যেভাবে করোনা রুখে দিলো চীন
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৫:৩৪ পিএম, ২১ মার্চ ২০২০ শনিবার
করোনা থেকে জাতিকে রক্ষা করায় চীনের স্বাস্থ্যকর্মীরা পাচ্ছেন বীরের সম্মান
চীন থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পর মহামারীতে রূপ নিয়েছে করোনা বা কোভিড-১৯ ভাইরাসটি। এ ঘটনায় ব্যাপকভাবে সমালোচিত চীন। পশ্চিমা গণমাধ্যম এবং রাজনীতিকরা এ ঘটনায় প্রথম থেকেই চীনের দিকে অঙুল তুলেছেন। তাদের ভাষ্যমতে, করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় চীনা সরকার যথেষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়নি। তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা।
কেননা, চীন প্রথম থেকেই মরণঘাতী ভাইরাসটির বিরুদ্ধে দৃঢ় মনোবলে বুক চিতিয়ে লড়াই করছে। প্রকৃতপক্ষে শুরু থেকেই চীনা সরকার যদি পরিস্থিতি কঠোরভাবে সামাল না দিত, তাহলে বিশ্ব পরিস্থতি হয়তো আরও ভয়াবহ হতো। যদিও প্রতিদিনই নতুন নতুন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতী ভাইরাসটি। তবে উৎপত্তিস্থল চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরেই কমে এসেছে ভাইরাসটির প্রকোপ। মোটকথা চীনের পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণেই বলা যায়।
এমনকি, দীর্ঘ দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয়ীর বেশে ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন উহান শহরের স্বাস্থ্যকর্মীরা। কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করায় তারা পাচ্ছেন বীরের সম্মান।
চীনের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে উহানে কাজ করা এসব স্বাস্থ্যকর্মীরা মঙ্গলবার থেকে আনুষ্ঠিকভাবে উহান থেকে বিদায় নিতে শুরু করেন। খবর চায়না ডেইলির।
কিন্তু কীভাবে এই অসাধ্য সাধন করল চীন? যেখানে বিশ্বের অনেক উন্নত রাষ্ট্র করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে চীনা সরকার সংক্রমণ শুরুর অড়াই মাসের মাথায় ভয়াবহ এই পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দিলো!
চায়না ডেইলি জানাচ্ছে, উহান শহরের সাতটি হাসপাতাল এবং ১৪টি অস্থায়ী হাসপাতালে প্রায় ৬৮ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী দেশটির বিভিন্ন প্রদেশ থেকে গিয়ে করোনা আক্রান্তদের সেবা করেন। তাদের দিনরাতের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় মার্চের শুরু থেকেই চীনের উহানে করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ায় দিনদিন সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা কমতে থাকে। ফলে বন্ধ হতে থাকে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য তৈরি করা অস্থায়ী হাসপাতালগুলো।
এর আগে করোনার উৎপত্তিস্থল উহান শহরে ভাইরাসটির প্রকোপ এতটাই ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছে যে, বিপুলসংখ্যক করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসাসেবা দিতে বেগ পেতে হয় এখানকার স্বাস্থ্যকর্মীদের। ফলে চীনের স্বাস্থ্য মন্ত্রাণালয় জরুরি ভিত্তিতে চীনের বিভিন্ন স্থান থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের উহান শহরে পাঠায়।
যদিও করোনায় আক্রান্তদের সেবা করতে গিয়ে অনেক স্বাস্থ্যকর্মীই এ ভাইরাসে আক্রান্ত হন এবং অনেকের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে।
তবে পরিস্থিতি উন্নত হওয়ায় পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো এখন চীনের বন্দনাই গাইছে। কেউ কেউ চীনকে বাহবাও দিচ্ছে! খতিয়ে দেখছে চীনের গৃহীত পদক্ষেপগুলো। সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আক্রান্ত দেশগুলোকে ওইসব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধও করছে তারা।
এদিকে, চীনা সরকার করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবে ঠিক কোন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সে বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছে এবিসি নিউজ। চীনফেরত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একদল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তৈরি করা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে পশ্চিমা গণমাধ্যমটি বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের ওপর আলোকপাত করেছে।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়েছিল চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে। শুরুর দিকে ধারণা করা হয়েছিল, গোটা চীনে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে। তবে চীন সরকার ভয়াবহ পরিস্থিতিটা উহানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে পেরেছে। তাদের আগ্রাসী প্রচেষ্টায় ভাইরাসটি গোটা চীনে সংক্রামিত হয়নি। যদিও শুরুতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছিল। তবে ভাইরাসটি যেহেতু নতুন, তাই শুরুতে এর প্রভাব বুঝে উঠতে পারেনি চীনা চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা। ফলে ভয়াবহতা বুঝে উঠতেও দেরি হয়েছে এবং সে কারণে পদক্ষেপ নিতেও কিছুটা বিলম্ব হয়।
তবে আক্রান্ত রোগীদের সেবা-শুশ্রুষা এবং নতুন করে আক্রান্ত হওয়া ঠেকাতে চীন সরকার অভিনব কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রথমেই তারা আক্রান্ত ও ঝুঁকিতে থাকা লোকদের আলাদা করে ফেলেছে। আক্রান্তদের চিকিৎসায় পুরাতন কোনও হাসপাতাল তারা ব্যবহার করেনি। মাত্র ৬ দিনে এক হাজার শয্যাবিশিষ্ট একটি হাসপাতাল তৈরি করেছে। যা বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুত হাসপাতাল তৈরির রেকর্ড।
২০০৩ সালে সার্সে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য চীন সরকার বেইজিংয়ে শিয়াওটাংশান হাসপাতাল নির্মাণ করেছিল। এই হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছিল সাত দিনে, যা ওই সময়ের রেকর্ড। এছাড়া পুরাতন হাসপাতালগুলোতে শত শত আলাদা ইউনিট তৈরি করেছে তারা। উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকদের সরকারি ব্যবস্থাপনায় কোয়ারেন্টাইন এবং কম ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকদের হোম কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করেছে।
এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া, গণ পরিবহন পরিহার করতে পরামর্শ দেয়া, সংকটাপন্ন এলাকাগুলোতে নিয়মিত বিরতিতে জীবাণুনাশক ছিটানোর সাথে সাথে সকল নাগরিককে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে কঠোরতা অবলম্বন করেছে চীন সরকার। ফলে নতুন করে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে মৃত্যুর ঝুঁকি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি দলের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, তারা যখন ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে চীন ত্যাগ করে, তখন সেখানে নতুন করে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ২০৬ জন। বর্তমানে এই হার আরও কমেছে।
এছাড়াও রয়েছে চীন সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ, কৌশলগত চিন্তাভাবনা এবং সরকারের সব অংশকে সচল রাখা। চীনে সরকার পরিচালনা পদ্ধতিতে টপ-ডাউন মোবিলাইজেশন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। যে কারণে তারা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এড়িয়ে এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে তাদের সব প্রচেষ্টা নির্দিষ্ট দিকে নিয়োগ করতে পারে।
করোনা ভাইরাস যখন নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল তখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে অন্যান্য হাসপাতালের নার্স ও চিকিৎসকদের আক্রান্ত এলাকায় এসে কাজ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। হাতে কলমে শেখানো হয়েছিল কীভাবে সংক্রামক রোগ মোকাবিলা করতে হবে। এসব ডাক্তার ও নার্সদের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে আলাদা প্রনোদনা।
এছাড়া সকল ব্যয়ভার স্থানীয় সরকার কর্তৃক মেটানো হলেও রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেও প্রচুর পরিমাণ ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। যা আক্রান্তদের চিকিৎসা, ডাক্তার-নার্সদের বেতন ও অন্যান্য কাজে ব্যয় করা হচ্ছে।
এদিকে, প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় চীন সরকারের এমন দৃঢ় মনোবল ও গৃহীত পদক্ষেপ দেখে ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিসের অধ্যাপক মার্টিন জ্যাকুইস বলেন, জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় চীনের সক্ষমতা পশ্চিমা যে কোনও সরকারের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত এবং অনেক বেশি কার্যকর। চীনা নীতি এবং চীন সরকার এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় অন্য যে কোনও সরকারের চেয়ে অনন্য।
তাই প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর উচিত চীনের গৃহীত পদক্ষেপগুলো মেনে চলা।
এনএস/