এক করোনা-ই বিশ্বকে ক্ষতির মুখে ফেলেছে
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৩:৫৮ পিএম, ১৬ মার্চ ২০২০ সোমবার
বিশ্বের অন্তত ১৩২টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস। যার প্রভাব ইতোমধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে। অর্থনীতিতে এ ভাইরাসের প্রভাব ঠিক কতটা বিস্তার করবে তা নির্ভর করছে ভাইরাসটি চীনসহ পুরো পৃথিবীতে কতটা সংক্রমণ ছড়ায় এবং তা কতটা দীর্ঘ হয় তার ওপর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) কোভিড-১৯কে মহামারি ঘোষণা করেছে।
গেল বছরের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে উৎপত্তি হওয়া এই ভাইরাস এখন সারা বিশ্বের আতঙ্ক। এর প্রাদুর্ভাব এখন ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছে। মহামারি ঠেকাতে নানা দেশ নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। কোয়ারেন্টিন–সংশ্লিষ্ট পদক্ষেপ হিসেবে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী বাতিল হয়েছে হাজার হাজার আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। লাখ লাখ কোটি টাকার লোকসান। বিভিন্ন দেশের শেয়ার ও তেলের বাজারে ধস নেমেছে। বছর শেষে প্রবৃদ্ধির হার কত কমবে, তাই নিয়ে এখনই শুরু হয়ে গেছে হিসাব–নিকাশ। সব মিলিয়ে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে বিশ্ব।
করোনার প্রভাব ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের বড় মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-রেল সংযোগ, কর্ণফুলী টানেল ছাড়াও প্লাস্টিক খাত, ওষুধ শিল্প ও খুচরা যন্ত্রপাতির বাজারে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বৃহৎ আকারে। শুধু চীন থেকেই বছরে প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি ডলার পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। কিন্তু করোনায় রুখে গেছে সে বাণিজ্য-সম্পর্ক। যা দেশের অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘চীনাদের কারিগরি সহযোগিতায় আমাদের বড় প্রকল্পগুলো হচ্ছে। তাদের অবাধ চলাফেরা না করতে পারা ও ছুটিতে থাকার কারণে প্রকল্পের কাজ বাধাগ্রস্ত হবে এটাই স্বাভাবিক।’
পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের কোনও সম্ভবনা আছে কী-না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা একটা বদ্ধমূল ধারণা। কোনও দেশের রফতানি সাময়িক দুই-তিন মাসের ওপর নির্ভর করে না। সাময়িক সময়ের জন্য কাজ পেলেও দীর্ঘ সময়ে কাজ পাবে বিষয়টা অবান্তর।‘
তিনি বলেন, ‘একটা দেশের শিল্প কারখানা অন্য দেশের কাঁচামালের ওপর নির্ভর করে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ যারা চাইনিজ মেশিন, কাঁচামালের উপর নির্ভরশীল ছিল তাদেরকে নতুন করে বাজার খুঁজতে হবে, যদি এটা (করোনা ভাইরাস) দীর্ঘ মেয়াদী হয়। এই সময়ের মধ্যে অনেক দেশের শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। যার ফলে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। এয়ারলাইন্সের ব্যবসাও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।’
সম্প্রতি ব্লুমবার্গের অর্থনীতিবিদেরা করোনার সংক্রমণকে চারটি পর্যায়ে বিশ্লেষণ করে পূর্বাভাস দিয়েছেন। যদিও এই ভাইরাসের অনেক কিছুই এখনও মানুষের অজানা। সেই সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সরকার পদক্ষেপ ও ব্যবসায়িক প্রতিক্রিয়া দেখে এখনই চূড়ান্ত উপসংহারে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে এই চার পর্যায়ের মাধ্যমে বলা যায়, কিসের মুখে পড়তে যাচ্ছে বিশ্ব।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে, চীনে কী হচ্ছে। গত তিন–চার মাসে দেশটির অটোমোবাইল শিল্পে ব্যাপক ধস নেমেছে। গাড়ি বিক্রি কমে গেছে প্রায় ৮০ শতাংশ। যেসব পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হচ্ছে, তাতে সর্বকালের সর্বনিম্ন অবস্থানই নির্দেশ করছে। অর্থনৈতিক কার্যকলাপ কার্যত বন্ধই হয়ে গেছে। ব্লুমবার্গের অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার গত বছরের তুলনায় এ বছর ১ দশমিক ২ শতাংশ কমে যাবে, যা কিনা রেকর্ড। যদি চীন এই মার্চের মধ্যে ঘুরে দাঁড়াতে না পারে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। সেই ধারণা মাথায় নিয়েই এই চার ধাপের বিশ্লেষণ করেছেন তাঁরা।
খুব দ্রুত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে চীন। তাহলে বছর শেষে কোন অবস্থানে দাঁড়াবে বিশ্ব। ২০১৯ সালে ২ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলারের আমদানি করে চীন। চীনের মানুষ যখন ঘরবন্দী হয়, তখন ক্ষতির পরিমাণটা যে বড়ই হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বের সব দেশের পর্যটন খাতই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। করোনাভাইরাসের কারণে চীনের অসংখ্য কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। চীন দ্রুত প্রকোপটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে আবার প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে চীন। বিশ্বব্যাপী বাকি অর্থনীতিগুলোতেও যা প্রভাব ফেলবে। এভাবে চললে প্রথমার্ধের ক্ষতি দ্বিতীয়ার্ধেই কিছুটা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে। ফলে বছর শেষে বিশ্বে এর প্রভাব তেমন দেখা যাবে না।
এখন প্রশ্ন, কী ঘটবে যদি প্রাদুর্ভাব বাড়ে। দ্বিতীয় পরিস্থিতিতে ব্লুমবার্গের অর্থনীতিবিদেরা ধরে নিচ্ছেন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে চীনের আরও অনেক সময় লাগল। পুনরুদ্ধার সরাসরি ‘ভি’ শেপের না হয়ে ‘ইউ’ শেপের হলো। অর্থাৎ আস্তে আসতে পুনরুদ্ধার। মেড ইন চায়না ডটকমের ব্যবস্থাপক লি লেই বলেন, সব কারখানা উৎপাদনে ফিরলেও সব সমস্যার সমাধান হবে না। অনেক কারখানায় পর্যাপ্ত পরিমাণ রসদ নেই...সরবরাহ শৃঙ্খলে বাধা উৎপাদনক্ষমতা। চীন ছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি, জাপান, ফ্রান্স ও জার্মানিতে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। ফলে বছর শেষে বিশ্ব প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে, যা আগে ৩ দশমিক ১ শতাংশ হবে বলে আশা করা হচ্ছিল।
করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর প্রভাব পড়ছে অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে। সবচেয়ে বড় সংকট উৎপাদন খাতে। সংকট তৈরি হয়েছে সাপ্লাই চেইন সরবরাহ ব্যবস্থাতেও। আর এখন বড় সংকট চলছে আকাশপথে। ভাইরাসের আতঙ্কে মাটিতে নেমে এসেছে এয়ারলাইনস বা এভিয়েশন শিল্প খাত। কেননা, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী অসংখ্য মানুষ ভ্রমণ স্থগিত রেখেছে। পর্যটন খাত বড় ধরনের বিপদে আছে। মানুষ সফর কম করছে বলে অনেক এয়ারলাইনস এখন আর আকাশে উড়ছে না। চীনের মানুষ বলতে গেলে ঘরেই বসে আছে। অন্যরাও বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হচ্ছেন না।
করোনাভাইরাস দ্রুত কীভাবে ছড়াচ্ছে? মূলত এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে বিমান চলাচল। এ কারণে অনেক দেশই চীনে ফ্লাইট পরিচালনা করছে না। ফলে চীনের মতো একটি বড় দেশেরে আশপাশে থাকা ছোট ছোট অর্থনীতির দেশ সংকটে পড়ে আছে বেশি। এর মধ্যে পাশের অর্থনীতি হংকং ও তাইওয়ান সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে। আবার একই অঞ্চলের বড় অর্থনীতির দেশ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থাও ভালো নয়। তাদের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ ফ্লাইট বন্ধ হয়ে আছে। আবার দূরের দেশগুলোর মধ্যে কানাডা তাদের ফ্লাইট বন্ধ রেখেছে ৫৮ শতাংশ এবং রাশিয়া ৬৭ শতাংশ।
এমএস/এসি