ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

করোনার ভয়াবহতা বর্ণনা করে ইতালির চিকিৎসকের করুণ আর্তনাদ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০১:০৩ পিএম, ১৮ মার্চ ২০২০ বুধবার | আপডেট: ০১:০৯ পিএম, ১৮ মার্চ ২০২০ বুধবার

প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসে ইতালিতে গত ২৪ ঘন্টায় নতুন করে আরও ৩৪৫ জন মারা গেছেন। দেশটিতে এ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ২ হাজার ৫০৩ জনে। দেশটিতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত মারা যাওয়া লোকের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি উত্তরাঞ্চলীয় শহর লম্বার্ডিয়ায়। অঞ্চলটি এখন এখন মৃত্যুপুরী। স্বজনদের শেষ শ্রদ্ধা জানাতে কবরস্থানগুলোতেও মানুষ প্রবেশ করতে পারছেন না।

এদিকে, মিলানে মারা যাওয়া মানুষের লাশ আর লাশ, মর্গেও জায়গা নেই। ঠিক এমনই সময় ইতালীয় এক চিকিৎসক করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হৃদয়বিদারক বর্ণনা দিলেন।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ইন্ডিপেন্ডেন্টের খবরে বলা হয়, ইতালির গাভাটেসনি হাসপাতালর চিকিৎসক ড. ড্যানিয়েল ম্যাককিনি তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি পোস্ট দেন। মুহূর্তেই ভাইরাল হওয়া এ পোস্টে করোনাভাইরাস চিকিৎসায় তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন তিনি।

ড. ড্যানিয়েল ম্যাককিনি লিখেছেন-

‘আমাদের দেশে এখন ভয়াবহ এক ট্রাজেডি ঘটে চলছে। বৃদ্ধ রোগীরা মারা যাওয়ার আগে চোখের পানি ফেলছেন। কাছের মানুষদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাওয়ার সৌভাগ্যও তাদের নেই। তারা একা একা মরতে চাননি। কিন্তু তাদের ক্যামেরাকে বিদায় জানাতে হচ্ছে। তারা সজ্ঞানে, সমস্ত কষ্টকে সহ্য করতে করতে মরে যাচ্ছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বামী ও স্ত্রী একই দিনে মারা যাচ্ছেন। বৃদ্ধ দাদা-দাদী, নানা-নানীর তাদের নাতিদের মুখ শেষবারের মতোও দেখতে পাচ্ছেন না।’

তিনি লেখেন, ‘এই রোগ ফ্লুর চাইতেও ভয়াবহ। বিশ্বাস করুন, ফ্লুর চাইতে অনেক ভিন্ন রকমের অসুখ এটি। এই রোগকে দয়া করে বাজে ফ্লু বলবেন না।’

আক্রান্ত রোগীদের অবস্থার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে ম্যাককিনি লেখেন, ‘জ্বর অসম্ভব বেশি। রোগীর দম এমনভাবে বন্ধ হয়ে আসতে চায় যেন সে ডুবে যাচ্ছে। রোগীরা হাসপাতালে আসতে চায় না। শুধু একটু অক্সিজেন পাওয়ার জন্য তারা বাধ্য হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।’

আক্রান্তদের চিকিৎসা কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি লেখেন, ‘এই রোগের বিরুদ্ধে খুব সামান্য কিছু ওষুধ কাজ করে। আমরা সাহায্য করার সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু সবকিছুই নির্ভর করছে রোগীর অবস্থার ওপর। বৃদ্ধ রোগীরা এই রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে পেরে উঠছেন না। আমরা কাঁদছি। আমাদের নার্সরা কাঁদছে। সবাইকে বাঁচিয়ে তোলার সামর্থ্য আমাদের নেই।’

তিনি আরও লেখেন, ‘প্রতিদিন চোখের সামনে মেশিনে তাদের জীবন থেমে যেতে দেখছি। প্রচুর রোগী আসছে। অতি দ্রুত আমাদের আরও বেড প্রয়োজন হবে। সবার একই সমস্যা। সাধারণ নিউমোনিয়া। প্রচণ্ড শক্তিশালী নিউমোনিয়া।’

প্রশ্ন রেখে ইতালীয় এই চিকিৎসক লেখেন, ‘আমাকে বলুন কোন ফ্লু এই ট্রাজেডির জন্ম দেয়?’

তিনি লেখেন, ‘এটা অত্যন্ত সংক্রামক। এই ভাইরাসটি একেবারেই অন্যরকম। কোনো কোনো মানুষের জন্য ভয়ংকর। আমাদের দেশে ৬৫ ঊর্ধ্ব মানুষের প্রায় প্রত্যেকের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিংবা কোনো না কোনো রোগ রয়েছে। কোনো কোনো তরুণদের জন্যও এই রোগ ভয়ংকর।’

তিনি আরও লেখেন, ‘এইসব তরুণ রোগীদের দেখলে কোনো তরুণই নিজেকে নিয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করতে পারবে না। আমাদের হাসপাতালে কোনো সার্জারি আর হচ্ছে না। বাচ্চাদের জন্ম, চোখের অপারেশন, কিংবা ত্বকের চিকিৎসা। সার্জারি রুমগুলো ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রূপান্তর করা হয়েছে।’

ইতালীর ভয়াবহ অবস্থার কথা বর্ণনা করে ড্যানিয়েল ম্যাককিনি লিখেন, ‘করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সবাই যুদ্ধ করছি। প্রতি ঘণ্টায় রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলছে। টেস্ট রেজাল্ট ক্রমাগত হাতে আসছে। সব পজিটিভ। পজিটিভ। পজিটিভ!’

তিনি লেখেন, ‘সব রোগীর একরকমের অভিযোগ; অসম্ভব জ্বর। শ্বাসকষ্ট। কাশি। পানিতে ডুবে যাওয়ার মতো দমবন্ধ হওয়ার অনুভূতি। প্রায় সবাই ইনটেনসিভ কেয়ারে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কেউ কেউ অক্সিজেন মাস্কের নিচেও শ্বাস নিতে পারছেন না। অক্সিজেন মেশিন এখন সোনার চাইতেও দামি। বিশ্বাস করতে পারছি না, কি দ্রুত এসব ঘটে গেল! আমরা সবাই ক্লান্ত।’

নিজেদের নিরলস পরিশ্রমের কথা বর্ণনা করে এ চিকিৎসক লেখেন, ‘কিন্তু কেউ থামতে চাইছি না। সবাই মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করে চলছি। ডাক্তাররা নার্সদের মতো অবিরাম কাজ করে চলছেন। দুই সপ্তাহ ধরে আমি বাসায় যাই না। আমার পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের জন্য আমি শংকিত। সন্তানদের সঙ্গে ক্যামেরা ব্যবহার করে কথা বলছি। মাঝে মাঝে আমি স্ত্রীর ছবির দিকে তাকিয়ে কাঁদি। আমাদের কারও কোনো দোষ নেই।’

তিনি লিখেন, ‘যারা আমাদের বলেছিল এই রোগটি তেমন ভয়ংকর নয়, সমস্ত দোষ তাদের। তারা বলেছিল এটি সাধারণ এক ধরনের ফ্লু। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আর এখন অনেক বেশি দেরি হয়ে গিয়েছে।’

জনসাধারণকে উপদেশ দিয়ে তিনি বলেন, ‘দয়া করে ঘরের বাইরে বের হবেন না। আমাদের কথা শুনুন। শুধুমাত্র ইমার্জেন্সি কারণ ছাড়া ঘর থেকে বের হবেন না। সাধারণ মাস্ক ব্যবহার করুন। প্রফেশনাল মাস্কগুলো আমাদের ব্যবহার করতে দিন। মাস্কের অভাবে আমাদের স্বাস্থ্যও ঝুঁকির মুখে। কোনো কোনো ডাক্তারও এখন আক্রান্ত। তাদের পরিবারের অনেকেই জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তাই নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করুন। বয়স্ক পরিবার পরিজনকে ঘরে থেকে বের হতে দেবেন না।‘

তিনি আরও লেখেন, ‘আমাদের পেশার কারণে আমরা ঘরে থাকতে পারছি না। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা আমাদের রোগীদের বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা নিজেদের শরীরে অসুখ ও ভগ্ন হৃদয় নিয়ে ঘরে ফিরছি। যাদের বাঁচাতে পারছি না তাদের শরীরের কষ্ট কমানোর চেষ্টা করছি। কাল সব ঠিক হয়ে গেলে আমাদের কথা সবাই ভুলে যাবে। ডাক্তারদের এইটাই পেশা। তাই মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

সবাইকে পুনরায় সাবধানে থাকতে বলে ইতালির এ চিকিৎসক লেখেন, ‘এই রোগ আপনাকে না ছুঁলেও সাবধানে থাকুন। জনসমাগম থেকে দূরে থাকুন। সিনেমায় যাবেন না, মিউজিয়ামে যাবেন না, খেলার মাঠে যাবেন না।’

বৃদ্ধদের প্রতি যত্ন নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি লেখেন, ‘দয়া করে বৃদ্ধ মানুষগুলোর দুঃখ অনুভব করার চেষ্টা করুন। তাদের জীবন আপনাদের হাতে এবং আপনারা আমাদের চাইতে বেশি মানুষের জীবন বাঁচাতে সক্ষম। আপনিই তাদের রক্ষা করতে পারেন।’

ড. ড্যানিয়েল ম্যাককিনি তার লেখাটি শেয়ার করার আহ্বান জানিয়ে লেখেন, ‘লেখাটি শেয়ার করুন। শেয়ার করুন যেন সমস্ত ইতালি এই চিঠিটি পড়তে পারে। সমস্ত কিছু শেষ হওয়ার আগেই যেন পড়তে পারে।’
এসএ/