বাংলাভাষার প্রতি আমরা আন্তরিক ও যত্নশীল হবো কবে
মোহাম্মদ ইউসুফ
প্রকাশিত : ০৮:৪০ পিএম, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ রবিবার
লেখক সাংবাদিক মোহাম্মদ ইউসুফ
মানুষ ভাব বিনিময় করে ভাষার মাধ্যমে। হাসি-আনন্দ, দুঃখ-বেদনা মানুষ তার নিজ নিজ মাতৃভাষার মাধ্যমেই প্রকাশ করে থাকে। তৃপ্তি মিটিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করার একমাত্র মাধ্যম মাতৃভাষা। এ কারণে বিশ্বের সকল দেশেই প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় মাতৃভাষার মাধ্যমে। মাতৃভাষার ভেতর দিয়েই শিশুমনে স্বদেশপ্রেমের সূত্রপাত ঘটে।
আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। যুগে যুগে এ ভাষাকে পদানত করতে চেয়েছে বিদেশি শাসকেরা। বিশেষকরে পাক সরকার আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলাকে কেড়ে নিতে চেয়েছিলো। কিন্তু এদেশের ছাত্র-জনতা তা জীবনের বিনিময়ে রুখে দিয়েছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে অকাতরে জীবন বলি দিয়ে বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাভাষার মর্যাদা। একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত।
বাংলা বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ ভাষা। এ ভাষার গঠনপ্রণালী সম্পূর্ণ বিজ্ঞান ভিত্তিক। তাই বিদেশি ভাষার প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করে মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চা করা এবং সকল ক্ষেত্রে এর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনই হোক আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
মাতৃভাষার মাধ্যমে যে শিক্ষাসহ জীবনের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সম্ভব, তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত আধুনিক বিশ্বের চীন, জাপান, জার্মানী, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশ।
বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা। এ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির জন্যে সালাম-রফিকেরা পাক জান্তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে যেয়ে ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করেছেন। বাঙালির মাতৃভাষার প্রতি ত্যাগের স্বীকৃতি আজ বিশ্বজনীন। বাঙালিদের অনুসরণ করে এখন সারা বিশ্বের মানুষ মাতৃভাষা দিবস পালন করেন।
আমরা একুশ এলেই কেবল ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই; নানান অনুষ্ঠান মালার মাধ্যমে ভাষা দিবস উদযাপন করি। কিন্তু যে উদ্দেশে ভাষা শহীদেরা জীবন বলি দিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে- সেই চেতনা কী আমরা আদৌ মনেপ্রাণে ধারণ করি?
ভাষা আন্দোলনের ৬ দশক অতিক্রান্ত হলেও মাতৃভাষা বাংলাকে আমরা কতোটা মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি? আমরা কী পেরেছি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে? ভাষা দিবসের গুরুত্ব আমরা কতোটা অনুধাবন করি? ভাষা দিবস কী নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়নি?
বাংলাদেশের মানুষের মাতৃভাষা ও রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার ও প্রচলন হয়নি। অফিস-আদালত, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও উচ্চতর শিক্ষাব্যবস্থায় যথাযথভাবে বাংলাভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে না।
একুশে ফেব্রুয়ারি এখন কেবল আমরা বাঙালিরা পালন করি না, সমগ্র বিশ্বের মানুষ উদযাপন করে। একুশ এখন শুধু আমাদেরই নয়, পুরো বিশ্বের। ইউনেসকোর পর ২০০৮ সালের ৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘ এর সাধারণ অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে ২০০০ সাল থেকে সারা বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে। বাঙালি জাতির জন্যে এ এক বিরাট গৌরব। সারা বিশ্বের মানুষ জানতে পারছে বাংলাদেশ নামে একটি দেশের কথা, বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার কথা। আজ আমরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারি, আমরাই প্রথম জাতি, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে রক্ত দিয়েছি, অকাতরে জীবন দিয়েছি। মাতৃভাষার জন্যে রক্ত ও জীবন দেয়ার ইতিহাস বিশ্বে আর নেই।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে বাঙালির ভাষা সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ঘটনা বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় রূপান্তরিত হয়েছে। বিশ্ববাসী এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করে অনুভব করছে, মাতৃভাষা একটি দেশের জাতিসত্তার প্র্রধান বিবেচ্য বিষয়। আজ ভাষা দিবসে বিশ্বব্যাপী সকল ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে গুরুত্বের সাথে আলোচনা হয় বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের নাম।
বাংলাদেশ সরকার ২০০৮ সালে মাতৃভাষা দিবসের সঠিক ইতিহাস বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার জন্যে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তা কার্যকর হয়েছে বলে মনে হয় না। পদক্ষেপগুলো হচ্ছে- মাতৃভাষা চর্চা ও গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করা, বিশ্ব ভাষা মেলার আয়োজন করা এবং সিডি ও ভিডিও ক্যাসেট তৈরির পরিকল্পনা।
আমাদের মাতৃভাষাকে নিয়ে গবেষণা ও বিশ্বের সকল মাতৃভাষাকে রক্ষা করতে বাংলাদেশ সরকার একটি মাতৃভাষা চর্চা ও গবেষণাকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। সারা বিশ্বের ৫/৬ হাজার মাতৃভাষার কোনওটিই যেন হারিয়ে না যায়। এ কেন্দ্রে সেই ব্যবস্থা করা হবে। ব্যবস্থা থাকবে বিভিন্ন ভাষা শিক্ষার।
সে সময়ে মহান একুশে উপলক্ষে রমনা পার্ক কিংবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘বিশ্বভাষা মেলা’ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এ মেলায় থাকার কথা ছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বর্ণমালা, গ্রন্থাদি ও মহান সাহিত্যিকদের আলোকচিত্র প্রদর্শনী। থাকবে ভাষা বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান, প্রামাণ্যচিত্র, আবৃত্তি, সংগীত পরিবেশন ইত্যাদি। এছাড়া মেলায় থাকবে বাংলাদেশের একটি বড় স্টলসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্টল।
সরকারের অপর পদক্ষেপ ছিল- বাংলা ভাষার উৎপত্তি, বিবর্তন ও পরিচয় বর্ণনা করে তৈরি একটি সিডি ও ভিডিও ক্যাসেট সহসাই বিশ্বের ১৮৮টি দেশে পাঠানো। এছাড়াও জাতিসংঘের ৫টি ভাষা, যথা-ইংরেজি, ফারসি, জার্মান,স্প্যানিস ও আরবিতে সিডি ও ভিডিও ক্যাসেট তৈরির কথা ছিল।
সরকারের এ উদ্যোগটি আলোর মুখ দেখেনি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে- এটাই সচেতন মহলের প্রত্যাশা।
ভাষার মাস এলেই মায়ের ভাষা বাংলার প্রতি আমাদের দরদ বেড়ে যায়। সরকার ও জনগণ কেউ বাংলা ভাষাকে আন্তরিকভাবে পছন্দ করে বলে মনে হয় না। দেশের সর্বত্র গড়ে উঠছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। বাংলা মিডিয়াম স্কুলে আমাদের সরকারই চালু করেছে ইংলিশ ভার্সন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগে ও ইনস্টিটিউটে ইংরেজিতে পড়ানো ও পরীক্ষা নেয়া হয়।
বাংলা ব্যাকরণ জ্ঞান নেই দেশের বেশিরভাগ শিক্ষকের। বাংলা অক্ষরগুলোর সাথে তাদের সঠিক পরিচয় নেই। বাংলা ভাষায় প্রচলিত সংযুক্ত অক্ষরগুলো শিক্ষকেরা সঠিকভাবে চেনেন না। দেশের সিংহভাগ শিক্ষক যেখানে শুদ্ধকরে বাংলা লিখতে-পড়তে পারেন না, বাংলা ব্যাকরণের সাধারণ রীতিনীতি সম্পর্কে ধারণা নেই, সেখানে শিক্ষার্থীরা কী শিখছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলশ্রুতিতে সর্বত্র বাংলা বানান ভুলের ছড়া ছড়ি পরিলক্ষিত হয়।
শিক্ষাবোর্ডের পাঠ্যপুস্তকও থাকে নানান ভুলে ভরা। প্রধানশিক্ষকেরাও (প্রাথমিক, নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক) ‘প্রধানশিক্ষক’ শব্দটি ঠিক করে লিখতে পারেন না। প্রধানশিক্ষক শব্দটিকে ফাঁক করে লিখেন ‘প্রধান শিক্ষক’ হিসেবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে ‘উচ্চবিদ্যালয় ‘না লিখে লিখা হয় ‘উচ্চ বিদ্যালয়’।
আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে অবশ্যই আমাদের ইংরেজি জানতে হবে। তবে মাতৃভাষা হিসেবে বাংলাকে যে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া উচিত- তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উপলব্ধি করে এমন আলামত সুস্পষ্ট নয়। দাপ্তরিক ও বিচারিক কাজে বাংলাভাষার ব্যবহার কিছুটা বাড়লেও সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তৎপর নয়। ব্যাংক-বীমাসহ বিভিন্ন আর্থিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বাংলার চেয়ে ইংরেজির দাপট বেশি। ব্যাংকে হিসাব খোলার ফরম, বিদ্যুৎবিল, ওয়াসার পানির বিল সবই ইংরেজিতে রচিত। বাংলার চেয়ে ইংরেজিতে কথা বলতে সকলেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ ও গর্বানুভব করে।
ভাষার মাসকে ঘিরে প্রতিবছর ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্নস্থানে বইমেলার আয়োজন করা হয়। বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত প্রচুর নতুন বই মেলায় আগত পাঠক-দর্শনার্থীদের নজরে আসে। তবে একথা অনস্বীকার্য, দেশে অসংখ্য লেখক-সাহিত্যিক আছেন। তবে পাঠকবান্ধব মানসম্মত বই রচনা করেন এমন লেখকের সংখ্যা হাতেগোণা। তাই বইমেলায়ও মানসম্মত বই খুববেশি অগসর পাঠকদের চোখে পড়ে না। মেলায় হাজার হাজার নতুন গ্রন্থভাণ্ডারে নির্ভুল ও পাঠোপযোগী শিক্ষনীয় বই খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য।
পরিশেষে বলতে চাই, মায়ের ভাষা বাংলার প্রতি আমাদের শিক্ষামন্ত্রণালয়কে আরও যত্নশীল হতে হবে। দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয়সংখ্যক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাংলাশিক্ষক পদায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা, শিশুশিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলাশব্দের বানান- উচ্চারণ শিখে থাকে।
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে বাংলা বিষয়কে বাধ্যতামূলক করতে হবে। সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালুর ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড বাংলায় লিখতে হবে। প্রয়োজনে বাংলা-ইংরেজি দুটোই থাকবে। শুধু ফেব্রুয়ারি মাস নয়, সারা বছর মায়েরভাষা হিসেবে বাংলাকে মনঃপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে হবে এবং চর্চা করতে হবে। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এর কোনও বিকল্প নেই। অন্যথায়, ভাষা শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে না।
লেখক: প্রধান-সম্পাদক, সাপ্তাহিক চাটগাঁর বাণী ও চাটগাঁরবাণীডটকম
এনএস/