মাটি, মানুষ, বঙ্গবন্ধু
আনিসুজ্জামান
প্রকাশিত : ০৩:৪৫ পিএম, ১৫ মার্চ ২০২০ রবিবার | আপডেট: ০৩:৪৫ পিএম, ১৫ মার্চ ২০২০ রবিবার
পূর্ববঙ্গের এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, লেখাপড়া করতে গোপালগঞ্জ থেকে গেলেন কলকাতায়- সেদিনের স্বপ্নের নগর ও সভ্যতার কেন্দ্রে। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে। দেশে চলছে স্বাধীনতা সংগ্রাম, তারই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে পাকিস্তান-আন্দোলন। সেকালে অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান আত্মবিকাশের যে সম্ভাবনা দেখেছিল, সে স্বপ্ন লাগল তারও চোখে। মুসলিম লীগ-সমর্থিত ছাত্র-সংগঠনের কর্মী হলেন মুজিব, হলেন বঙ্গীয় মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্যও।
বঙ্গীয় মুসলিম লীগে উপদল ছিল : সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম এবং নাজিমুদ্দীন-আকরম খাঁর নেতৃত্বে। মুজিব প্রথমটিতেই গেলেন, ওটিকেই মনে করা হতো একটু অগ্রসর, অপেক্ষাকৃত সমাজসচেতন, কিছুটা সম্মুখ দৃষ্টিসম্পন্ন। ১৯৪৬-এর প্রাদেশিক নির্বাচনে মুজিব জোর খাটলেন, দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন দলীয় নেতাদের, নিজেও হয়ে উঠলেন ছাত্রলীগের একজন নেতা। পাকিস্তান অর্জিত হল। মুজিবের কর্মক্ষেত্রে বদল হল- এবারের পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের রাজধানী ঢাকায় শিকড় গাড়লেন।
যে পাকিস্তানের জন্য এত কিছু করা, সে পাকিস্তান সম্পর্কে মোহভঙ্গ হতে সময় লাগল না মুজিবের। প্রথমে চেষ্টা করলেন মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে থেকে কাজ করার। পারলেন না- বিরোধ লেগে যায় পদে পদে। রাষ্ট্রভাষা নিয়েই প্রথম সংঘাত লাগল। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কারণে গ্রেফতার হলেন তিনি। সেই ’৪৮ থেকে ’৭১ সালের মধ্যে কতবার যে বন্দি হলেন তিনি, তার ইয়ত্তা নেই।
মওলানা আবদুল হামিদ খানের নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের উদ্যোগে যুক্ত হলেন মুজিব। বিকল্প রাজনৈতিক দল, মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশের বিকল্প পথের অনুসন্ধান শুরু হল। পেছনে ফিরে তাকাননি একবারও। যে তটভূমি ছেড়ে অনিশ্চিতের উদ্দেশে যাত্রা করলেন, একবারও ফিরে তাকালেন না। জেলে যাচ্ছেন, মুক্তি পাচ্ছেন, মন্ত্রী হচ্ছেন, আবার সংসার দেখতে পারছেন না, সংগঠন করেছেন, জড়িয়ে পড়ছেন নানা বিরোধ-সংঘাতে, চেতনায় পরিবর্তন আসছে, তার প্রতিফলন ঘটছে জীবনে ও রাজনীতিতে।
সে পরিবর্তনের মূলে নিশ্চয় ছিল একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাব। ওই দিনটাই তো পাল্টে দিল ইতিহাসের গতিপথ। সেই নতুন পথ ধরে যুক্তফ্রন্টের গঠন ও তার অবিশ্বাস্য বিজয় লাভ। ক’দিনের মন্ত্রিত্বের পরে আবার কারাগারে। ৯২ ক ধারার শাসন প্রদেশে। আওয়ামী মুসলিম লীগ রূপান্তরিত হল আওয়ামী লীগে। যুক্তফ্রন্ট ভাঙল, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভায় আবার স্থানলাভ। আবার পদচ্যুতি মন্ত্রিসভার, এবারে সামরিক শাসন সারা দেশে। তার আগেই আওয়ামী লীগ ভেঙেছিল, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, গঠিত হয়েছিল মওলানা ভাষানীর নেতৃত্বে। সারা পাকিস্তানে ন্যাপের বিস্তৃতি সোহরাওয়ার্দী মৃত্যুতে আওয়ামী লীগের দেশব্যাপী সংগঠনে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণতর। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েই মুজিব খুশি- বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রচিত হল ছয় দফা, তার ভাষায় জাতীয় মুক্তির সনদ। এবারে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুবের আসন টলল, মুজিব হলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭০ সালের ১ ডিসেম্বর নির্বাচনী আবেদন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু স্মরণ করেছিলেন পূর্ববর্তী ক’টি বছরের কথা :
‘আমার নিজেন জন্য নয়, বাংলার মানুষের দুঃখের অবসানের জন্য ১৯৬৬ সালে আমি ছয় দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলাম। এই দাবি হচ্ছে আমাদের স্বাধিকার, স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের দাবি, অঞ্চলে অঞ্চলে যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে তার অবসানের দাবি। এই দাবি তুলতে গিয়ে আমি নির্যাতিত হয়েছি। একটার পর একটা মিথ্যা মামলায় আমাকে হয়রানি করা হয়েছে। আমার ছেলেমেয়ে, বৃদ্ধ পিতামাতা ও আপনাদের কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে কারাগারে আটক করে রাখা হয়েছিল। আমার সহকর্মীদেরকেও একই অন্যায়-অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছে। সেই দুর্দিনে পরম করুণাময় আল্লাহর আশীর্বাদস্বরূপ আপনারাই কেবল আমার সঙ্গে ছিলেন। কোনো নেতা নয়, কোনো দলপতি নয়, আপনারা বাংলার বিপ্লবী ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক ও সর্বহারা মানুষ রাতের অন্ধকারে কারফিউ ভেঙে, মনু মিয়া, আসাদ, মতিউর, রুস্তম, জাহুর, জোহা, আনোয়ারার মতো বাংলাদেশের দামাল ছেলেমেয়েরা প্রাণ দিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলে আমাকে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কবল থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিনের কথা আমি ভুলে যাই নাই, জীবনে কোনোদিন ভুলব না, ভুলতে পারবো না। জীবনে আমি যদি একলাও হয়ে যাই, মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মতো আবার যদি মৃত্যুর পরোয়ানা আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, তাহলেও আমি শহীদের পবিত্র রক্তের সঙ্গে বেইমানি করবো না। আপনারা যে ভালোবাসা আমার প্রতি আজও অক্ষুণ্ন রেখেছেন, জীবনে যদি কোনোদিন প্রয়োজন হয় তবে আমার রক্ত দিয়ে হলেও আপনাদের এ ভালোবাসার ঋণ পরিশোধ করবো।’- তার এই কথাই একদিন সত্য হয়েছিল, তবে সে পরের কথা।
১৯৬৯-৭০-এ বঙ্গবন্ধুই হয়ে উঠেছিল বাঙালির একচ্ছত্র নেতা, জনগণের সঙ্গে তার একাত্মতার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ এ সময়টায়। তার লক্ষ স্থির হয়ে গিয়েছিল এবং এ অঞ্চলের মানুষকেও তিনি সেই পথের পথিক করে নিতে পেরেছিলেন। আপাতত ছ’দফা-ই চাই, তারপর দেখা যাবে- এমন একটা মনোভাব মানুষের। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে তার যে অদ্ভূতপূর্ব বিজয় সারা বিশ্বকে বিস্মিত করেছিল, তার শক্ত ভিত রচিত হয়ে গিয়েছিল ১৯৬৯-৭০-এ-ই। তিনি যদিও অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন নির্বাচনের ফলাফলে, তবু এ কথা বলতে ভোলেননি যে, এ ফল এক ব্যাপক গণজাগরণের প্রকাশ এবং এ কথাও বুঝতে ভুল করেননি যে এ ফল তার ওপর অনেক বড় দায়িত্ব আরোপ করেছে।
প্রতিকূলতা কী হতে পারে তাও তিনি বুঝেছিলেন। ১৯৫৮ সাল থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সামরিক শাসনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব করে আসছিলেন তিনি। তবু আশাও ছিল। জনমতের এ বিপুল বিস্ফোরণকে অগ্রাহ্য করবে কি শাসকরা? তাই করল শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তার আগে ১৯৭১-এর মার্চ মাসের তিনটি সপ্তাহ ধরে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন চালান, প্রশাসনকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাহীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্পূর্ণ অধীন করা, সামরিক শক্তিকে কিছুকালের জন্য হলেও নখদন্ত লুকিয়ে রাখতে বাধ্য করা- এর নজির নেই পৃথিবীর ইতিহাসে।
তারপর যা হল, তারও নজির নেই পৃথিবীর ইতিহাসে। সুসংগঠিত, আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত সামরিক বাহিনীকে শৃঙ্খলমুক্ত করে লেলিয়ে দেয়া হল নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু আবার বন্দি- রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে- তাকে শাস্তি না দিয়ে ছাড়বে না শাসকরা। কিন্তু তারই ফাঁকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হল তার নামে। তিনি থাকলেন না মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়ে- তবুও কেউ ভুলল না তার কথা। সারা পৃথিবী ভুলল না। মুক্তিযুদ্ধের শেষে দেশনায়ক ফিরে এলেন স্বদেশে। সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে- পূর্ণ হবে না।’
এরপর সাড়ে তিন বছরের কিছু বেশি সময় পেয়েছিলেন তিনি। তার প্রশাসন নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে। এক বছরের কম সময়ের মধ্যে একটি চমৎকার গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনা, দেড় বছরের মাথায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনের কাজে অগ্রগতি, ব্যাপকভাবে বাংলা প্রচলন- এসবই তার শাসনকালের ইতিবাচক দিক। নেতিবাচক দিক- দুর্ভিক্ষ, রাজনৈতিক হত্যা ও একদলীয় শাসনের প্রবর্তন। দুর্ভিক্ষ ঘটার পশ্চাতে মার্কিন পরাশক্তির ভূমিকা আজ কারও অবিদিত নয়। ক্ষমতাসীন দলের বহু কর্মী ও বহু মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়েছিল- কোথাও স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে, কোথাও আত্মগোপনকারী বিপ্লবী রাজনীতিকদের হাতে। সিরাজ শিকদার হত্যাও বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে এক শোচনীয় ঘটনা, যদিও সিরাজ শিকদারের হাতেও বহু রক্তের দাগ ছিল। একদলীয় শাসনের যেসব লক্ষ তিনি স্থির করেছিলেন, তার মধ্যে ভালো জিনিস ছিল না, তা নয়; কিন্তু একদলীয় শাসন অনিবার্যভাবে গণতন্ত্রের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। সেদিন যারা বৈপ্লবিক রাজনীতি বা যারা বৈজ্ঞানিক রাজনীতি করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর পর তাদের ভূমিকা লক্ষ করলে স্বাধীনতার পরবর্তী সাড়ে তিন বছরে তাদের রাজনীতি বোঝাও কঠিন হয়ে পড়ে।
তবু ক্ষমতাসীন বঙ্গবন্ধু অনেকখানি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন এবং সে সময়েই তার ওপর হানা হল চরম আঘাত। যারা আঘাত হানল, তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত কারণে ক্ষুব্ধ সামরিক কর্মকর্তা ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ছিল। উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক সহকর্মী ও সামরিক কর্মকর্তা ছিল, দেশের বাইরে থেকেও উস্কানি ছিল। কিন্তু শোচনীয়তা সত্ত্বেও এ মৃত্যু তাকে গৌরবদানই করেছিল। নিজের নিরাপত্তার জন্য সামান্যতম উদ্বেগ তার ছিল না, সতর্ক করে দেয়া সত্ত্বেও তিনি কর্ণপাত করেননি, উপযুক্ত ব্যবস্থা নেননি। ঘাতক দলের মুখোমুখি হতেও বিলম্ব করেননি তিনি- ‘পৃষ্ঠে নাহি অস্ত্রলেখা’।
তার রক্তে কি উর্বর হয়েছে দেশের মাটি? তাকে এত ভয়- ঢাকায় তাকে সমাধিস্থ করা হয়নি, তার বিরুদ্ধে মনগড়া অভিযোগেরও অন্ত নেই। এমনকি, তিনি যে স্বাধীনতা চাননি বাংলাদেশের এ কথাই প্রতিপন্ন করতে ব্যস্ত তার প্রতিপক্ষরা। এ বড় বিচিত্র ব্যাপার। কেন এত ভয় তাকে? তার কারণ বাঙালির চিত্তে তার আসন স্থায়ী। বাংলাদেশ থাকলে মুজিবকে ভোলা কঠিন, ভুলিয়ে দেয়া কঠিন।
বঙ্গবন্ধু হত্যা এদেশের ইতিহাসের নির্মমতম অন্যায় রচনা করেছে। আইন করে আইনের হাত থেকে বাঁচতে হয়েছে ঘাতকদের। নিহত হয়েও বেঁচে আছেন বঙ্গবন্ধু, চিরদিন বেঁচে থাকবেন। বাঙালির শক্তি ও দুর্বলতা, বাস্তববুদ্ধি ও ভাবপ্রবণতা, সাহস ও পরিণামচিন্তাহীনতা, মৃত্তিকাসংলগ্নতা ও কল্পনাপ্রিয়তা- এসবেরই একটা সমন্বয় দেখেছি তার মধ্যে। এ অর্থেও দেশের মানুষের থেকে তিনি অবিচ্ছেদ্য।