ঢাকা, বুধবার   ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪,   আশ্বিন ১০ ১৪৩১

স্বচ্ছ সমুদ্রে উঁকি দিচ্ছে বিশ্বমানের পর্যটন 

রিজাউল করিম

প্রকাশিত : ১০:২৫ পিএম, ৫ মার্চ ২০২০ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৭:৪৪ পিএম, ৬ মার্চ ২০২০ শুক্রবার

বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সাগরতীর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। পৃথিবী খ্যাত এ সৈকতে হাতছানি দিচ্ছে বিশ্বমানের সমৃদ্ধ এক পর্যটন। সাগরতীরকে দূষণ ও আবর্জনামুক্ত করে এ সম্ভাবনার স্বপ্ন বুনছে সমুদ্রবিষয়ক পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ আওয়ার সি। সংগঠনটি বলছে, নদীমাতৃক এই দেশে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত আমাদের জন্য প্রকৃতির অনন্য দান। আমরা যদি এ সৈকতকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে পারি। তবে আকৃষ্ট হবে দেশী-বিদেশি পর্যটক। গড়ে উঠবে বিশ্বমানের পর্যটন।

সংগঠনটির সঙ্গে একমত পোষণ করে কক্সবাজারকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছে সরকারি-বেসরকারি অন্যান্য সংগঠনগুলোও। যাদের মধ্যে রয়েছে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড (বিটিবি), মেরিন জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ক ও ব্রান্ড বাংলাদেশ এর মতো বেশ কয়েকটি সংগঠন।

সংগঠনগুলোর মতে, সাগরতীর পরিস্কার হলে স্বচ্ছ হবে সমুদ্রবক্ষের অজস্র জলরাশি। স্বাভাবিক থাকবে এর জীব-বৈচিত্র্য। ফলে কমে যাবে ঝড়-জলচ্ছাসের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়। আহরিত হবে মাছসহ মূল্যবান সমুদ্রসম্পদ। তখন সমুদ্রতীরের মনোরম পরিবেশ, ঝিরঝিরে বাতাস, স্বচ্ছ নীল জলরাশি ও মৎস্য আহরণ দেখতে ভীড় জমাবে কৌতুহলীরা। সমুদ্রতীরে বসে বা এর জলরাশিতে নিজেকে বিধৌত করে শরীর ও মন শীতল করতে বাড়বে তাদের আগমন। আর তাদের প্রয়োজনেই সমন্বিত প্রচেষ্টায় কক্সবাজার হয়ে ‍উঠবে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন শহর।  

প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এরইমধ্যে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবণী পয়েন্টে‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, সাগর রাখব পরিষ্কার’স্লোগানকে সামনে রেখে ‘ন্যাশনাল সি বিচ ক্লিনআপ-২০২০’ ক্যাম্পেইন অনুষ্ঠিত হয়। সেভ আওয়ার সি এবং বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এ ক্যাম্পেইনে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী, সমুদ্র ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবি সংগঠনের নেতারা।

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে কক্সবাজারকে আগামীর বিশ্বমানের সমৃদ্ধ এক পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ার সম্ভাবনা দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হয়ে সমুদ্র বিজয় করে এনেছেন। একইভাবে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা এ সংক্রান্ত মেরিন বিভাগ খোলা হয়েছে। এছাড়াও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করেছেন তিনি। আমি এই উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে বলবো, প্রধানমন্ত্রী আপনাদেরকে এই উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করে দিয়েছেন। এখানে আপনাদের কার্যক্রম পরিচালনায় কারা বাধা, সেটা দেখার বিষয় নয়, এক্ষেত্রে আপনাদের পরিকল্পিতভাবে এই সমুদ্র সৈকতটিকে কক্সবাজার পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

তিনি বলেন, আমরা চাই, আগামীকাল থেকে আপনারা এখানে কাজ শুরু করবেন। সমুদ্র উন্নয়নে করপোরেশনের সঙ্গে জড়িতদের যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে এমন কিছু করে দিয়ে যাবেন এলাকার জন্য, যেন এলাকার মানুষ স্মরণ করে যে, তাদের জন্য কিছু একটা করে দিয়ে গেছেন।

তিনি বলেন, সাংবাদিকদের যে সংগঠনটি আজকের এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে, আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে— একটা সচেতনতামূলক পরিস্থিতি তৈরি করা এবং যেসব কর্তৃপক্ষ আছে, তাদের যেসব গাফিলতি আছে, তা মানুষের সামনে তুলে ধরা। আমি বলবো, এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে সব ধরনের স্থাপনার উন্নয়নে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সারাদেশের সঙ্গে কক্সবাজারের যদি উন্নয়ন করা না যায়, তাহলে বাংলাদেশের উন্নয়ন পূর্ণ হবে না। এখানে যেসব সমুদ্রসম্পদ এবং পাহাড়িসম্পদ রয়েছে, এটা আমাদের কাজে লাগাতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আ আ ম স আরিফিন সিদ্দিক বলেন, সমুদ্র বিজয়কে অর্থবহ করতে সমুদ্রবিষয়ক গবেষকদের ভূমিকা রাখতে হবে। পাশাপাশি আমাদের সমুদ্র সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সাংবাদিক সংগঠন মেরিন জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ক বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

তিনি বলেন, ফ্লোরিডার মিয়ামি বিচ বিশ্বের অন্যতম একটি বিচ। সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকরা যাচ্ছে, সিনেমার শুটিং চলছে। হাজার হাজার পর্যটক সেখানে যাচ্ছে। অথচ সেই বিচ আমাদের কক্সবাজারের বিচের তুলনায় কিছুই নয়। শুধুমাত্র আমাদের সমুদ্র ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনাগত সমস্যার কারণে এটা হচ্ছে। এবার একটি সুযোগ এসেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের জাতির জনক মুজিবের জন্মশতবার্ষিকী আসছে। এটাকে সামনে রেখে আমাদেরকে নতুন করে চিন্তা করতে হবে। মুজিববর্ষের অঙ্গীকার নিয়ে কক্সবাজারকে সুন্দর ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে এসে সমুদ্রকে দেশের কল্যাণে, জনকল্যাণে কাজে লাগাতে হবে। সমুদ্রতীরে আন্তর্জাতিকমানের পর্যটন গড়ে তুলতে হবে।

বন অধিদফতরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক এসএম জহির উদ্দিন আকন বলেন, দেশের পর্যটন শিল্প কেবলমাত্র টিকে আছে প্রকৃতির ওপর ভর করে। তাই পর্যটন সম্ভাবনা ধরে রাখতে হলে আগে রক্ষা করতে হবে প্রাণ ও প্রকৃতি। বিশেষ করে সাগরে পর্যটন ও সমুদ্র অর্থনীতিতে এগিয়ে যেতে হলে সমুদ্রের ইকোসিস্টেম ধরে রাখতে হবে। সমুদ্রের প্রাণীদের তাদের পরিবেশে বাঁচতে দিতে হবে। আর সমুদ্রের পরিবেশ ঠিক রাখতে এর তীরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। যে কাজটি সেভ আওয়ার সি ও মেরিন জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ক শুরু করেছে। এটি খুবই প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগ।

পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক (প্ল্যানিং) সোলায়মান হায়দার বলেন, পরিবেশগতভাবে সেন্টমার্টিন ও কক্সবাজারের অবস্থা এখন খুবই খারাপ। পরিবেশ রক্ষায় কেউ নিজের দায়িত্ব পালন করেন না। হোটেল মালিকরা ও দোকানদাররা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ভালোভাবে করে না। কিন্তু ব্যবসা করবে অথচ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করবে না এটা কিভাবে হয়? এমনকি রেসপন্সিবল বিহেভিয়ার বিষয় পর্যটকরাও সচেতন না থাকায় পর্যটন কেন্দ্রগুলো চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে সমুদ্রতীরের এসব বর্জ অপসারণ করতে পারলে এখানে বিদেশী পর্যটকদের আগমন আরো বেড়ে যাবে। পর্যটন খাতে দেশের আয়ও বেড়ে যাবে।

কক্সবাজার জেলা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সচিব আবু জাফর রশিদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারকে শ্রেষ্ঠ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর সঙ্গে ২৪০ জন জনবল নিয়োগের অনুমতিও তিনি দিয়েছেন। বর্তমানে আমাদের প্রত্যক্ষ জনগণের সংখ্যা খুবই কম, অ্যাটাচমেন্ট জনবল দিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। খুব শিগগিরই আমাদের প্রত্যক্ষ জনবল নিয়োগ হবে এবং প্রধানমন্ত্রী যে উদ্দেশ্যে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার বাস্তবায়ন হবে।

‘সেভ আওয়ার সি’ এর পরিচালক আতিকুর রহমান বলেন, পর্যটকদের ফেলে রাখা বর্জ্য সমুদ্রে চলে যায়, এতে সমুদ্রের প্রাণীগুলোর সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটছে। এতে সমুদ্রের সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। তাই সমুদ্রের জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় আমাদেরকে সমুদ্রতীর ও এর পানি পরিস্কার ও স্বচ্ছ রাখতে হবে।

পর্যটন বিশেষজ্ঞ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোখলেছুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি বিচ বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশের সম্পদ। কোনো জায়গাকে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণার পর সে জায়গায় এককভাবে কোনো দেশের মালিকানায় থাকে না। ফলে এই বিচ যাতে কোনরকম ক্ষতি না হয়, সে বিষয়ে আমাদেরকে সচেতন হতে হবে।

সমুদ্র অর্থনীতি গবেষক ডক্টর দিলরুবা চৌধুরী বলেন, পৃথিবীতে ব্লু ইকোনমি থেকে অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে পাঁচ থেকে ছয় ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। পর্যটন থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আয় করছে আমেরিকা। আমাদের দেশেও ট্যুরিজমের সঙ্গে অনেক সেক্টর সম্পৃক্ত হয়েছে। ট্যুরিজম দিয়ে আমাদের জিডিপিতে কন্ট্রিবিউশন আরো বাড়াতে পারি। সেজন্য সমুদ্রতীরকে আবর্জনামুক্ত করতে হবে এবং পর্যটকদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

সেভ আওয়ার সি’র মহাসচিব গাজী আনোয়ারুল হক বলেন, সমুদ্রের বিপুল পরিমান সম্পদ আহরণ করে প্রতি বছর বাজেট পরিমান অর্থ সমুদ্র থেকেই আয় করা সম্ভব। তাই দেশের কাঙ্ক্ষীত উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে সমুদ্র ও এর জীব-বৈচিত্র বাঁচাতে হবে। বিশাল এ সমুদ্র ভান্ডারকে কাজে লাগাতে আমাদের দরকার একটি সমন্বিত পরিকল্পনা। পরিকল্পনা অনুযায়ী সমুদ্রতীরে গড়ে তুলতে হবে পরিবেশ সম্মত আন্তর্জাতি পর্যটন। তাতে সমুদ্র সম্পদ ও পর্যটন দ্বিমুখী আয় বাড়বে। দেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে যাবে।

মেরিন জার্নালিস্ট নেটওয়ার্কের সভাপতি মাহমুদ সোহেল বলেন, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পৃথিবী খ্যাত দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। অথচ আমরা এ সৈকতকে কাজে লাগাতে পারছি না। কারণ সৈকতটি আবর্জনাসহ অন্যান্য কারণে এখনও আন্তর্জাতিক মানের পর্যটনে গড়ে উঠেনি। তাই সবার আগের আমাদের এ সৈকতকে পরিস্কার রাখার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। লেখনীর মাধ্যমে সাংবাদিকরা জনগণের মাঝে সে সচেতনতা বাড়ানোর কাজটি করে যাবে।

ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের হেড অব নিউজ মামুন আব্দুল্লাহ বলেন, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত আছে আমাদের, সেটা কি আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। ২০ বছর আগে যে কক্সবাজারকে দেখেছি, সেই কক্সবাজারকে আর এখন পাই না।

অনুষ্ঠানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক তারিক সাঈদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের সমুদ্র নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখেন, আপনাদেরকেও এমন স্বপ্ন দেখতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখতে হবে।

স্থানীয় হোটেল ব্যবসায়ী কলাতলী মেরিনড্রাইভ হোটেল রিসোর্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুকিম খান বলেন, অন্যান্য শহরের তুলনায় কক্সবাজার অপরিচ্ছন্ন বেশি। এখানকার পৌরসভার গাফিলতি রয়েছে। আমরা ট্যাক্স দেই পৌরসভাকে। অথচ আমাদেরই লাখ লাখ টাকা খরচ করে বর্জ্য ফেলে দিয়ে আসতে হয়। এই দায়িত্ব ছিল মূলত পৌরসভার। তিনি বলেন, আগে কোনো নির্দেশনা না থাকায় বরাদ্দ পাওয়া প্লটের পুরোটাতেই স্থাপনা তৈরি হয়ে গেছে। তাই এখন কেন্দ্রীয়ভাবে বর্জ্য শোধনাগার বা এসটিপি করা উচিত। এটি করতে পারলে কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন গড়ার  প্রত্যয় আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে।

আরকে//