ঢাকা, শনিবার   ০৫ অক্টোবর ২০২৪,   আশ্বিন ১৯ ১৪৩১

১৯ মিনিটের সেই কালজয়ী ভাষণ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৩:০৭ পিএম, ৭ মার্চ ২০২০ শনিবার | আপডেট: ০৩:০৯ পিএম, ৭ মার্চ ২০২০ শনিবার

মার্চ এলেই ফিরে যেতে হয় সেই ১৯৭১ সালে। মার্চের ২ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ পল্টনে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের সভা, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক, ২৫ মার্চ পাকিস্তাদের নির্বিচারে গণহত্যা, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা।

স্লোগানে স্লোগানে উত্তপ্ত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। বঙ্গবন্ধু আগেই ঘোষণা করেছিলেন, ৭ মার্চ রোববার রেসকোর্স ময়দানে তিনি পরবর্তী কর্মপন্থা ঘোষণা করবেন। ৪ থেকে ৬ মার্চ সকাল ৬টা থেকে ২টা পর্যন্ত সারা দেশে হরতাল পালনের আহ্বান জানালেন বঙ্গবন্ধু। তার নেতৃত্বে দুর্বার গতিতে আন্দোলন এগিয়ে চললো। দেশের শতকরা ৯৮ জন মানুষের ভোটে নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সামরিক শাসন চালু থাকলেও সামরিক সরকারের কথা তখন কেউ শুনছে না। শেখ মুজিবের কথাই যেন তখন আইন।

সেই আন্দোলনমুখর পরিস্থিতিতে ঘনিয়ে আসে ৭ মার্চ। ওই দিন বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্স ময়দানে পূর্ব নির্ধারিত জনসভায় যোগদানের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লাখ লাখ মানুষ রওয়ানা দেয়। বাস, লঞ্চ, স্টিমার, নৌকা ও হেঁটে বিপুল বিক্রমে রাজধানী ঢাকার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। ইতিহাস মতে ২৬ ঘণ্টার  হাঁটা পথ পেরিয়ে গামছায় চিড়ে-গুড় বেঁধে ঘোড়াশাল থেকেও বিরাট মিছিল এসেছিলো সেই সভায়। বহু নারী, ছাত্রছাত্রী এমনকি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদেরও একটি মিছিল এসেছিলো বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য।

জনসভা শুরু হতে তখনও অনেক বাকি। বাঁধভাঙা মানুষের স্রোতে দুপুর হতে না হতেই ভরে ওঠে রেসকোর্সের ময়দান। রেসকোর্স বৃহত্তর পরিসর ময়দান পেরিয়ে জনস্রোত ক্রমেই বিস্তৃত হতে থাকে কয়েক বর্গমাইল এলাকা জুড়ে। মুহুর্মুহু গর্জনে ফেটে পড়েছে জনসমুদ্রের উত্তাল কণ্ঠ। লক্ষ কণ্ঠে এক আওয়াজ। বাঁধ না মানা দামাল হাওয়ায় সওয়ার লক্ষ কণ্ঠের বজ্র শপথ। লক্ষ হস্তে শপথের বজ্রমুষ্ঠি উত্থিত হচ্ছে আকাশে। বাতাসে পত পত করে উড়ছে বাংলার মানচিত্র অঙ্কিত সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের পতাকা। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্যের সঙ্গে দুলে উঠছে বাঙালির সংগ্রামের প্রতীক লক্ষ লক্ষ বাঁশের লাঠি।

মঞ্চ থেকে মাঝে মাঝেই স্লোগান তুলছেন সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ‘জয় বাংলা’। ‘‘আমার দেশ তোমার দেশ-বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘পরিষদ না রাজপথ-রাজপথ রাজপথ’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো-বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ো-বাংলাদেশ স্বাধীন করো’’ এই হলো রমনা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সভার দৃশ্য।

বঙ্গবন্ধু মঞ্চে ওঠেন ৩টা ২০ মিনিটে। কিন্তু ফাল্গুনের সূর্য ঠিক মাথার উপর ওঠার আগে থেকেই স্লোগান চলছে। মঞ্চে মাইকে স্লোগান দিচ্ছেন ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আব্দুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহ্জাহান সিরাজ ও আবদুল কুদ্দুস মাখন। স্লোগান দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান আবদুর রাজ্জাক। স্লোগানের ফাঁকে ফাঁকে নেতারা দিচ্ছেন টুকরো টুকরো বক্তৃতা।

এরপরই স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাইকের সামনে এসে দাঁড়ান। লক্ষ জনতার স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত তখন ঢাকার আকাশ-বাতাস। সে গগনবিদারী স্লোগান চলা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু ‘ভাইয়েরা আমার,আজ  দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি-’ এই কথা বলে তার ঐতিহাসিক ভাষণ শুরু করেন।

ভাষণের এক পর্যায়ে স্বাধীনতার ডাক দেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষকে চারটি শর্ত দিয়ে ভাষণের শেষাংশে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ মহার্ঘ্য এই বাক্যটি বলতে বঙ্গবন্ধুকে এর আগে প্রায় একশটি বাক্য বলতে হয়েছে। শব্দ উচ্চারণ করতে হয়েছে এক হাজার বিরাশিটি। আর বঙ্গবন্ধুর মাত্র আট সেকেন্ডের ঘোষণায় শুরু হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাত্র ১৯ মিনিটের এই ভাষণে ৭ কোটি বাঙালির মনের মণিকোঠায় ছবি হয়ে গেলেন শেখ মুজিব। গড়ে উঠলো দুর্বার ঐক্য, গড়ে উঠলো সংগ্রামী চেতনা। তৈরি হলো জীবন উৎসর্গের প্রেরণা। যেন সেই থেকে ৭ সাত কোটি বাঙালি মানে শেখ মুজিব, ৭ কোটি বাঙালি মানে দেশ প্রেমের আদর্শ সৈনিক। ৭ কোটি বাঙালি মানে সমগ্র বাংলাদেশ।

৭ মার্চের ঐতিহাসিক সেই ভাষণ ছিলো বাঙালি জাতির জন্য মুক্তির আহ্বান। 
এসএ/