তাদের দায়িত্ব নিলে বদলে যাবে সমাজ
আজাদুল ইসলাম আদনান
প্রকাশিত : ০৩:১৯ পিএম, ২১ মার্চ ২০২০ শনিবার
সারাদিন তারা কাগজ কুড়ায়। তারপর সন্ধ্যায় স্কুলে পড়তে আসে। এমন অনেক পথশিশু আছে যারা রাস্তায় পড়ে থেকেও স্বপ্ন বুনছে একদিন অনেক বড় হবে। তাদের মধ্যে একজন জাফিয়া জান্নাত। সে ভ্রাম্যমাণ এফএনএফ স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
কারওয়ান বাজারের সি আর দত্ত রোডের পাশেই পান্থকুঞ্জ পার্ক। এ পার্কের পাশের ফুটপাতে চলছে এ পাঠদান। ল্যাম্পপোস্টের মিটিমিটি আলোতে পড়াশোনা করছে প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী।
ক্ষুদে শিক্ষার্থী জাফিয়া জান্নাত বলেন, সারাদিন আমি কাগজ কুড়াই। বন্ধুদের সঙ্গে মিলে এ কাজ করি। এখান থেকে যে টাকা পাই সেটি আমার মাকে দেই। পড়তে আমার খুব ভালো লাগে। অন্য সবার মত আমিও একদিন বড় হয়ে দেশের সেবা করবো।
সম্প্রতি অফিস থেকে ফেরার পথে হঠাৎ চোখে পড়লো কি যেন পড়ছে তারা। কাছে গিয়ে দেখা গেল স্কুল ড্রেস পরিহিত প্রায় ৩০ জন ছেলে-মেয়ে শিক্ষকের সুরে সুর মিলিয়ে কবিতা পড়ছে।
এসময় কথা হয় স্কুলটির উদ্যোক্তা শিক্ষক জাহিদ সকালের সাথে। তিনি জানান, ‘এখানে যাদের দেখছেন, তারা সবাই ছিন্নমূল পথশিশু। খাবার সংগ্রহের তাড়নায় কাগজের বস্তা টেনে কাটে তাদের দিন। শিক্ষা তাদের কাছে অনেকটা বিলাসিতা। অনেকে তো রীতিমত কাগজের সেই বস্তা নিয়েই আসে পাঠদানে। মাথার ওপর ছাউনি না থাকলেও মানসিক তীব্র ইচ্ছাশক্তিই তাদের পাথেয়।’
এই উদ্যোক্তার সাথে কথা বলে জানা যায়, সন্ধ্যা ৭টায় পাঠদান শুরু করে চলে রাত ১০টা অবদি। আছে নির্দিষ্ট পোশাক। আলাদা কোনো আলোর ব্যবস্থা না থাকায় ল্যাম্পপোস্টের আলোতেই চলে দিব্যি পড়াশুনা।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তারা শুধু বাংলা নয়, ইংরেজিও বলতে জানে। তাদের কেউ হতে চায় শিক্ষক, পুলিশ কেউবা ডাক্তার, কারো স্বপ্ন পৃথিবীটাকে ঘুরে দেখা।
ভ্রাম্যমাণ এই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে এখন পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণ করেছে শতাধিক শিশু-কিশোর। শিক্ষার এ হাতেখড়ি পেয়ে মাদক ছেড়ে কেউবা হয়েছেন ছোট উদ্যোক্তা। সময়ের সাথে যুক্ত হচ্ছে এ রকম বহু গল্পের। প্রথমবারের মত এবার এই স্কুল থেকে পিইসি পরীক্ষা দিচ্ছে ৬ জন শিক্ষার্থী।
উদ্যোক্তরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষনেই ব্যবস্থা করা হয়েছে আলাদা পোশাক। তবে মাথার উপর ছাইনি না থাকায় বৃষ্টি-বাদলের দিনে পড়তে হয় বিপাকে। বন্ধ থাকে পাঠদান। সঙ্গে খোলা আকাশের নিচে হওয়ায় ধুলা আর গাড়ির শব্দতো আছেই। এতে বিঘ্ন ঘটে পাঠদানে। তবে, সকল প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে এগিয়ে চলেছেন এসব স্বপ্নচারিরা।
৫ বছর আগে ছিন্নমূল এসব পথশিশুদের জীবন বদলের সাহসী উদ্যোগ নেন পুলিশ বুর্যো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সদস্য জাহিদ সকাল।
একুশে টিভি অনলাইনের সাথে কথা হয় এই উদ্যোক্তার। তিনি জানান, শুরুটা এতটা সহজ ছিল না। গল্পের শুরু ২০১৫ সালের ২৫ নভেম্বর। ফার্মগেটে আনন্দ সিনেমা হলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় লক্ষ্য করলাম দু’জন পথ শিশু বসে আছেন। যাদের একজনের মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছিল।
তাদের জিজ্ঞেস করতেই জানালো স্যার, অনেক জায়গায় গিয়েও আমাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখান থেকে তাদের পার্শ্ববর্তী একটি ফার্মেসিতে নিয়ে যাই এবং ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানাই। কিন্তু তারা অনুরোধ রাখল না। ফলে নিজেই প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনে প্রাথমিক চিকিৎসা দেই।
এতে তাদের সাথে আমার একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এমন অবস্থায় তারা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘স্যার আমরা পড়ালেখা শিখতে চাই, আপনি আমাদের পড়াবেন? আমারও নিজের দায়বদ্ধতা থেকে মনে হল আসলে আমারও কিছু করা উচিত। কেননা, প্রত্যেকটি মানুষেরই সমাজকে কিছু দেয়ার থাকে, মানুষ হিসেবে নিজের পরিচয় দেয়ারও তো একটা জায়গা থাকে।
তাই, পরদিন থেকে ওদের সন্ধ্যার দিকে আসতে বলি। প্রথম দিনেই ৩ জনের একটি দলকে পড়াতে শুরু করি। প্রথমদিনেই বই, ব্যাগ ও অন্যান্য সামগ্রী নিজে কিনে দেই।
যাদেরকে আলোর পথে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিই, তারা মূলত একেবারেই বাস্তহারা। অনেকেরে পথেই জন্ম, পথে জীবন। সারাদিন বোতল, কাগজ টুকাইতো, এমনকি বস্তাসহ অনেকে স্কুলে চলে আসতো। এখনও কেউ কেউ আসে। প্রথমদিকে সংখ্যা কম হওয়ায় পড়াতে সমস্যা হতো না, কিন্তু সময়ের সাথে উপস্থিতি বাড়ায় চাপ বাড়তে থাকে।
এ কাজে যখনই আমার সমস্যা হতো, তখনই হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আমার বোন ও বন্ধুরা। স্কুলিং শুরুর আগে কয়েকজন কলেজ পড়ুয়া ছোটভাই ও বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে পথচলা শুরু করি। যদিও তারা শেষ পর্যন্ত থাকতে পারেননি। শুরু করার মাত্র দু’তিন দিনের মাথায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২ জনে দাঁড়ায়।
জাহিদ সকাল জানান, ‘শুরু থেকেই নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে নির্দিষ্ট কোনো জায়গা না থাকায় বিভিন্ন সমস্যার মুখে পড়তে হয়। ফুটপাতে পাটি বিছিয়ে পড়াই। নিয়মিত স্কুলিং করার চিন্তা থেকে জায়গা নির্ধারণে বেশ ভুগতে হয়েছে। অনেক সময় ভেবেছিলাম পার্কে হয়তো জায়গা পাবো কিন্তু তা হয়নি। আর সিনেমার পাশে আমি নিজেই সহ্য করতে পারছিলাম তা বাচ্চারা কিভাবে পারবে। তাই শেষ পর্যন্ত জায়গা হয়েছে কাওরান বাজারের ফুটপাতের এই ল্যাম্পোষ্টের নিচে।’
এ উদ্যোক্তা বলেন, ‘তবে সবচেয়ে কষ্ট হয় বর্ষায়। এসময়টাতে অন্যান্য সব স্কুল খোলা থাকলেও ছিন্নমূল এসব শিশুদের এই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়। অনেক সময় পাশের ভবনের বারান্দায় আশ্রয় নিতে হয়, সেখানেই চলে পাঠদান।
প্রথমদিকে লাইটিংয়ের সমস্যা হতো। পরে সংশ্লিষ্টদের জানানো পরও ব্যবস্থা না নেয়ায় শিশুদের নিয়ে মানববন্ধন করা করা হলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, পরে তারা পুনরায় লাইটিংয়ের ব্যবস্থা করে। বর্তমানে সেখানে আলাদা একটি লাইটিংয়েংর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে এখন আর সমস্যা হয় না।’
উপজেলা শিক্ষা অধিদপ্তরের আমরা যোগাযোগ করেছি, যাতে শিক্ষার্থীরা আমাদের স্কুলের নামেই পরীক্ষা দিতে পারেন। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। যদিও তারা এখনো কোড দেয়নি, তবে শিগগিরই দিবে বলে জানিয়েছেন তারা।
আমাদের সমাজের অনেক পরিবারে সন্তানদের জন্য পড়ালেখায় নিজেদের পাশাপাশি আলাদাভাবে শিক্ষকও রাখছেন। তাদেরকে নিয়ে তারা কত ব্যস্ত। অথচ, ছিন্নমুল এসব পথশিশুদের আমাদেরকে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের পথে ছোটার পাশাপাশি তাদেরকে নিয়ে আলাদাভাবে ভাবতে হচ্ছে। তারপরও ভাল একটি জায়গা পেতে আমাদের অনেক কষ্ট হচ্ছে। এটার সমাধান হলে আমরা তাদের অনেক ভাল কিছু দিতে পারবো।
জাহিদ সকাল জানান, সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো সহযোগিতায় নয়, প্রতিদিন তাদের একবেলা খাবার আমার নিজের অর্থায়নে খাওয়াই। তবে ব্যক্তিগতভাবে অনেকে বাচ্চাদের পড়তে দেখে ফলমুল থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাবার দিয়ে যায়।
এখানে যারা আসেন তাদের পরিবারের অবস্থা একেবারেই নাজুক। কারো বাবা রিকশা চালায় আবার কারো মা বাসা-বাড়িতে কাজ করে, কেউবা জানেই না তার বাবা-মার পরিচয়। তাই আমাদের চিন্তা এসব পথশিশুদের প্রোপারলি শিক্ষিত করে গড়ে তোলা।
পিছিয়ে পড়া এসব মানুষরা যাতে তাদের মৌলিক অধিকার ফিরে পায়, সচেতন হয় সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি।
তাদেরও যে বড় হতে হবে, সমাজকে কিছু দিতে তা হবে তা তাদের মাথায় নেই। আমরা চাই একটি কর্মমুখী শিক্ষা। এতে করে এসব শিশুদের জীবন বদলে যেত।
সরকার ও বিত্তবানদের কাছে আবেদন, ছিন্নমূল এসব শিশুদের জন্য এগিয়ে আসুন। এতে পরিবর্তন ঘটবে শিক্ষায়, তাদের দায়িত্ব নিতে পারলে বদলে যাবে সমাজ।