করোনায় আচ্ছন্ন ...
আহমেদ মুশফিকা নাজনীন
প্রকাশিত : ১২:৫৩ পিএম, ১২ মার্চ ২০২০ বৃহস্পতিবার
ক’দিন আগে এক সহকর্মী হঠাৎ প্রশ্ন করলো- আচ্ছা আমার যদি করোনা হয় আপনি কি আমাকে দেখতে যাবেন? ওর এমন প্রশ্নে থমকে গেলাম। দোটানায় পরলাম। কি উত্তর দিব ভাবতে ভাবতেই সে বললো, না থাক আপনাকে আসতে হবে না। তার চেয়ে ফেসবুকে যোগাযোগ করেন, তাতেই খুশী হবো। মনে মনে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললাম। বিষয়টা যেন এরকম, আমি তো যেতেই চেয়েছিলাম তুমিই তো মানা করলে। তবে বিষয়টা মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগলো। করোনা এত শক্তিশালী যে প্রিয়জনকে দূরে সরিয়ে দেয়!
ছোটবেলা কিংবা বড়বেলা সব বেলাতেই একটু জ্বর হলেই মানুষ খোঁজে প্রিয়মানুষের হাত। মা ,বাবা, ভাই, বোন, ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী অথবা বর কেউ কপালে একটু হাত ছোঁয়ালেই মন হয়ে যায় নরম। জ্বর বাবাজি তখন একটু দূরে সরে যায়। সেই হাত পরবে না কপালে। করোনার ভয়ে সরে যাবে তারা। মানতে পারা যাচ্ছে না।
কথা বললাম এক বন্ধুর সাথে। সে চিন্তিত। প্রশ্ন তার। কেউ যদি মারা যায় তাহলে তার মৃতদেহের কি হবে? জানাযায় কি মানুষ আসবে? সবাই তো ভয়ে থাকবে। উত্তর দিতে পারলাম না। হাবিজাবি কি সব যেন বললাম। নিজেই সন্তুষ্টু হতে পারলাম না। করোনায় যেন থমকে যাচ্ছে সব। মানুষ কি তবে নিজেকেই সবচে বেশী ভালবাসে? এই যে, এত এত ভালবাসার কথা বলি, শুনি, সব কি তবে মিথ্যে? করোনা কি জাগতিক সব মায়াকে বিভ্রম প্রমাণ করতে এসেছে?
আরটিভির এক সাংবাদিক গভীর বিশ্বাস নিয়ে বলেন- আমি যদি করোনায় আক্রান্ত হই জানি সব তুচ্ছ করে আমার মা ছুটে আসবে। কাঁদতে কাঁদতে কপালে হাত রাখবেন। কিসের করোনা ভাইরাস? মা সারাক্ষণ বসে থাকবেন পাশে। আমি ভালো হয়ে যাবো। ওর কথা শুনে মন কেমন করে ওঠলো। সত্যি পৃথিবীতে সবাই চলে গেলেও, মা বাবা কখনো চলে যান না, ছেড়ে যান না। মন খারাপ করা রাতে তাই মা মা করে কেঁদে ওঠে নাগরিক যন্ত্রনায় পিষ্ঠ মানুষ। যেন মা বা বাবাকে ডাকলেই দূর হয়ে যায় সব লাল নীল যন্ত্রণা। শোনে শুধু রাতের আকাশ।
অফিসে আসতে আসতে ভাবছিলাম করোনায় যন্ত্রণায় সত্যিই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠছি আমরা। আরো ভয় ধরাচ্ছে নানা সব তথ্য। আমরা সবাই যেন করোনা বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছি। যে যার মত তথ্য দিচ্ছি করোনা নিয়ে। এ বলছে করলা খাও ও বলছে কামরাঙার রস খাও। গরমে মরে যায় করোনার ভাইরাস। তাই এসি বন্ধ করে ঘর গরম রাখছে কেউ কেউ। নিজে মরি, কিন্তু করোনা মরে না। ফোন আসে সিরাজগঞ্জ থেকে। এক ব্যাক্তির দাবী তার করোনার মত সিমটম ছিলো। কামরাঙার রস খেয়ে ভালো হয়ে গেছে। ফেসবুকে লাইভ দেয় অনেকে। ম্যাসেন্জারে ভরে যায় নানা তথ্য । কপি পেষ্ট শেয়ার হতে থাকে তথ্যগুলো। সেসব পড়ে টম ও জেরীর মতো মাথা ঘুরতে থাকে। এত বিশেষজ্ঞ! কখন তৈরী হলো। ডাক্তারদের চাকরী নিয়ে ভয় হয়। তাদের চেয়ে আমরা সবাই কত কিছু জেনে গেছি। স্বপ্নেও আবার অনেকে নাকি অনেক ওষুধ পেয়েছেন।
এক বন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম। ঢুকতেই সে যেতে বললো বেসিনে। পাশে ঘড়ি রাখা। ২০ সেকেন্ড টাইম। হাত ধোয়ার জন্য। দেখি অতিথিরা সবাই হাত ধোয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পরেছেন। সবার সাথে মাস্ক। সব গল্প গিয়ে শেষ হচ্ছে করোনায়। মনে হলো মিনা কার্টুনের মিনা যে গত ২৫ বছর ধরে হাত ধোয়ার কথা বলে আসছে তা নতুন করে সবার সামনে উপস্থিত। এতো দিন সব শুনেছি, মেনেছি কতজন? সারা বিশ্ব এখন নিয়মিত হাত ধুতে বলছে। হাটে বাজারে মাঠে বাড়িতে শুধু চলছে করোনা আতংক।
কাল ডিআরইউতে নারী দিবসের অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রীর সাথে দেখা। বললেন, যার যার কাজ তাকে করতে দিন। সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে নির্দেশনা দিচ্ছে তা মেনে চলুন। নিজেরা যে যার মত বিভ্রান্তীমুলক তথ্য ছড়াবেন না।
বাসায় আসতে আসতে দেখি রাস্তায় জমে আছে ময়লার স্তুপ। মশা, মাছি, পোকা ভনভন করছে তাতে। মাথার উপর দিয়ে, শরীরের চারপাশ দিয়ে করোনাসহ নানা জীবানু ঘুরে বেড়ায়। ভাবতে লাগলাম। নিজের চারপাশ পরিস্কার না রেখে উপদেশ দিতে ব্যস্ত বাঙালী। আমি বা তাতে বাদ যাই কেন? মনে মনে বলি, সমস্যা আসবে, সমাধানও থাকবে।
তাই আসুন নিজে পরিস্কার থাকি মনে ও মননে। পরিবেশও রাখি পরিচ্ছণ্ন। করোনা, ডেঙ্গু, হিংসা, লোভ, দুর্নীতি থেকে মুক্ত রাখি আমার স্বদেশ।
লেখক : সাংবাদিক
এসএ/