ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

৭ মার্চের ভাষণ: মুক্তিযুদ্ধের মহাকাব্য

 তোফায়েল আহমেদ

প্রকাশিত : ১০:৩৭ এএম, ৭ মার্চ ২০২০ শনিবার

রেসকোর্সে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি-সংগৃহীত

রেসকোর্সে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি-সংগৃহীত

৭ মার্চ বাঙালি জাতির ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিন। প্রতিবছর ৭ মার্চ সংগ্রামের নবতর চেতনায় আমাদের হৃদয় প্লাবিত করে। এবারের ৭ মার্চ ফিরে এসেছে জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ তথা ‘মুজিববর্ষ’ উদযাপনের পূর্বাহ্নে। এ বছর ৭ মার্চের রয়েছে বিশেষ আবেদন। স্মৃতির পাতায় অনেক কথা ভেসে ওঠে; সৌভাগ্যবান মানুষ আমি।

ইতিহাসের মহামানব, দুনিয়ার নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য লাভ করেছি। কেন যেন এবার আরও বেশি করে বঙ্গবন্ধুকে মনে পড়ছে। প্রতিটি দিন যখন যায়, স্মৃতির পাতায় বঙ্গবন্ধুর ছবি ভেসে ওঠে। কাছে থেকে দেখেছি, মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা। ছোট-বড় সবাইকেই তিনি সম্মানের চোখে দেখতেন। পৃথিবীতে কত নেতা এসেছেন, আসবেন; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো এমন বিশাল হৃদয়ের অধিকারী মানুষ দুর্লভ।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আমার মনে হয়, ১৯২০-এর ১৭ মার্চ, যেদিন তিনি জন্মগ্রহণ করেন; সেদিনই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের জন্মের সূচনা হয়। ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন হবে, সে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ’৪৭-এর ১৪ আগস্ট ‘পাকিস্তান’ নামক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হবে এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে অর্থাৎ ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের যুবকদের উদ্যোগে গঠিত গণতান্ত্রিক যুবলীগের কর্মী সম্মেলনে ভাষাবিষয়ক কিছু প্রস্তাব উত্থাপন করে সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বীজ রোপণ করবেন- এ কথা কি কেউ ভেবেছিল?

রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে সেদিন তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘বাংলাভাষাকে পূর্ববঙ্গের লিখার বাহন ও আইন-আদালতের ভাষা করা হোক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের ওপর ছেড়ে দেয়া হোক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করা হোক।’ (সূত্র- ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা, গাজীউল হক)। সেজন্যই আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটির সঙ্গে বাংলাদেশের জন্মও যুক্ত। এ দিনটির জন্যই বঙ্গবন্ধু জীবনভর সংগ্রাম করেছেন।

দীর্ঘ ১৩ বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি উপলব্ধি করেছেন, ‘এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদের হতে হবে।’ সেই লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যই এত আন্দোলন, এত সংগ্রাম; যার একটি চূড়ান্ত পর্যায় ১৯৭১-এর ৭ মার্চ।

ভাবতে আজ কত ভালো লাগে- ২০১৭-এর ৩০ অক্টোবর ইউনাইটেড নেশন এডুকেশন, সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন (ইউনেস্কো) ’৭১-এর ৭ মার্চে প্রদত্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের (ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ) অংশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে; যা সমগ্র জাতির জন্য গৌরবের এবং আনন্দের।

একাত্তরের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান যখন আকস্মিক এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চের অধিবেশন একতরফাভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি করল, সেদিন ঢাকার রাজপথে মানুষ নেমে এসেছিল। হোটেল পূর্বাণীতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক চলছিল। জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম।

জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের সমন্বয়ে এ পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ঠিক ওই সময়েই আকস্মিকভাবে ইয়াহিয়া খানের বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ ঘোষণায় হাজার হাজার মানুষ রাজপথে নেমে এসে হোটেল পূর্বাণীর চতুর্পার্শ্বে জমায়েত হয়। পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক থেকে বেরিয়ে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু ইংরেজিতে বলেছিলেন, ‘দিস টাইম নাথিং উইল গো আন-চ্যালেঞ্জ।’

অর্থাৎ এ সময়ে কোনো কিছুই বিনা প্রতিবাদে যেতে দেব না। তখন দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিল, ‘আপনি কি স্বাধীনতার কথা বলছেন?’ তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘নট ইয়েট।’ অর্থাৎ এখনই নয়। ইতিমধ্যে প্রিয় নেতার বক্তৃতা শুনতে পল্টন ময়দানে লাখো মানুষ সমবেত হয়েছে। মানুষ বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ধরল তার বক্তৃতা শোনার জন্য। তিনি বক্তৃতা না দিয়ে আমাদের পল্টন ময়দানে পাঠালেন। বিশেষ করে আমার নাম ধরে বললেন, ‘তোফায়েল যাবে, সেখানে আমার পক্ষ থেকে কথা বলবে।’

পল্টনে গিয়ে আমরা বক্তৃতা করেছি। পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে আমাদের আজকের এ স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়েছি এবং স্লোগান তুলেছি, ‘জাগো জাগো বাঙ্গালী জাগো’; ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’; ‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’; ‘পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা বাংলা’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’; ‘আমার নেতা তোমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব’। পল্টনে সমবেত সংগ্রামী জনতার উদ্দেশে বক্তৃতায় সেদিন বলেছিলাম, ‘আর ৬ দফা ও ১১ দফা নয়। এবার বাংলার মানুষ ১ দফার সংগ্রাম শুরু করবে। আর এ ১ দফা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আজ আমরাও শপথ নিলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ সুশৃঙ্খল সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’

বাংলাদেশের মানুষ তখন রাজপথে। বঙ্গবন্ধু সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী মার্চের ২ ও ৩ তারিখ দুপুর ২টা পর্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। বঙ্গবন্ধু ছাত্র নেতাদের ডেকে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের নির্দেশ দেন। নেতার নির্দেশে ছাত্রলীগ নেতারা সর্বজনাব নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আসম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন- ছাত্রলীগ ও ডাকসুর সমন্বয়ে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করেন।

৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’-এর জনসভায় ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ ‘স্বাধীন বাংলার ইশতেহার’ পাঠ করেন। ইশতেহারে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ‘সর্বাধিনায়ক’, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলার মানচিত্রখচিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।

তারপর এলো ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। ৭ মার্চ দিনটির সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফা, মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই, আমি এবং স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা এ সভা সংগঠিত করার জন্য সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করি। ৭ মার্চ সকাল থেকেই রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনস্রোত আসতে থাকে। তখন মানুষের মুখে মুখে স্বাধীনতা। আমরা ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর থেকে রওনা করি পৌনে ৩টায়। রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছাই সোয়া ৩টায়।

বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা আরম্ভ করেন সাড়ে ৩টায়। ১০ লক্ষাধিক লোকের গগনবিদারী স্লোগানে মুখরিত রেসকোর্স ময়দান। সেদিনের সভামঞ্চে জাতীয় চার নেতাসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দেয়ার জন্য দাঁড়ালেন; চারদিকে তাকালেন। মাউথপিসের সামনে পোডিয়ামের ওপর চশমাটি রাখলেন। হৃদয়ের গভীরতা থেকে যা তিনি বিশ্বাস করতেন, যার জন্য তিনি সারাটা জীবন সংগ্রাম করেছেন, ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছেন, সেই বিশ্বাসী আত্মা দিয়ে বাংলার মানুষকে তিনি ডাক দিলেন, ‘ভাইয়েরা আমার।’

তারপর একটানা ১৯ মিনিট ধরে বলে গেলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের অমর মহাকাব্য। বক্তৃতায় তিনি মূলত স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। বঙ্গবন্ধুর সামনে ছিল দুটি পথ। এক. স্বাধীনতা ঘোষণা করা; দুই. পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব না নিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত না হয়ে সুচিন্তিত বক্তব্য প্রদান করা। তিনি দুটোই করলেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন সেদিনের পরিস্থিতি। যেটি তিনি আমাদের বলেছিলেন। সেনাবাহিনী তখন প্রস্তুত। মাথার ওপর বোমারু বিমান এবং হেলিকপ্টার গানশিপ টহল দিচ্ছে।

যখনই বঙ্গবন্ধু এই ভাষায় বলবেন যে, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’, তখনই তারা গোলাবর্ষণ শুরু করবে। সেজন্য বঙ্গবন্ধু সবকিছু জেনেই বক্তৃতা করেছেন। এত বিচক্ষণ নেতা ছিলেন যে, সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে সামরিক শাসকের উদ্দেশে চারটি শর্ত আরোপ করলেন- মার্শাল ’ল প্রত্যাহার করো; সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নাও; এ কয়দিনে যেসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, তার বিচারবিভাগীয় তদন্ত করো এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করো।

এ চারটি শর্ত আরোপ করে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত হলেন না। পাকিস্তানিরা তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত করার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু তিনি ছিলেন সদাসতর্ক এবং সচেতন। অপরদিকে পুরো বক্তৃতাটিজুড়ে ছিল আসন্ন জনযুদ্ধের রণকৌশল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা।

সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ ‘আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।’ ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো।’

‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে’ তোলার আহ্বান জানিয়ে বললেন- ‘সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দফতরগুলো, ওয়াপদা কোনোকিছু চলবে না।’ নির্দেশ দিলেন- ‘আটাশ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন।’ সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে বললেন- ‘আমি যা বলি, তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে; খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো, কেউ দেবে না।’

গরিবের কথা খেয়াল রেখে বলেছেন, ‘গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে’ সেজন্য শিল্প, কল-কারখানার মালিকদের উদ্দেশে বলেছেন- ‘এই সাত দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছেন, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছায়া দিবেন।’ জীবনভর লালিত প্রগাঢ় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে বিরোধী রাজনীতিকদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’

আর রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, প্রত্যেক ইউনিয়নে, প্রত্যেক সাবডিভিশনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’ বক্তৃতা শেষ করেছেন মূলত স্বাধীনতা ঘোষণা করেই।

বজ কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতা সংগ্রাম।’ অর্থাৎ সামগ্রিকতায় জাতীয় মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার ভারসাম্যপূর্ণ বক্তৃতা।

সেদিনের সেই স্মৃতি মানসপটে ভেসে ওঠে; অভূতপূর্ব দৃশ্য- কল্পনা করা যায় না। এটিই মানুষ প্রত্যাশা করেছিল। একটা কথা আমার বারবার মনে হয়। একজন নেতা কত দূরদর্শী যে, তিনি সবসময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে জানতেন। কোন্ সময় কোন্ কথা বলতে হবে, এটা তার মতো ভালো জানতেন এমন অভিজ্ঞ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ এই ক্ষুদ্র জীবনে দেখিনি। আমি লক্ষ করেছি, বঙ্গবন্ধু জীবনে কখনও স্ববিরোধী বক্তব্য দেননি।

একটি বক্তব্য দিয়ে পরে সেই বক্তব্য অস্বীকার করা বা বক্তব্যের মধ্যে পরস্পরবিরোধিতা এটি তার কোনোদিন হয়নি; যা তিনি বিশ্বাস করেছেন, ভেবেছেন, মনে করেছেন যে এটিই বাস্তবসম্মত, সেটিই তিনি বলেছেন সুচিন্তিতভাবে। আর যা একবার বলেছেন, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও আপসহীনভাবে সেই কথা তিনি বাস্তবায়ন করেছেন। শ্রদ্ধেয়া বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে শুনেছি- ৬ তারিখ রাতে গায়ে জ্বর নিয়েও বঙ্গবন্ধু পায়চারী করেছেন এবং ভেবেছেন, কী বলবেন!

বঙ্গমাতা বলেছিলেন, ‘তোমার এত চিন্তার কারণ কী? সারা জীবন তুমি একটি লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছ, তোমার জীবনের যৌবন তুমি পাকিস্তানের কারাগারে কাটিয়েছ, ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছ। তুমি যা বিশ্বাস করো, সেই বিশ্বাস থেকেই আগামীকাল বক্তৃতা করবে।’ বঙ্গবন্ধু তার হৃদয়ে ধারণ করা গভীর বিশ্বাস থেকেই সেদিন বক্তৃতা করেছেন।

আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতা বিশ্লেষণ করি তবে দেখব- অলিখিত একটি বক্তৃতা। ভাষণের সময় ১৯ মিনিট। শব্দ সংখ্যা ১১৩৫। আব্রাহাম লিংকনের Gettysburg Address-এর শব্দ সংখ্যা ২৭২, সময় ৩ মিনিটের কম এবং লিখিত।

অপরদিকে, মার্টিন লুথার কিং-এর 'I have a dream' শীর্ষক লিখিত ভাষণটির সময় ১৭ মিনিট, শব্দ সংখ্যা ১৬৬৭। কিন্তু বিশ্বের কোনো নেতার ভাষণ এমন সংগ্রামমুখর ১০ লক্ষাধিক মুক্তিকামী নিরস্ত্র মানুষের সামনে হয়নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণটি প্রদান করে মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে, নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিলেন।

কী বিচক্ষণ একজন নেতা! আইএসআই ৭ মার্চ ঢাকা ক্লাবের সামনে ছিল। তারা অপেক্ষা করেছিল- যে ঘোষণাটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’ তারা মনে করেছিল; সেই কথাটি তিনি ৭ মার্চ বলবেন। আমি আগেই বলেছি, বঙ্গবন্ধু ছিলেন সতর্ক। তিনি সবই বলেছেন, কিন্তু শত্রুর ফাঁদে পা দেননি। উল্টো শত্রুকেই ফাঁদে ফেলেছেন; যার জন্য পরদিন আইএসআই রিপোর্ট করল ‘চতুর শেখ মুজিব চতুরতার সাথে বক্তৃতা করে গেল। একদিকে স্বাধীনতা ঘোষণা করল, আরেকদিকে ৪টি শর্ত আরোপ করে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত হল না এবং পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব নিল না।

আমাদের নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আমরা যে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলাম, সেটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল।’ এই ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। একটি বক্তৃতার মধ্য দিয়ে তিনি একটি গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন। একটি বক্তৃতার মধ্য দিয়ে তিনি নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র বাঙালি জাতিতে রূপান্তরিত করেছেন। এ একটি বক্তৃতার মধ্য দিয়ে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে তিনি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে এক মোহনায় দাঁড় করিয়েছেন।

৭ মার্চের বক্তৃতার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী ন’মাস জনযুদ্ধ ও গেরিলাযুদ্ধের পথ অনুসরণ করে ত্রিশ লক্ষাধিক প্রাণের আত্মত্যাগ আর চার লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা মহত্তর বিজয় অর্জন করেছি। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ আমাদের জাতীয় চেতনার ভিত্তি হয়ে আজ পবিত্র সংবিধানের অংশ। এ বক্তৃতাই ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের চলার পথের প্রেরণা।

বঙ্গবন্ধু কখনই আক্রমণকারী হতে চাননি, চেয়েছিলেন আক্রান্ত হতে। সেজন্যই ২৫ মার্চের শেষ রাতে এবং ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে যখন অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করে, ঠিক তার পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার শেষ বার্তায় স্বাধীনতা ঘোষণা করে বলেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’

তোফায়েল আহমেদ : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি

tofailahmed69@gmail.com