বাড়ছে নেট মিটারিং রুফটপ সোলার এনার্জি ব্যবহারকারী
মেহেদী হাসান আলবাকার
প্রকাশিত : ১২:৪৬ পিএম, ১৭ মার্চ ২০২০ মঙ্গলবার
নেটিং মিটারিং সুবিধার পর গেল সাড়ে দশ মাসের ব্যবধানে রুফটপ সোলার এনার্জি ব্যবহারকারী বেড়েছে ৬৯১ শতাংশ, বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে ২২৬ শতাংশ। জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের তুলনায় নেট মিটারিং’এ রুফটপ সোলার এনার্জির খরচ এখন কম হওয়াই এর কারণ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে মোট ব্যবহারকারীর মধ্যে গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল খাতের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এখনও খুব বেশি নয়। এখাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, স্বল্প সুদে ঋণ না পাওয়া এবং সৌর প্যানেলসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম দিনকে দিন কমে আসায় এখনও অনেকেই অপেক্ষা করছেন।
সাইসটেইনেবল এন্ড রিনিউএবল এনার্জি ডেভলপমেন্ট অথরিটি- এসআরইডিএ’র জাতীয় নবায়নযোগ্য জ্বালানি ডাটাবেইজ বলছে, চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত নেট মিটারিং সুবিধায় রুফটপ সোলার সিস্টেম ব্যবহারকারী গ্রাহকের সংখ্যা ৭৯৯, তবে এর মধ্যে গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল খাতের প্রতিষ্ঠান আছে মাত্র ৯৬টি। সব মিলিয়ে মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১২ দশমিক ৪৫ মেগাওয়াট।
গেল ৭ এপ্রিল পর্যন্ত এ ব্যবস্থায় রুফটপ সোলার এনার্জি ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১০১, উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৩ দশমিক ৮১ মেগাওয়াট।
সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ বলছে, রুফটপ সোলারে কোন জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হয় না, আর নেট মিটারিং সুবিধা ব্যবহার করলে কোন স্টোরেজ ফ্যাসালিটিজ প্রয়োজন হয় না। ফলে খরচ অনেক কম।
এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শাহরিয়ার আমেদ চৌধুরী বলেন, ‘এক বছর আগেও নেট মিটারিং সুবিধায় রুফটপ সোলার এনার্জি ব্যবহারে ইউনিট প্রতি খরচ পড়ত ৭ টাকা, এখন সেটি ৬ টাকায় নেমে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মাত্র দেড় বছর হল আমরা নেট মিটারিং গাইড লাইন করেছি, এর মধ্যে সাড়া একেবারে কম নয়। বর্তমানে শিল্প কারখানায় গ্রিডের বিদ্যুৎ ব্যবহারে ইউনিট প্রতি ব্যয় সাড়ে ৮ টাকা। ফলে আগামী দু’এক বছরের মধ্যে দেখবেন সব প্রতিষ্ঠানই এ সুবিধার আওতায় চলে এসেছে।’
নেট মিটারিং :
নেট মিটারিং সুবিধার আওতায় গ্রাহক বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার সংযোগের পাশাপাশি সৌরশক্তিসহ নবায়ণযোগ্য উৎস হতে নিজেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। নিজের উৎপাদিত বিদ্যুত ব্যবহারের পর বাড়তি থাকলে সেটি জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করবেন, আর চাহিদার চেয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন কম হলে গ্রিড থেকে নিয়ে সেটি মেটাবেন। মিটার বিদ্যুতের ক্রয় ও বিক্রয় দুই হিসাবই রাখবে। গ্রাহক বিদ্যুৎ বিক্রয়ের চেয়ে ক্রয় বেশি করলে অতিরিক্ত বিদ্যুতের বিল দিতে হবে বিতরণ কোম্পানিকে। অন্যদিকে ক্রয়ের চেয়ে বিক্রয় বেশি হলে বছর শেষে সেই মূল্য বিদ্যুতের পাইকারি দরে পরিষোধ করবে সংশ্লিষ্ট বিতরণ কোম্পানি।
কেন নেট মিটারিং :
সোলার হোম সিস্টেম খুব দ্রুত জনপ্রিয় হলেও শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে এর ব্যবহার ছিল খুব কম। কারণ শিল্প কারখানার নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়, সোলার প্যানেলের বিদ্যুৎ নিরবিচ্ছিন্ন নয়, পাশাপাশি কারখানা যখন বন্ধ থাকে তখন সৌর প্যানেলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ অপচয় হয়। ফলে শিল্প উদ্যোক্তাদের নবায়ণযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার উৎসাহিত করতে ২০১৮ সালে নেট মিটারিং গাইডলাইন প্রণয়ন করে সরকার। ঐবছর জুলাই থেকে নেট মিটারের সংযোগ দিতে শুরু করে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো। এরপর থেকে প্রতিনিয়তই বাড়ছে এর ব্যবহারকারী।
তবে মোট ব্যবহাকারীর মাধ্যে তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল খাত পিছিয়ে থাকলেও উৎপাদন ক্ষমতা বিবেচনায় এ ধরণের শীর্ষ ২০ প্রকল্পের ১১টিই এ খাত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। সবচেয়ে বড় প্রকল্পটি নারায়গঞ্জের আড়াইহাজারের এস এফ টেক্সটাইলের, তাদের উৎপাদন ক্ষমতা ১ দশমিক ৭৭ মেগাওয়াট।
দ্বিতীয় বড় প্রকল্পটি হবিগঞ্জের ফারইস্ট স্পিনিং এর, তাদের উৎপাদন ক্ষমতা ১ দশমিক ১ মেগাওয়াট, যেখানে অর্থায়ন করেছে ইনফ্রাসট্রাক্চার ডেভলপমেন্ট কোম্পানি লিঃ-আইডিসিওএল।
প্রতিষ্ঠানটির মোট বিদ্যুতের চাহিদা ২ দশমিক ৫ মেগাওয়াট। সারা বছরের হিসাবে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে চারঘণ্টা সৌরশক্তি ব্যবহার করেন তারা। আর তাতেই মাসে নয় থেকে সাড়ে ৯ লাখ টাকা পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিল সাশ্রয় হচ্ছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আসিফ মইন।
আইডিসিওএল দশ বছর মেয়াদে মাত্র ছয় শতাংশ সুদে এখানে অর্থায়ন করছে। প্রকল্পের ৮০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থায়ন করে তারা। তবে ২০০ কিলোওয়াটের নিচে কোনো প্রকল্পে এ প্রতিষ্ঠান অর্থায়ন করছে না। কিন্তু নেট মিটারিং এর আওতায় চালু এ ধরনের বড় প্রকল্প আছে এখন পর্যন্ত মাত্র আটটি, যার মাধ্যে চারটিতে অর্থায়ন করেছে আইডিসিওএল। এ পর্যন্ত মোট ১৯টি প্রকল্পে তারা অর্থায়ন করেছে। আরও ১০টি প্রকল্পে অর্থায়নের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে এবং ৩০টি আবেদন তাদের কাছে জমা আছে। আইডিসিওএল বলছে, ‘এর চাইতে ছোট প্রকল্পে অর্থায়ন তাদের জন্য লাভজনক নয়।’
তবে সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চের তথ্য বলছে, দুইশ কিলোওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার সোলার প্যানেল বসাতে কমপক্ষে ২০০০ বর্গফুট যায়গা প্রয়োজন। কিন্তু দেশের অধিকাংশ গার্মেন্টস কারখানারই এত বড় ব্যবহার উপযোগী ছাদ নেই বলে জানান বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম। এজন্য আইডিসিওএল’র পক্ষে সম্ভব না হলে অন্য যে উৎস থেকেই হোক স্বল্পসুদে সরকারকে অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে, যোগ করেন তিনি।
এদিকে নিয়মিতই কমছে সোলার এনার্জির খরচ। ফার-ইস্ট স্পিনিং এর প্রকল্পটি চালু হয়েছে ২০১৮’র অক্টোবরে, তাদের ওয়াট প্রতি ইন্সটলেশন খরচ ছিল ৭৮ টাকা। আর সম্প্রতি স্কয়ার টেক্সটাইলের দুই দশমিক ছয় মেগাওয়াট প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে আইডিসিওএল, যেখানে ওয়াট প্রতি ব্যয় ৬৯ টাকা।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্য বলছে ২০১০ থেকে ২০১৮ সময়ের ব্যবধানে ভারতে সোলার এনার্জি ইন্সটলেশনের খরচ কমেছে ৮৪ শতাংশ। আর যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এ ব্যায় কমেছে ৬৬ শতাংশ। ২০৩০ সাল নাগাদ এ খরচ আরও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমবে। ফলে সৌর শক্তিই হয়ে উঠবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, ‘এক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকতে চায়না তৈরি পোশাক খাতও। কিন্তু স্বল্পসুদে ঋণ অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই পাচ্ছে না। ফলে বাড়তি সুদে ঋণ নিয়ে এমন প্রকল্প করতে অনেকেই উৎসাহী হচ্ছেনা।’
পাশাপাশি কারখানার ছাদের কত ভাগ ফাঁকা রাখতে হবে, এ বিষয়ে কমপ্লায়েন্স গাইডলাইনে খানিকটা অস্পষ্টতা রয়েছে। তাই অনেকেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন- যোগ করেন তিনি।
তবে সোলার হোম সিস্টেমের মতো, নেট মিটারিং রুফটপ সোলার এনার্জিও জনপ্রিয় হবে এ ব্যাপারে একমত সবাই।
এআই/