করোনায় বিশ্বব্যাপী প্রাণহানি ৬৫০০
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১১:১৪ এএম, ১৬ মার্চ ২০২০ সোমবার
করোনার থাবায় বিশ্বব্যাপী থমকে গেছে জনজীবন- সংগৃহীত
প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসে বিচ্ছিন্ন বিশ্ব যোগাযোগ ব্যবস্থা। একের পর এক ভেঙে খান খান গ্লোবান কনসেপ্ট। চীন থেকে ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইরান, জার্মানি থেকে স্পেন পর্যন্ত করোনার থাবায় থমকে গেছে জনজীবন।
হাজারো প্রচেষ্টার পরও আটকানো যাচ্ছে না মৃত্যুর সংখ্যা। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক বিপর্যয় তো আছেই। বিশ্বজুড়ে মহামারি আকার ধারণ করা ভাইরাসটি উৎপত্তিস্থল চীনে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসলেও মৃত্যুকূপে পরিণত ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য।
গত ২৪ ঘণ্টায় ভাইরাসটিতে বিশ্বব্যাপী নতুন করে ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা চলতি মাসে একদিনে সর্বোচ্চ। এ নিয়ে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারালেন ৬ হাজার ৫ শত মানুষ। এর মধ্যে চীনে মারা গেছেন ৩ হাজার ২১৩ জন। ক্রমাগত স্বাভাবিকতায় ফিরে আসার অপেক্ষায় দেশটির নাগরিকরা।
উল্টোচিত্র চীনের বাহিরের দেশগুলোতে। বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অবস্থা উদ্বেগজনক। ইতালি ও ইরানের অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। দেশ দুটিতে প্রতিনিয়ত লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। এমন অবস্থায় ইউরোপকে পৃথকভাবে ‘মহামারির আশ্রয়কেন্দ্র’ বলে অভিহিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের বরাত দিয়ে আজ সোমবার দ্য সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানিয়েছে, বিশ্বের ১৩২টি দেশে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতি ভাইরাসটিতে গত ২৪ ঘণ্টায় ইতালিতে নতুন করে মারা গেছেন ৩৬৮ জন। যা অতীতের সকল রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে ইউরোপের এই দেশটি। এ নিয়ে সেখানে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১ হাজার ৮০৯ জনে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে কয়েকগুণ বেড়েছে আক্রান্তের হার। গত ২৪ ঘণ্টায় প্রথমবারের মতো একদিনে ১৪ হাজার মানুষ আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যা ডিসেম্বরে শুরু হওয়ার পর থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক। এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী এখন পর্যন্ত ২ লাখ ৪৪ হাজারেরও বেশি মানুষ ভাইরাসটির সংক্রমণ বহন করেছেন।
আক্রান্ত এসব ব্যক্তিদের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন সাড়ে ৬ হাজারের বেশি মানুষ। বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৬৭ হাজার। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন প্রায় ৭৭ হাজার।
বর্তমানে ভাইরাসটির সবচেয়ে ভয়বহতা দেখছে ইতালি। নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষেধক না থাকায় দেশিয় কিছু সম্ভাব্য প্রতিষেধক দেশব্যাপী ছড়ালে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। মৃতের চেয়ে কয়েকগুণ লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। দেশটিতে প্রাণহানির ঘটনার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী গিসেপে কন্তের নির্দেশে ৬ কোটিরও বেশি মানুষকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে দেড় লাখ বাংলাদেশিও রয়েছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যগুলো জানিয়েছে।
পুরো দেশজুড়েই ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এর আগে দেশটির ১৪টি প্রদেশে ৮ মার্চ থেকে আগামী ৩ এপ্রিল পর্যন্ত জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। কিন্তু এখন তা বাড়িয়ে দেশটির ২০টি প্রদেশের সবগুলোতেই জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, খেলাধুলা, জিমনেশিয়াম, জাদুঘর, নাইটক্লাব, সিনেমা, মসজিদ এবং পর্যটন কেন্দ্রগুলো।
এমন অবস্থায় দেশটিতে বাড়ছে বেকারের সংখ্যা। প্রাণঘাতি ভাইরাসটির প্রকোপে থমকে আছে পুরো ইতালি। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি চরম হুমকির মধ্যে পড়েছে। কোনো পর্যটক দেশটিতে প্রবেশ করতে পারছেন না। সরকারের কঠোর নির্দেশনা, অতি প্রয়োজন ছাড়া কেউ যেন ঘর থেকে বাইরে বের না হয়। জনমানবশূন্য রাজধানী রোমসহ অন্যান্য জনবহুল শহরগুলো।
ভয়বাহ এমন পরিস্থিতি ইউরোপের অন্যান্য দেশেও। যুক্তরাজ্য থেকে শুরু করে স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, জার্মানিসহ অন্যান্য দেশগুলোয় দ্রুত সংক্রমণ বিস্তার করায় ইউরোপকে ‘মহামারির কেন্দ্রস্থল’ হিসেবে ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। যেখানে লন্ডনে ২ বাংলাদেশির মৃত্যুর পাশাপাশি স্পেনে ৮ বাংলাদেশি এ মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন।
থেমে নেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানও। ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক দেশটিতে গত ২৪ ঘণ্টায় শতকেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। যেখানে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৭২৪ জন। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৯৩৮ জনে।
এরপরই আক্রান্ত হওয়ার দিক থেকে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। তবে সেখানে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে করোনা। এখন পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইনের দেশে প্রায় ৮ হাজার ২৩৬ জন আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে মারা গেছেন ৭৫ জন।
এরপরই রয়েছে ইউরোপের আরেক দেশ স্পেন। দেশটিতে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। সেখানে প্রথমবারের মতো একদিনে নতুন করে ১০৫ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত প্রাণ গেছে ২৮৮ জনের। বর্তমানে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন প্রায় ৮ হাজার মানুষ।
পিছিয়ে নেই ফ্রান্সও। ইউরোপের এই দেশটিতে এখন পর্যন্ত ১২৭ জনের প্রাণ গেছে। আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন আরও সাড়ে ৫ হাজার নাগরিক। আর ট্রাম্পের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজার ৭শ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৬৮ জন।
এদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে করোনার প্রকোপ এখনো নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে যেকোনো সময় তা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে জনবহুল দেশ ভারত।
১৩৪ কোটি মানুষের দেশটিতে এখন পর্যন্ত ১০৭ জনের দেহে প্রাণঘাতি ভাইরাসটির সংক্রমণের সন্ধান মিলেছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ২ জন। অন্যদিকে পাকিস্তানে এখন পর্যন্ত ২০ জনের শরীরের করোনা শনাক্ত করেছে দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ। এর মধ্যে একজন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
তবে ঝুঁকি থাকলেও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, নেপাল ও আফগানিস্তানে সেভাবে ছড়িয়ে পড়েনি ভাইরাসটি। এসবের মধ্যে শ্রীলংকায় দু’জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
আর বাংলাদেশে গত সপ্তাহে ইতালিফেরত ২ জন ও তাদের একজনের স্ত্রী আক্রান্ত হলেও পরে সুস্থ হওয়ায় তাদের করোনা মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। তবে চলতি সপ্তাহে ইতালি ও জার্মানফেরত দুইজনের শরীরের ভাইরাসটির সংক্রমণ ধরা পড়েছে।
এছাড়া, ইতালি, জার্মান, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আসাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সাড়ে ৩ হাজারের বেশি প্রবাসী বাংলাদেশিকে রাজধানীর আশকোনা হজ্ব ক্যাম্পসহ নিজ নিজ হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।
চলমান পরিস্থিতিতে করোনার মোকাবেলায় সার্কভুক্ত দেশগুলোর প্রধানমন্ত্রীরা গতকাল রোববার এক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার কথা জানান। যেখানে জরুরী সার্ক তহবিল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে ভারত।
আর চলমান সঙ্কট নিরসনে সার্ক দেশগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা এবং ঘনিষ্ঠ সমন্বয় দরকার বলে মন্তব্য করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমাদের বিশেষজ্ঞ অভিজ্ঞতা শেয়ার করা দরকার। প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ রসদ সরবরাহ করতে পারে।’
বিশ্বব্যাপী মহামারি আকার ধারণ করোনা ভাইরাসের প্রকোপে গোটা বিশ্বই এখন কার্যত অচল। মুখ থুবড়ে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। চলমান এ পরিস্থিতি উত্তরণে প্রতিষেধক তৈরির বিকল্প নেই বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
সে আলোকে এবার সুখবর দিয়েছে ব্রিটেন। দেশটির বিজ্ঞানীদের একটি দল জানিয়েছে যে, করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন (টিকা) তৈরি করেছেন তারা। যা আজ পরীক্ষা চালানো হবে। সফল হলে দ্রুত তা বিশ্বব্যাপী আক্রান্ত দেশগুলোতে প্রয়োগ করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানান, সফল হলে এ ভ্যাকসিন বাজারে আসতে এক থেকে দেড় বছর সময় লাগতে পারে।
এআই/এমএস/