্গে তাদের ৬০০ ঘোড়া ও কিছু উট ছিল। অন্যদিকে মদিনার বাহিনীতে সেনাসংখ্যা ছিল ৩,০০০।
পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে মুহাম্মাদ (সা) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সঙ্গে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণকারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কুরাইজা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।
আরবীয় যুদ্ধকৌশলে পরিখা খনন প্রচলিত ছিল না তাই মুসলিমদের খননকৃত পরিখার কারণে জোটবাহিনী অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে। পরিখা পার হওয়ার কোনো ব্যবস্থা তাদের ছিল না। তারা অশ্বারোহীদের সহায়তায় বাধা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। দুই বাহিনী পরিখার দুই পাশে এসে সমবেত হয়। আক্রমণকারীরা পার হওয়ার জন্য দুর্বল স্থানের সন্ধান করছিল। দিনের পর দিন দুই বাহিনী পরস্পরকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে চলছিল।
এই অচলাবস্থায় কুরাইশ সেনারা অধৈর্য হয়ে পড়ে। আমর ইবনে আবদ উদ, ইকরিমা ইবনে আবি জাহল ও জারার বিন খাত্তাবসহ আক্রমণকারীদের একটি দল ঘোড়ায় চড়ে একটি সংকীর্ণ স্থান দিয়ে পরিখা পার হতে সক্ষম হন। এরপর আলি ও অন্য কয়েকজন সাহাবি সেখানে অবস্থান নিয়ে তাদের গতিরোধ করেন। আমর দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্য মুসলিমদেরকে আহ্বান জানালে আলি লড়াইয়ের জন্য এগিয়ে যান। দ্বন্দ্বযুদ্ধে আমর নিহত হওয়ার পর আতঙ্কিত হয়ে বাকিরা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
১০ হাজার লোকের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা মোটেই সহজ কাজ ছিল না। তার ওপর ছিল প্রচণ্ড শীত। এরই মধ্যে একদিন এমন প্রচণ্ড বেগে ঝড় বইল যে কাফেরদের সব ছাউনি উড়ে গেল। তাদের সৈন্যসামন্ত ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তাদের ওপর যেন আল্লাহর আজাব নেমে এল। আর বাস্তবিকই আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের জন্য রহমত এবং কাফেরদের জন্য আজাব হিসেবেই এ ঝড় পাঠিয়েছিলেন। কাফেররা এ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারল না। অবস্থা বেগতিক দেখে ইহুদিরা আগেই সরে পড়েছিল। কুরাইশদেরও ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না।
আহজাব যুদ্ধে ৮ জন মুসলিম শহীদ হন। অন্যদিকে, শত্রুপক্ষে ৪ জন মারা যায়। অবরোধের সময় কেউ বলেছেন ২৪ দিন, অন্য বর্ণনায় ১৫ দিন পাওয়া যায়। খন্দক যুদ্ধ সম্পর্কে আল্লাহপাক সুরা আহজাবে ৯ থেকে ২৭ পর্যন্ত ১৯টি আয়াত নাজিল করেন, যাতে এই যুদ্ধের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। খন্দক আমাদের এই শিক্ষা দেয়—ইমান ও ধৈর্যের সঙ্গে আল্লাহর ওপর আস্থা স্থাপন করলে আল্লাহর রহমত থেকে কেউ বঞ্চিত হয় না।
সূত্র : বিভিন্ন ইসলামী পুস্তক ও ইন্টারনেট