দায়-দেনা শোধে এখনো সরকার নির্ভর বিজেএমসি
মেহেদী হাসান আলবাকার
প্রকাশিত : ০৫:১৭ পিএম, ২০ মার্চ ২০২০ শুক্রবার
মো. নজরুল ইসলাম, ৪০ বছর চাকরি করেছেন খুলনার প্লাটিনাম জুবলি জুটমিলে। ২০১৮’র আগষ্টে অবসরে গেছেন। প্রবিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচুইটি সব মিলিয়ে মিলের কাছে এখন তার পাওনা দশ লাখ টাকা। দেশ জুড়ে পাটকল শ্রমিকরা যখন তাদের বকেয়া বেতনসহ এগারদফা দাবিতে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন করছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি কখনো ঢাকায় বিজেএমসির প্রধান কার্যালয়ে আবার কখনো বা খুলনার মিল অফিসে ফাইল নিয়ে ধরনা দিচ্ছেন।
মুন্সিগঞ্জের গ্রামের বাড়ি থেকে প্রতি সপ্তাহে ঢাকা-খুলনা দৌঁড়-ঝাপ করতে গিয়ে এতোদিনে শেষ তার সব সঞ্চয়। এখন দুচোখে শুধুই অন্ধকার দেখছেন তিনি।
“পাওনা টাকাগুলো পেলে বাকি জীবনটা একটু স্বাচ্ছন্দে চলতে পারতাম, কিন্তু বেঁচে থাকতে এই টাকা আসলেই হাতে পাব কিনা আল্লাহই ভাল জানে,” বলছিলেন নজরুল ইসলাম।
বিজেএমসি বলছে, শুধু এমন একজন নজরুল ইসলামই নয়, ২০১৪’র জুনের পর থেকে যারাই অবসরে গেছেন তাদের সবার পাওনাই বকেয়া। গ্রাচ্যুটি ও প্রবিডেন্ট ফান্ড মিলিয়ে ২০১৯’র মার্চ পর্যন্ত এখাতে বকেয়া এক হাজার আট কোটি টাকা।
২০১৫ সাল থেকে কার্যকর হয়েছে নতুন মজুরি কাঠামো। কিন্তু বিজেএমসি এখনো পর্যন্ত বেতন দিয়েছে ২০১০ সালের মজুরি কাঠামোতেই। ফলে ২০১৯’র জুলাই পর্যন্ত কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারিদের বাড়তি পাওনা ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
কিন্তু এসব বকেয়া কোনটাই পরিশোধের সামর্থ্য নেই বিজেএমসির। তারা চেয়ে আছে সরকারের দিকে।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ( অর্থ) মো. তৌহিদ হাসনাত খান জানান, আমাদের হাতে এই মুহূর্তে কোন টাকা নেই। শ্রমিকদের মজুরি, গ্রাচ্যুইটি, প্রবিডেন্ট ফান্ডসহ যাবতীয় দেনার তথ্য আমরা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থমন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। অর্থ মন্ত্রণালয় টাকা ছাড় করলেই আমরা দেনা শোধ করতে পারবো।
এ ধরণের দায় দেনা পরিশোধে বিজেএমসিকে সবসময়ই সরকারের কাছে হাত পাততে হয়। কারণ স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৮১-৮২, ৮২-৮৩ এবং ২০১১-১২ অর্থ বছর ছাড়া আর কোনো অর্থবছরেই লাভের মুখ দেখেনি রাষ্ট্রায়ত্ব এই কর্পোরেশন। সবশেষ ২০১৮-১৯ অর্থ বছরেও তাদের লোকসান ছিল ৫৭৩ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৪৯৭ কোটি টাকা, অর্থাৎ লোকসান বেড়েছে ৭৬ কোটি টাকা।
এর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫৮১ কোটি টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬৫৭ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরেও ৭২৭ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে এ রাষ্ট্রায়ত্ব কর্পোরেশনকে।
ধারাবাহিক লোকসানের কারণে এক হাজার কোটি টাকার চলতি ঋণ এবং ৮ হাজার ৩৫৬ কোটি কোটি টাকা দীর্ঘমেয়াদি ঋণের বোঝা বইতে হচ্ছে বিজেএমসিকে। বিজেএমসি বলছে, এ ঋণের সুদ না দিতে হলেই ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৩ দশমিক ১ শতাংশ লোকসান কমতো।
জুট-ননজুট মিলিয়ে চালু ২৫ কারখানায় কর্মরত ৫৮ হাজার ৬৮৪ জন শ্রমিকের মধ্যে ৯ হাজার ১৭৭ জনই অতিরিক্ত, যারা কাজ করছেন অস্থায়ী ভিত্তিতে। এই অতিরিক্ত জনবল ছাইট করতে পারলে লোকসান আরও ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ কমানো যেত।
এ সময় মিলগুলোর চালু ৪ হাজার ১২৮টি তাতে ১ লাখ ১০ হাজার ৬৪১ মেট্রিক টন পণ্য উৎপাদন সম্ভব হলেও বাস্তবে উৎপাদন করা গেছে ৬৯ হাজার ১১১ মেট্রিক টন, সক্ষমতার সবটা ব্যবহার করতে পারলে লোকসান আরও ৫৮ দশমিক ৩ শতাংশ কমানো যেত। শ্রমিক অসন্তোষ না থাকলে লোকসান কমতো আরও ১১ দশমিক ৪৮ শতাংশ। বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও সিবিএর অপতৎপরতা না থাকলে লোকসান কমানো যেত যথাক্রমে ৪ দশমিক ৭৫ এবং দশমিক ৫৫ শতাংশ। আর সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, বিজেএমসি নিজেই যেখানে চলছে ধার দেনা করে, সেখানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সামাজিক দায়বদ্ধতা খাতে তারা ব্যয় করেছে ২২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা, যা মোট লোকসানের ৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
তবে শুধুমাত্র সময় মতো পাট কেনা, ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং পাটকে কৃষি ভিত্তিক শিল্প ঘোষণা করলেই এসব লোকসান থাকবে না বলে দাবি শ্রমিক নেতাদের। এজন্য পাট শিল্পকে স্বনির্ভর করতে এই তিন দাবির পাশাপাশি শ্রমিক-কর্মচারিদের বকেয়া বেতন, গ্রাচ্যুইটি-প্রবিডেন্ট ফান্ড বাবদ পাওনাসহ এগার দফা দাবিতে আন্দোলন করছেন তারা।
প্লাটিনাম জুবলি জুট মিলস শ্রমিক-কর্মচারি ইউনিয়নর সভাপতি শাহানা সারমিন বলেন, আমাদের আন্দোলন শুধুমাত্র শ্রমকিদের জন্য নয়, গোটা পাট শিল্পের স্বার্থে। দুই দফা আমরণ আনশনের পর সরকার আমাদের দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দেয়ার পর আমরা রাজপথ ছেড়েছি। কিন্তু সরকার কথা না রাখলে আমাদের আবার রাজপথেই ফিরে যেতে হবে।
এদিকে পাটকলগুলোর গুদামে মজুত আছে ৬০০ কোটি টাকার পাটজাত পণ্য। সুদান, ইরান, সিরিয়ার মতো বাজারগুলোতে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশি পাটজাত পণ্যের উপর ২০১৭ সাল থেকে ভারত এন্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে। পাশাপাশি ধাপে ধাপে ১৯ ধরণের পণ্য বাজারজাতকরণে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে ২০১০ সালে ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট করেছিল সরকার। কিন্তু এ আইনের বাস্তবায়নেও এখন নেই কোন গতি। ফলে উৎপাদিত পণ্য নিয়েও বিপাকে আছে বিজেএমসির।
তবে সানতনী প্রযুক্তিতে এ ধরণের প্রচলিত পণ্য উৎপাদন করে মুনাফা করতে পারবে এমনটা নিজেরাও মনে করছে না বিজেএমসি।
সংস্থাটির পরিচালক মো. আলী আহসান বলেন, এ জন্য পাটের সাথে তুলা মিশিয়ে কাপড়ে ব্যবহারোপযোগী সুতা উৎপদন, পাট থেকে পরিবেশ বান্ধব পলিব্যাগ তৈরি, পাট থেকে পোষাক উৎপাদনে ব্যবহৃত ভিসকচ উৎপাদনের মতো বহুমুখী পণ্য উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে বিজেএমসি। এসব পণ্য বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যেতে পারলেই বিজেএমসি ঘুরে দাঁড়াবে। তবে কবে নাগাদ এসব প্রকল্প বাণিজ্যিক উৎপাদনের যেতে পারবে তা নিশ্চিত করতে পারেনি তিনি।
তবে সম্পূর্ণ ভিন্নমত সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডির। বেসরকারি এ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, সনাতন প্রযুক্তি, অতিরিক্ত উৎপাদন ব্যয়, অদক্ষতা, দুর্নীতির পাশাপাশি যে পরিমানে দায় দেনার চাপে বিজেএমসি পড়েছে তাকে আর এভাবে বছর বছর টাকা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না।
প্রথমত, বিজেএমসিকে সংকুচিত করতে হবে, দ্বিতীয়ত মিলগুলোর অব্যবহৃত জমিতে বেজা বা অন্য কোন সংস্থার মাধ্যমে শিল্পায়নের ব্যবস্থা করতে হবে এবং তৃতীয়ত কিছু সম্পদ বিক্রি করে হলেও শ্রমিক-কর্মচারিদের বেতন-বোনাসসহ বিজেএমসির সব দায় দেনা একবারে মিটিয়ে দিতে হবে, বলছিলেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তবে বিজেএমসিকে গুটিয়ে ফেলা মানে পাট শিল্পকে গুটিয়ে ফেলা নয়, পাটের বিশ্ববাজারে এখনো অনেক সম্ভাবনা রয়েছে এবং সেটির বিকাশ হতে হবে বেসরকারি খাতের হাত ধরে, যোগ করেন তিনি।