পথ চলতে!
আহমেদ মুশফিকা নাজনীন
প্রকাশিত : ১০:১৬ এএম, ৫ মার্চ ২০২০ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১১:২৯ এএম, ৫ মার্চ ২০২০ বৃহস্পতিবার
রিক্সায় যাচ্ছি। ফিরছি শিল্পকলা একাডেমি থেকে কাকরাইলে। হঠাৎ নিজে নিজেই একটা খেলা খেলতে ইচ্ছে করলো। তাকাতে শুরু করলাম আশেপাশের সব রিক্সার দিকে।
এক স্বামী-স্ত্রী যাচ্ছে। দেখলাম তাদের দুজনের মুখ দু’দিকে। দুজনই রাস্তার দু’দিকে মুখ ঘুরে তাকিয়ে আছে। দুজনের মুখই গম্ভীর। কেউ কারো চেহারা দেখছে না। যেন পরস্পরের চেহারা দেখা বারণ। আরেক রিক্সায় স্ত্রী সামনের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। বর ডানদিকে তাকিয়ে।
ক্রিং ক্রিং শব্দ করে চলে যাওয়ায় এক রিক্সায় দেখি পাথরের মতো মুখ শক্ত করে বসে আছে এক বর-বউ। কোলের বাচ্চাটা সেও নিশ্চুপ। মনে হলো কিছু আগে ঝগড়া হয়েছে হয়তো তুমুল। তারই রেশ চলছে। বাচ্চাটা বুঝে গেছে, এখন হাসা যাবে না, পরিস্থিতি খারাপ। অনুমান করলাম এতটুকু বাচ্চাও পরিবেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছে। মন খারাপ হলো শিশুটির জন্য। আহা নিষ্পাপ পবিত্র হাসিটা তার দেখা হলো না।
একটু কম বয়সী এক দম্পত্তি গেল রিক্সায়। ভাবলাম ওরা হয়তো হেসে হেসে যাবে। কিসের কী। হাসি নেই তাদের মুখেও। বাতাসে উড়ছে মেয়েটার লম্বা চুল। ছেলেটার চোখে ভারী চশমা। যেন তাতে সব দুঃখ লুকিয়ে আছে। এক মাঝ বয়সী দম্পত্তি গেল দ্রুত। দেখা হলো না তাদের সুখী অথবা দুঃখী মুখ।
পাশে এলো আরেক রিক্সা। স্বামী তাকিয়ে আছে পাশের রিক্সার এক মেয়ের দিকে। বউ মুখ ঘুরিয়ে আছে। মনে মনে বিরক্ত আমি। কি মিষ্টি বউটা তার। অথচ স্বামীর চোখ পাশের রিক্সার দিকে। ছেলেটার তাকানোতে পাশের রিক্সার মেয়েটা বিব্রত, কিছুটা মনে হয় বিরক্তও। তার বরের চোখ মোবাইলের দিকে।
আমার চোখ তখন চারিদিকে। রিক্সা গাড়ির হর্ণ ছাড়া আর যেন কোনো শব্দ নেই। উত্তেজনা শুরু হলো আমার মধ্যে। পাশ দিয়ে যত রিক্সা যাচ্ছে কোনো রিক্সায় হাসি দেখছি না কারো। বিশেষ করে দম্পতিরা কথা বলছে না কেউ। কেন? অবাক হচ্ছি আমি। হলো কী সবার।
ভাবতে লাগলাম আজ কি না হাসা দিবস। সবাই এত মনমরা হয়ে পথ চলছে কেন? আমাদের রিক্সাও চলছে। হুস করে পেছনের এক রিক্সা সামনে চলে এলো। কিছুটা কৌতূহলী হলাম। দেখি এক বয়স্ক দম্পতি। তাদের মুখগুলোও চিন্তায় ভরা। হাতে এক্সরে ফাইল। জ্যামে থামলো রিক্সা। এদিক ওদিক তাকাই। যতদূর চোখ যায় দেখি শুধু মানুষের থমথমে বিষণ্ণ মুখ।
এক রিক্সায় দেখি এক ছেলে মেয়ে সম্ভবত প্রেমিক-প্রেমিকা হবে। ঝগড়া করছে হাত পা নেড়ে নেড়ে। ছেলেটা খুব বোঝানোর চেষ্টা করছে। মেয়েটা কি যেন বলছে তাকে। আনন্দ হলো। যাক বাবা তাও তো একটু কথা পেলাম। করুক না ঝগড়া। প্রাণ তো আছে তাতে।
রিক্সা চলছে। এক বউকে দেখলাম দুচোখ ভরা জল। আমার সাথে চোখাচোখি হলো। মুখ ঘুরিয়ে নিলো চকিতে। আমার মনটা মোচড় দিয়ে উঠলো। রাগ হলো মেয়েটার বরের উপর। কী হয় বাবা, বউটার চোখের পানি একটু মুছে দিলে। বরটা ভাবলেশহীন। হয়তো ভাবছে এসব মেয়েলি নাকি কান্না। যত্ত সব ঢং!
একটু পর এক রিক্সা গেল। বয়স্ক রিক্সাওয়ালা। তিনটা ছেলে উঠেছে তাতে। তিনজনই মোবাইল দেখতে ব্যস্ত। মনে হলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা তিন বন্ধু যখন বাসায় ফিরতাম কত অর্থহীন কথা বলতাম। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তাম। এত শুকনা ছিলাম। রিক্সাওয়ালা মাঝে মাঝেই বলতো আপারা আছেন? সে কথা শুনে আবার উঠতো হাসির ঝড়। দৃশ্যটা মনে হতেই মনে মনে আমি একাই হাসলাম।
ঢাকা শহর যেন রিক্সার রাজধানী
ঢাকা শহরে আজকাল হাসি কমে যাচ্ছে নাকি? ভাবতে লাগলাম। এতো কেন যন্ত্রণাময় মানুষের মুখ। হালকা ঠান্ডা বাতাস বয়। যদিও তাতে ধুলোভরা, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তবুও শিরশিরে এ বাতাসে প্রিয়জনের সাথে বাদাম খেতে খেতে খুনসুটি করে না কেন মানুষ? পাথরমুখ করে মানুষ শুধু বয়ে যায় কী সর্ম্পকের জের? পাশে বসে থেকে কেন ধরে না সে প্রিয় মানুষের হাত? নগর জীবনে নানা ব্যস্ততা, মানসিক চাপ আর জটিলতায় নাগরিক মানুষ কি আজ দিশেহারা!
শিমুল তুলো বাতাসে উড়ে। পলাশ ফুল পড়ে থাকে পথের ধারে। দেখা হয় না তা পথিকের। সবুজ টিয়ে শুধু ঠোঁট রাঙায় রঙিন পলাশে। ছোট্ট টুনটুনি লাফিয়ে বেড়ায় এ ডাল ও ডালে।
বাসার কাছাকাছি এসে খেয়াল করলাম। সারাটা পথ অপি আর আমি একটা কথাও বলিনি। দুজনই চুপচাপ বসে ছিলাম রিক্সায়। মনে মনে এবার নিজেই কাষ্ঠ হাসি হাসলাম। পৃথিবী বড়ই রহস্যময়, অদ্ভুদ।