বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জাগরণ চলছে: অমর্ত্য সেন
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১২:৫৭ পিএম, ১০ মার্চ ২০২০ মঙ্গলবার
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের জাগরণ চলছে। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে সংযুক্ত। কর্মসংস্থান ও যোগাযোগ অবকাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এই উন্নয়ন ভারত কিংবা পাকিস্তানসহ প্রতিবেশী অন্য কোনো দেশে হয়নি। এমনকি বাংলাদেশ যতদিন পাকিস্তানের অধীন ছিল, ততদিন এ দেশে এ রকম উন্নয়ন ছিল না।
অবকাঠামো উন্নয়নের উদাহরণ দিয়ে ভারতীয় এ অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক বলেন, ঢাকার মানিকগঞ্জের তার বাবার বাড়ি থেকে বিক্রমপুরে মামার বাড়ি যেতে দুই দিন সময়ের প্রয়োজন হতো। এখন দুই ঘণ্টাও লাগে না।
গতকাল সোমবার ঢাকায় ‘সমৃদ্ধ ও ন্যায্য সমাজের সন্ধানে অমর্ত্য সেন’ বিষয়ক আলোচনায় এসব কথা বলেছেন অমর্ত্য সেন। স্কাইপি সংযোগের মাধ্যমে ভারত থেকে আলোচনায় অংশ নেন তিনি।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য সতর্কতার কারণে তিনি আসেননি।
এ জন্য একাধিকবার দুঃখ প্রকাশ করে অমর্ত্য সেন বলেন, ‘বাংলাদেশ আমার খুবই প্রিয় দেশ। এবার আসতে না পেরে আমি দুঃখিত। আমি বাংলাদেশে অবশ্যই আসব। এ বিষয়ে আলোচনা করব। সম্ভব হলে আগামী সেপ্টেম্বরেই ঢাকায় আসব আমি।’
স্কাইপি সংযোগে দুর্বল ফ্রিকোয়েন্সির কারণে ঢাকার প্রান্তের সঙ্গে কথা বলতে প্রায়ই সমস্যা হচ্ছিল। সংযোগে সুস্পষ্ট কথা শোনা গেলে আবেগে আনন্দ প্রকাশ করতে দেখা গেছে তাকে। এ সময় তিনি বলেন, ‘ক্যান্সারের বিরুদ্ধেও যুদ্ধে জিতব।’
এ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অমর্ত্য সেনের জীবন ও কর্মের ওপর বছরব্যাপী বাংলা ভাষায় অমর্ত্য সেন পাঠচক্রের উদ্বোধন করা হলো। বাঙলার পাঠশালা এর আয়োজক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান।
অনুষ্ঠানের মূল বক্তা ছিলেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। আরও বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান এবং অমর্ত্য সেন পাঠচক্রের আহ্বায়ক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান ওসমানী। সভা সঞ্চালনা করেন বাঙলার পাঠশালা ফাউন্ডেশনের সভাপতি আহমেদ জাভেদ।
বাংলাদেশের উন্নয়নের পেছনে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এনজিওর অবদানের কথা বলেন অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক ও গণস্বাস্থ্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন তিনি। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের প্রসঙ্গ এনে তিনি বলেন, ‘আবেদ চলে গেছেন। ৭৮ সাল থেকে তার মধ্যে জবাবদিহি ও কর্তব্যবোধ দেখেছি।’
অমর্ত্য সেন আরও বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের পর এনজিওগুলো নারী উন্নয়নে কাজ করেছে। তাদের কর্মসূচির ফলেই সাধারণ মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বেড়েছে। তবে এসব বিষয়ে আরও চিন্তার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে জবাবদিহি ও কর্তব্যবোধের বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতির আলোচনায় এ বিষয় খুব একটা নেই। ইংল্যান্ডের মতো নিয়ম মেনে চলা, জবাবদিহি এবং কর্তব্যবোধ অন্য কোনো দেশে হবে না- তা মেনে নিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশে এটা খুব সামান্যই দেখা যায়, যা কষ্টদায়ক। এক সময় এ দেশে কীভাবে অন্যকে সাহায্য করতে হয়, সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ছিল।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাবে জবাবদিহির অভাব রয়েছে। বাজেটে নারী-পুরুষ সমতা ও মানবসম্পদ উন্নয়নে সর্বোচ্চ বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, এখন যে স্বল্প বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা দিয়ে মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষার মানসহ বাংলাদেশে সব পর্যায়ে বৈষম্য রয়েছে।
ড. মসিউর রহমান বলেন, যেসব সেবা জনগণকে সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়ার কথা, সেগুলো দিচ্ছে বেসরকারি খাত। শিক্ষা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে এসব কথা জোর দিয়ে বলা যায়। এর কারণ, সরকারের সেবা পর্যাপ্ত নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানসম্পন্নও নয়। যারা অর্থ দিয়ে মানসম্পন্ন সেবা কিনতে পারছে, তারা তা কিনছে। এ কারণে রাজধানীর বাইরে এখন মানসম্পন্ন হাসপাতাল দেখা যায়। সরবরাহ থাক বা না থাক; অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে চাহিদা তৈরি হয়েছে।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশ উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক খাতে উন্নয়ন দেখিয়েছে। তবে সামাজিক উন্নয়নের সূচকের গড় উন্নয়ন হলে কেবল হবে না। বৈষম্য কমিয়ে সবার জন্য উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।
গণতন্ত্রের প্রসঙ্গ এনে তিনি বলেন, যেখানে গণতন্ত্র আছে সেখানে দুর্ভিক্ষ নেই। যেমন ভারতে কখনও দুর্ভিক্ষ হয়নি, চীনে হয়েছে। তিনি বলেন, সামাজিক পশ্চাৎপদতা এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে অনেক কথা বলেছেন অমর্ত্য সেন। তার (অমর্ত্য) ওইসব বক্তব্য বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষেত্রে এখন খুব বেশি প্রাসঙ্গিক।