ইতিহাসের যত প্রাণঘাতী রোগ ও ভাইরাস
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৭:৩৯ পিএম, ১০ মার্চ ২০২০ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৬:০৩ পিএম, ১৪ মার্চ ২০২০ শনিবার
ভাইরাস
পৃথিবীতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহামারী এসেছে। ইতিহাস বলে, প্রথম যে মহামারী রোগটি এসেছিল তার নাম ‘এন্টোনাইন প্লেগ’ (১৬৫ সাল)। এ রোগ রোমান সাম্রাজ্যে বিস্তার হয়েছিল। এতে প্রায় ৫০ লক্ষ লোক মারা যায়। সে সময় রোমান সম্রাট ছিল মার্কাস অরেলিয়াস (Marcus Aurelius)।
রোমানদের ধারণা ছিল, খ্রিস্টানরা তাদের দেব-দেবীদের পূজা করে না বলে তাদের অভিশাপে এ গজব এসেছে। এ কারণে সে সময়ে অনেক খ্রিস্টানকে হত্যাও করা হয়। তাতে অবশ্য রোগটির বিস্তার কমেনি, বরং মার্কাস অরেলিয়াস নিজেই এ রোগে মারা যান।
এরপর ৫৪২ সালে সাম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের আমলে রোমান সাম্রাজ্যে দ্বিতীয়বার হানা দেয় মরণঘাতি প্লেগ। কালো ইঁদুরের (rat flea) মাধ্যমে ছড়ানো এ বিউবোনিক প্লেগে মারা যায় আড়াই কোটির বেশি মানুষ। বলা হয় যে, এই দুই প্লেগ রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংসের অন্যতম কারণ।
তবে, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি লোকের প্রাণহাণি ঘটায় যে রোগ তার নাম ‘ব্ল্যাক ডেথ’ (Black Death)। এটাও বিউবোনিক প্লেগ। কয়েকশো বছর পরে (১৬২৯ সালে) ইউরোপের মিলান, ভেনিস ও ফ্লোরেন্স শহরে; ইংল্যান্ডে (১৬৬৫ সালে); ফ্রান্সের মার্সেই শহর (১৭২০ সালে); ও চীনের ইউনান প্রদেশে (১৮৫৫ সালে) এ রোগ আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
ধারণা করা হয়, সর্বসাকুল্যে এ রোগে মারা যায় প্রায় ২০ কোটি মানুষ। ১৮৯৭ সালে অবশ্য ওয়ালডেমার হাফকিন (Waldemar Haffkine) প্লেগের ভ্যাকসিন আবিস্কার করেন। তবে সেটাও খুব একটা সর্বতোভাবে স্বীকৃত ভ্যাকসিন নয়।
প্লেগের মতো কলেরা রোগও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে আবির্ভূত হয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। গত দুশো বছরে সাত বার কলেরা মহামারি আকারে দেখা যায়। এর মধ্যে ১৮৫২ সালের তৃতীয় কলেরা মহামারি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। শুধু এ সময় মারা যায় ১০ লক্ষ মানুষ।
১৮৮৩ সালে ৪র্থ বার হজ্বের সময়ে সৌদি আরবে কলেরার প্রাদুর্ভাব ঘটে। এ ঘটনায় ৩০ থেকে ৯০ হাজার হাজী কলেরায় মারা যায়। পাসিনি (Pacini), কোচ (Koch), লুই পাস্তুর (Lois Pasteur) ও ফেরানের (Ferran) গবেষণা সূত্র ধরে অবশেষে ১৮৮৫ সালে কলেরার প্রতিষেধক আবিস্কৃত হয়।
তথাপি, ১৯১০ সালে মধ্য এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ায় ৬ষ্ঠ বারে কলেরায় মারা যায় ৮ লক্ষাধিক লোক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বলছে, এখনও বিশ্বে প্রতি বছর ১৩ থেকে ৪০ লক্ষ মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয়, মারা যায় ২১ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৪৩ হাজার।
প্লেগ বা কলেরা হতো এক সাথে। তবে হঠাৎ করে না ছড়ালেও যে রোগটি মানব সমাজকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে তার নাম এইআইভি/এইডস। রক্ত, সূঁচ বা যৌন সংস্পর্শের মাধ্যমে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে এ রোগের ভাইরাস (Human Immuno deficiency Viruses) ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে ৩ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। এ যাবৎ মারা গেছে প্রায় ৮ লক্ষ।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চেহারায় প্লেগ যেমন মানুষের জীবন বিনাশ করেছে, ঠিক তেমনিভাবে আরেকটি রোগ গত দেড়শো বছর ধরে মানুষকে ব্যস্ত রেখেছে। রোগটির নাম ফ্লু। ভাইরাসের নাম ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইপ এ (Influenza A)। এ ভাইরাসটি এক এক সময়ে এক একটি রূপ নিয়ে মানব সমাজে মহামারি সৃষ্টি করেছে। এটি মূলত আক্রান্ত লোকের হাঁচি, কাশি থেকে বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়।
১৮৮৯ সালে ‘রাশিয়ান ফ্লু’ (টাইপ-H3N8)-তে পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ায় মারা যায় ১০ লক্ষ মানুষ। ১৯১৮ সালে ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ (টাইপ H1N1)-তে সারা বিশ্বে প্রায় ২-৫ কোটি মানুষ মারা যায়। এ ভাইরাসটি ২০০৯ সালে আবার আঘাত হানে ‘সোয়াইন ফ্লু’ নামে। এ সময়ে মারা যায় ১ থেকে ৪ লাখ মানুষ।
চীন-সিংগাপুর-হংকং হয়ে এই ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসটি ১৯৫৬ সালে ‘এশিয়ান ফ্লু’ (টাইপ H2N2) নামে বিশ্বে আতঙ্কের সৃষ্টি করে, মারা যায় ২০ লক্ষ মানুষ। এশিয়ান ফ্লুর আতঙ্ক কাটতে না কাটতে দেখা দেয় ‘হংকং ফ্লু’ (টাইপ H3N2)। সিংগাপুর ও ভিয়েতনাম থেকে শুরু হয়ে এটি ফিলিপাইনস, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। মারা যায় ১০ লক্ষ মানুষ।
২০০৪ সালে ‘বার্ড/ এভিয়ান ফ্লু’ (টাইপ H5N1) নামে এ ভাইরাসটি পাখি জাতীয় প্রাণির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পশুপাখি মারা গেলেও অবশ্য এ রোগে খুব বেশি মানুষ মারা যায়নি।
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মতো আরেকটি ভাইরাস শ্বাসযন্ত্রের জন্য যম হিসেবে আবির্ভূত হয়। নাম করোনা (corona) ভাইরাস বা কোভিড-১৯। বর্তমানে চীনের যে করোনা ভাইরাসের আক্রমণ চলছে তা নতুন কিছু নয়। চীনের ইউনান প্রদেশ হতে সার্স (SARS- Severe Acute Respiratory Syndrome, SARS-CoV) নামে ২০০৩ সালে প্রথম করোনা ভাইরাস আবির্ভূত হয়। সম্ভবত বাদুড়ের (horseshoe bat) মাধ্যমে এটি সংক্রামিত হয়েছিল। তখন সব মিলিয়ে ২৯টি দেশে ৮ শতাধিক লোক সার্সে মারা যায়।
এর পরে দ্বিতীয়বার করোনা ভাইরাস মার্স (MERS- Middle East Respiratory Syndrome, MERS-CoV) নামে দেখা দেয়। মার্সের উৎপত্তি ঘটে সৌদি আরব ও কাতারে। ২০১৫ সালে ২১টি দেশে মার্সের প্রকোপ ঘটে। এটিও সংক্রমিত হয়েছিল বাদুড়ের (Egyptian tomb bat) মাধ্যমেই। সার্স বাংলাদেশে প্রবেশ না করলেও মার্স রোগী বাংলাদেশে পাওয়া গিয়েছিল।
আর ২০১৯ সালের শেষ দিকে চীনের হুবেই (Hubei) প্রদেশের রাজধানী উহানে (Wuhan) ঘটলো করোনা ভাইরাসের তৃতীয় আবির্ভাব। ভাইরাসটির এ বারের প্রজাতির নাম 2019-nCoV। ইতোমধ্যে (১৪ মার্চ, ২০২০) ভাইরাসটি বিশ্বের ১১৫টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। চিহ্নিত আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২ লাখ, যার মধ্যে প্রাণ হারিয়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশি লোক। এদের অধিকাংশই চীনের অধিবাসী। বাংলাদেশেও এসে পড়েছে ভাইরাসটি। দেশে এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্ত সনাক্ত হয়েছেন তিন জন।
এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে জ্বর জাতীয় আরও পাঁচটি রোগ বিশ্ববাসীকে যথেষ্ট আতঙ্কিত করেছে। এগুলো হলো- ইবোলা, জিকা, চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু ও পীত জ্বর।
ইবোলা
ইবোলা (Ebola) ভাইরাস মানুষকে কম কষ্ট দেয়নি। ১৯৭৬ সালে আফ্রিকার সুদান ও জায়ার হতে ইবোলা যাত্রা শুরু করে। এর পর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে ইবোলার আক্রমণ দেখা যায়। এটি রক্তের মাধ্যমে সংক্রামিত হয়। আফ্রিকা মহাদেশ থেকে আমেরিকা বাদে অন্য মহাদেশে ইবোলা খুব বেশি একটা ছড়াতে পারেনি। আফ্রিকায় ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ইবোলার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পায়। এ সময় প্রায় ১২ হাজার লোক ইবোলায় মারা যায়। তিন বছর পর ২০১৯ সালে এসে ইবোলার ভ্যাকসিন আবিস্কৃত হয়।
জিকা
১৯৫২ সালে উগান্ডা ও তানজানিয়াতে মানবদেহে প্রথমবারের মতো জিকা ভাইরাস শনাক্ত করা হয়। উগান্ডার জিকা নামের একটি গ্রামের নাম অনুসারে এ ভাইরাসের নামকরণ করা হয়। ২০১৫ সালে ব্রাজিল হতে জিকা ভাইরাস মহামারি আকারে দেখা দেয়, পরে তা ৮৪টি দেশে ছড়িয়ে পড়ে। হাজার পাঁচেক লোক এতে আক্রান্ত হলেও কেউ মারা গেছে বলে জানা যায় নি। যদিও জিকা ভাইরাসের টিকা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি।
চিকুনগুনিয়া
চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের নাম- CHIKV। তানজানিয়াতে ১৯৫২ সালে রোগটি প্রথম ধরা পড়ে। তানজানিয়ার মাকুন্দি জনগোষ্ঠির ব্যবহৃত কিমাকুন্দি ভাষা থেকে চিকুনগুনিয়া শব্দটি গৃহীত। এর যার অর্থ- "কুঁচিত হওয়া" বা “বাঁকা হয়ে যাওয়া”। চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব সাধারণত এশিয়া ও আফ্রিকাতে বেশি দেখা যায়। ২০১৪ সালে এক মিলিয়নের বেশি মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটে। হাজারে ১ জন এ রোগে মারা যায়।
ডেঙ্গু
২০১৯ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু ছিল এক আতঙ্কের নাম। ১৭৭৯-তে প্রথম ডেঙ্গু মহামারী আকারে ছড়িয়ে ছিল হয়েছিল বলে ধারনা করা হয়। শরীরে ব্যথার কারণে তখন একে 'হাড়ভাঙ্গা জ্বর' বলেও ডাকা হতো।
“ডেঙ্গু” শব্দটির উদ্ভব পরিষ্কার নয়। খুব সম্ভবত, সোয়াহিলি শব্দ “ডিঙ্গা” হতে স্পেনীয় শব্দ “ডেঙ্গু” এসেছে। এর অর্থ “খুঁতখুঁতে বা সাবধানী”। গত বছরে ব্যাপকভাবে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পায়, মারা যায় শতাধিক লোক।
পীতজ্বর
পীতজ্বর ইংরেজিতে ‘ইয়েলো ফিভার’ নামে পরিচিত। বিশ্বে প্রতিবছর দুই লক্ষ লোক পীতজ্বরে আক্রান্ত হয় ও প্রায় ত্রিশ হাজার রোগী মৃত্যুবরণ করে। এদের প্রায় নব্বই শতাংশ রোগীই আফ্রিকার। দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় এই রোগের প্রাদুর্ভাব অনেক বেশি হলেও এশিয়াতে খুব একটা দেখা যায় না।
মূলত প্লেগ, কলেরা, এইডস, ফ্লু, সার্চ-মার্স-করোনা, ইবোলা, জিকা, চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু- নামে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব প্রাকৃতিক নিয়মের আয়ত্ত্বাধীন। এ সব রোগের অনেকগুলোই এখনও বর্তমান আছে, আবার অনেক রোগ চিরতরে নির্মূল হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে হয়েতা আবার নতুন কোনও এক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটবে। এভাবে প্রকৃতির সাথে লড়াই করেই লক্ষ-কোটি বছরের এই মানব সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে।
এক সময় এদেশে যক্ষা ছিল অভিশপ্ত রোগ; গুটিবসন্ত ছিল “ওলা বিবি”র আগমণ। ডেঙ্গুর প্রকোপের সময়েও কম গুজবের অবতারণা হয়নি। করোনা ভাইরাস নিয়েও অনেকে গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে সময়ের সাথে সাথে সভ্যতার হাত ধরে অনেক কুসংস্কার মিটে গেছে, এগুলোও মিটে যাবে।
এনএস/