নোয়াখালীতে বিপাকে কৃষক, দাম না পাওয়ায় খেতেই ধানের গাদা
দ্বীপ আজাদ, নোয়াখালী প্রফতিনিধি:
প্রকাশিত : ০৬:২৭ পিএম, ১২ মার্চ ২০২০ বৃহস্পতিবার
সুবর্ণচর উপজেলার চর ওয়াপদা গ্রামের কৃষক মো. ইব্রাহিম (৩৫)। পূর্ব পুরুষ থেকেই কৃষিই তাদের পারিবারিক আয়ের উৎস। নিজের নামে সামান্য জমিসহ প্রায় ২০ একর জমি বর্গা করেন। গেল আমন মৌসুমে প্রায় সবগুলো জমিতেই আমন আবাদ করেছিলেন। তবে আমন ঘরে তোলার কিছুদিন পূর্বেই কারেন্ট পোকায় কিছু ধান বিনষ্ট করলেও আশানুরোপ ধান পেয়েছেন। ভালো ধান উৎপাদন হলেও বর্তমানে প্রায় তিন লাখ টাকা ঋণগ্রস্ত তিনি।
তিনি বলেন, খেত থেকে ধান যখন তুলেছেন, তখন ধানের দাম ছিল সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা। কিছু ধান বিক্রি করে শ্রমিকদের দিয়েছেন। বেশিরভাগ ধান রেখে দিয়েছেন দাম পাওয়ার আশায়। এর মধ্যে তিনি সয়াবিন ও তরমুজসহ অন্যান্য রবি শস্য আবাদ করেছেন। ধান বিক্রি করতে না পারায় এসব শস্য আবাদে তাকে বিভিন্ন ব্যক্তি ও এনজিও থেকে ঋণ নিতে হয়েছে। আক্ষেপ করে বলেন, গত প্রায় আড়াই মাস অপেক্ষা করেও ধানের দাম পাচ্ছেন না। ফলে এখনও বাড়ির সামনে গাদা করে রেখেছেন ধান। বর্তমানে বাজারে ৬৮০টাকা হারে মন বিক্রি হলেও এ দামে ধান বিক্রি করলেও পোশাবে না তার। যার কারণে রবি শস্য আবাদ করতে গিয়ে দেনাগ্রস্ত হয়েছেন। এমন অবস্থায় ভবিষ্যতে কৃষি কাজ নিয়ে শঙ্কিত তিনি।
শুধু কৃষক ইব্রাহিম নন। আশানুরোপ দাম না পাওয়ায়, খাদ্য অধিদপ্তর পর্যাপ্ত ধান ক্রয় না করা এবং ক্রয়ে অনিময় থাকায় নোয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলায় এখনও আমন ধান নিয়ে বিপাকে কৃষকরা। ফলে খেতে কিংবা কৃষকের বাড়ির আঙ্গিনায় গাদা করে রেখেছে ধান। এতে ঋণগ্রস্ত হওয়ায় ভবিষ্যতে ধান আবাদে অনিহা আর শঙ্কার কথা জানালেন অনেক কৃষক।
সরেজমিনে গেলে কৃষকরা জানান, প্রায় আড়াই মাস পূর্বেই খেত থেকে উঠেছে আমন ধান। এখন সময় রবি শস্য আবাদের। অথচ, এখনও নোয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলায় অনেক কৃষক ক্ষেতে বা বাড়ির সামনে ধানের গাদা দিয়ে রেখেছে। আশানুরোপ দাম না পাওয়ায় ধানের এমন গাদা। অনেকে অভাব-অনটনে পড়ে শুরুতে নামমাত্র মূল্যে ধান বিক্রি করে এখন ঋণগ্রস্ত। আবার কেউ কেউ কিছু ধান এখন বিক্রি করছেন, কিছু রেখে দিচ্ছেন বাংলা ফাল্গুনের শেষের দিকে দামের আশায়। কৃষকরা জানান, গত ৩-৪ বছরই উৎপাদন খরচের চেয়ে বাজারে ধানের দাম কম। ফলে অনেকে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, ভবিষ্যতে পুনরায় ধান আবাদ করে বড় ধরনের লোকসানের শঙ্কাও তাদের।
একদিকে বাজারে ধানের দাম কম, অপর দিকে সরকারিভাবে ধান ক্রয় হচ্ছে উৎপাদনের তুলনায় নগন্য। তার উপর খাদ্য বিভাগে ধান বিক্রি করতে গিয়েও নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে কৃষককে। এমন অভিযোগ করেছেন অনেক কৃষক।
ষাটোর্ধ্ব কৃষক নজির আহম্মদ জানান, আমনমৌসুমে তিনি ২২ একর জমিতে ধান করেছেন। এর মধ্যে কিছু নিজের রয়েছে, আর বেশিরভাগ জমিই বর্গা। ভালো ধানও পেয়েছেন। বাজারে ধানের দাম কম বিধায় এখনও খেতেই ধানের গাদা করে রেখেছেন। তবে সম্প্রতি সরকারিভাবে ধান ক্রয়ের খবর পেয়ে খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মাত্র এক টন ধান বিক্রির সুযোগ পেয়েছেন। তাও ধান নিয়ে গেলে নানা অযুহাতে তার ধান ফিরিয়ে দিয়েছে গুদাম কর্তৃপক্ষ। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে তিনি তার নামের ধানের টোকেনটি পাইকারের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন।
তবে ধান সংগ্রহে অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জেলা খাদ্য নিযন্ত্রক কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত খাদ্য নিয়ন্ত্রক একেএম আবু সাঈদ চৌধুরী। তিনি বলেন, তারা নিয়ম মেনেই ধান নিচ্ছেন। টোকেন প্রাপ্ত হলেও যদি আদ্রতা সরকারি নিয়মের বাহিরে থাকে তাহলে সে ধান নেয়া হচ্ছে না। যেসব কৃষক নিয়ম মেনে ধান নিচ্ছেন গুদামে তাদের কাছ থেকে সাদরেই ধান সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে তিনি বলেন, গুদামগুলোতে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় কখনও কখনও ধান সংগ্রহে কিছুটা সময় নিতে হচ্ছে। তারপরও কৃষকদের অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন এ কর্মকর্তা।
সরকারিভাবে মিলারদের ধান ক্রয়ে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া, খাদ্য গুদামের মাধ্যমে সহজ শর্তে ধান ক্রয় ও সংগ্রহের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং কৃষিতে ভুর্তকি বাড়ালেই সমস্যার সমাধান মিলবে বলে মনে করেন স্থানীয় পাকাইকার ও গবেষকরা।
ধানের বাজার মূল্য এখনও আশানুরোপ নয় বলে মনে করেন আল-আমিন বাজারের ধান পাইকারি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মানিক। তিনি বলেন, স্থানীয় পাইকারদের কাছে কিছু নেই। মিলাররা যেভাবে দাম নির্ধারণ করেন সেভাবেই ধান ক্রয় করেন তারা। তবে এভাবে বছরের পর বছর কৃষক ধানের দাম না পেরে ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে ধান আবাদ বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন এ পাইকারি ব্যবসায়ী।
খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক (খানি) এর সেক্রেটারি নুরুল আলম মাসুদ বলেন, এ সমস্যা সারা দেশের, তবে এমন সংকট থেকে উত্তোরনের উপায় হিসেবে সরকারিভাবে ধানের আগাম মূল্য ঘোষণা, উপজেলা ভিত্তিক গুদামের ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা, শস্য মজুদ ঋণ পুনরায় চালু করা এবং কৃষকদের মাঝে বিনা সুদে ঋণ ও জমি পরিমাণ বীজ সহযোগিতার উপর জোর দেন তিনি।
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জেলা প্রশাসক তন্ময় দাস উৎপাদন হিসেবে নোয়াখালীতে সরকারি সংগ্রহ নগন্য হওয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, এ বিষয়ে সামনে সমন্বয় সভায় আলোচনা করা হবে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে নোয়াখালীতে ভবিষ্যতে সরকারিভাবে আমন সংগ্রহ বাড়ানোর সুপারিশ করার আশ্বাস দেন তিনি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এবার আমন মৌসুমে ধান উৎপাদন হয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টন। আর খাদ্য বিভাগ ক্রয় করছে মাত্র ১৪৭৮৮ টন।
আরকে//