সিরাজগঞ্জে মজুরি বৈষম্যে লাখো নারী তাঁত শ্রমিক, নীতিমালা দাবি
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশিত : ১২:৩৮ পিএম, ৮ মার্চ ২০২০ রবিবার
সিরাজগঞ্জে ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্পের প্রসারে মূল দায়িত্ব পালন করে আসছে জেলার লাখো নারী শ্রমিক। তবে মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা।
একটি শাড়ী বা লুঙ্গী তৈরীতে ৯টি ধাপের মধ্যে ৬টি ধাপেই মূল ভূমিকায় অবিচল থাকেন নারীরা। অথচ যুগ যুগ ধরে এসব নারীরা পুরুষদের মত সমানতালে কাজ করলেও তাদের চেয়ে ৩/৪ ভাগের ১ ভাগ মজুরি পাচ্ছেন তারা। বিষয়টি মহাজনদের কাছে বলেও কোনও সুরাহা হচ্ছে না।
বাজার মন্দার অজুহাতে অতীত থেকেই সামান্য পারিশ্রমিকে তাদের কাজ করানো হচ্ছে। অধিকার বঞ্চিত এসব নারীরা ‘নারী দিবস’ সম্পর্কেও কিছু জানেন না। এক্ষেত্রে নারীর মজুরি বৈষম্যরোধে গার্মেন্ট সেক্টরের মত সরকারিভাবে নীতিমালা তৈরির দাবি জানিয়েছে নারী অধিকারের সাথে কাজ করা নারী নেত্রীরা।
এনায়েতপুর থানার তাঁত শিল্প সমৃদ্ধ গোপিনাথপুর গ্রামের শ্রীমতি আপুচি বালা (৪৬)। গত ৮ বছর আগে অসুস্থ দিনমজুর স্বামী প্রদীব চন্দ্র সরকারকে হারিয়ে এক সন্তানসহ সংসার চালাতে নিজেই হাল ধরেছেন। বেছে নিয়েছেন এলাকার সকলের অন্যতম পেশা তাঁত শ্রমিকের কাজ।
ভোর থেকে গভীর রাত অবদি নিরন্তরভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন চড়কার হাতল। চড়কায় এক পাশে সুতা কেটে নাটাই ও ববিনে তোলেন। এভাবে এক ডবল সুতা কাটতে তাকে অন্তত ২/৩ দিন অপরিসীম পরিশ্রম করতে হয়। এজন্য ডবল প্রতি তাকে মহাজন মজুরি দিয়ে থাকেন মাত্র ২শ থেকে ২৭০ টাকা। এর মধ্যে সুতার মাড় তৈরিতে অন্তত ৮০ টাকা তাকে খরচ করতে হয়। এতে দিন ৭০ টাকা হারে মজুরি পেয়ে থাকেন। তাই তিন বেলা আহার জোটানো মুশকিল এই অসহায় নারীর।
তিনি জানান, গাধার মত পরিশ্রম করে যে মজুরি পাই তা দিয়ে খাওয়া চালানোই মুশকিল। তাঁতের শাড়ি কিনে পড়বো কিভাবে। এইতো আমাদের নারীদের পরিশ্রম। এভাবে কি আমরা চলতে পারি। যে শাড়ি তৈরিতে ভূমিকা পালন করছি, সেই শাড়ি মজুরি দিয়ে কিনতে পারিনা।
আপুচি বালা আরও জানান, ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখা পড়া করিয়ে ছেলেকে অভাবের কারণে আর পড়াতে পারিনি। অথচ একইভাবে পুরুষ শ্রমিক শাড়ি-লুঙ্গি বুনলে দিন ৩শ থেকে ৫/৬শ টাকা মজুরি পান। মহাজনদের বললে তারা মজুরি বাড়াবে না বলে স্পষ্ট জানিয়েছেন। তাই কি আর করা উপায় না বুঝে এভাবেই ছোট বেলা থেকেই কাজ করছি আমি।
তার মত মজুরি নিয়ে এমনি হতাশার কথা জানালেন, একই গ্রামের মৃত বৈদ্যনাথ সরকারের স্ত্রী বৃদ্ধা তাঁত শ্রমিক মিনতি বালা (৭০) এবং নজরুল ইসলামের স্ত্রী মরিয়ম খাতুন (৬২)।
তারা জানান, পরিবারের অভাবের কারণে ৭/৮ বছর বয়স থেকে সুতা কাটার কাজ করছি। তখন পেয়েছি ২৫ পয়সা মোড়া (১০টি পোল্লা)। এখন পাই ২ টাকা মোড়া। দিনে বাড়ির কাজের পাশাপাশি ১০/১২ মোড়া সুতা কাটলে ২০ থেকে ২৫ টাকা মজরি পাই। এই দিয়ে কি চলা যায়।
তারা আক্ষেপ করে আরও জানান, পুরুষদের ঠিকই মজুরি দেয়া হয়। আমাদের বেলায় বৈষম্য। কাউকে বলেও লাভ নেই। আর নারীর অধিকার এবং আন্তর্জাতিক নারী দিবস নিয়েও তারা কিছু জানেন না বলে জানান।
সিরাজগঞ্জের বেলকুচি, এনায়েতপুর, শাহাজাদপুর, উল্লাপাড়া, কাজিপুর ও সদর উপজেলার দেড় লক্ষাধিক ইঞ্জিন এবং হস্ত চালিত তাঁতে অন্তত কয়েক লাখ নারী শ্রমিক কাজ করছেন। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে উৎপাদিত উন্নত মানের শাড়ি-লুঙ্গি দেশের চাহিদা মিটিয়ে ভারতসহ বহির্বিশ্বে রপ্তাপি হচ্ছে।
এই বস্ত্র তৈরিতে পুরুষরা যেখানে শুধু সুতা রং, শাড়ি বুনন এবং ড্রামে ত্যানা পেছানোর কাজ করলেও নারী শ্রমিকরা সুতা শুকানো, পাড়ি করা, সুতা কাটা, চড়কা ববিন করা, সেলাই, বুটা কাটা কাজ করছেন। এক্ষেত্রে জেলার তাঁত শ্রমিক নারীরা মূল ভূমিকা পালন করলেও তারা দীর্ঘ দিন ধরে সঠিক মজুরি নিয়ে বিড়ম্বনায় ভুগছেন।
পুরুষ শ্রমিকেরও বিষয়টি স্বীকার করলেন অকপটে। এ ব্যাপারে গোপিনাথপুর গ্রামের তাঁত শ্রমিক রেজাউল করিম, হজরত মোল্লা, গোপালপুরের বিশু মিয়া ও ওমর আলী জানান, ‘আমরা সারাদিন কাজ করলে ৩/৫ শত টাকা মজুান পাই। আর নারীরা ১শ টাকার উপরে না। তবে তাদের চেয়ে কিছুটা আমরা ভারি কাজ করে থাকি। সে তুলনায় তাদের অন্তত ২শ টাকা দিন মজুরি হওয়া উচিত।
এ ব্যাপারে খুকনী গ্রামের মিটন কটেজ ইন্ডাষ্ট্রিজের সত্ত্বাধিকারী হাজী শফিকুল ইসলাম, হাজী ফারুক আহমেদ, খামার গ্রামের জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত টাঙ্গাইল তাঁত বাজার কারখানার মালিক তোফাজ্জল হোসেন বাবুল জানান, ‘আমাদের তাঁত শিল্পে মূলত নারীরাই প্রধান পৃষ্টপোষক হয়ে শত বছর ধরে কাজ করে আসছেন। তারা মজুরি কম পান মূলত ভারি কাজ না করায়। তবে সবাই কম পান না। বেশি কাজ করলে বেশি পান। তবে বাজার মন্দার কারণে বর্তমানে তাদের কিছুটা কম মজুরি দিচ্ছি। আবার বাড়লেই বাড়িয়ে দেয়া হবে।’
একই কথা জানালেন সিরাজগঞ্জ হ্যান্ডলুম পাওয়ারলুম ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সিরাজগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি হাজী বদিউজ্জামান বদি। তিনি বলেন, ‘তাঁত শিল্পে কর্মজীবী নারীদের অবদান বলে শেষ করা যাবেনা। তারা যথাযথ মজুরি পাক সেটা আমি চাই। তবে বাজারের বিষয়টিও ভেবে দেখতে হবে। বিদেশে নতুন-নতুন বাজার সৃষ্টি করে এ শিল্পের উৎপাদিত পণ্য বিক্রিতে সরকারের সহায়তা করতে হবে। তবেই বর্তমানে নুয়ে পড়া শিল্প চাঙ্গা হবে। বাড়বে নারী-পুরুষ সব শ্রমিকদের বেতন।’
এদিকে নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করা আলোচিত নারী নেত্রী এবং বেলকুচি পৌরসভার মেয়র বেগম আশানুর বিশ্বাস জানান, ‘তাঁত শিল্পে নারীর মজুরি বৈষম্যরোধে গার্মেন্ট সেক্টরের মত সরকারিভাবে নীতিমালা তৈরী করা দরকার। যা নেই বলে মূল ভুমিকা পালন করেও নারী তাঁত শ্রমিকেরা সঠিক মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পাশাপাশি শ্রমিক ফেডারেশন থাকলে মালিক পক্ষের কাছ থেকে আমাদের অবহেলিত নারীরা দাবি-দাওয়া আদায় করে নিতে পারবে। এতে বাড়বে নারী অধিকার।’
এআই/