ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

করোনার ওষুধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার কতদূর?

আ ব ম ফারুক

প্রকাশিত : ০৬:৪৮ পিএম, ২৮ মার্চ ২০২০ শনিবার | আপডেট: ০৬:৫০ পিএম, ২৮ মার্চ ২০২০ শনিবার

করোনাভাইরাসের দ্বারা বিশ্বজুড়ে মহামারি শুরুর পরিপ্রেক্ষিতে সারা পৃথিবীতেই চিকিৎসক ও ওষুধবিজ্ঞানীদের কর্মতৎপরতা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেড়ে গেছে। যাঁরা এই ভাইরাস-সৃষ্ট কভিড-১৯ রোগের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন তাঁদের কাছে এর কোনো প্রতিষেধক টিকা কিংবা চিকিৎসা করার কোনো স্বীকৃত ওষুধ এখনো নেই।

দেশে দেশে ওষুধ কম্পানি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ল্যাবরেটরি আর হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের সঙ্গে ওষুধবিজ্ঞানীরা নিরন্তর চেষ্টা করছেন কোনো টিকা বা ওষুধ আবিষ্কার করা যায় কি না। করোনাভাইরাস ঘন ঘন তার রূপ অর্থাৎ গঠন বদল করে ফেলছে বলে এর টিকা বা ওষুধ বের করতে উন্নত বিশ্বের বিজ্ঞানীরাও হিমশিম খাচ্ছেন।

যুক্তরাষ্ট্রে গত সপ্তাহে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির কথা জানা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজ এবং বায়োটেক ওষুধ কম্পানি মডার্না যৌথভাবে করোনার টিকা আবিষ্কারের জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। ভ্যাকসিন ছাড়াও কিউরেটিভ বা ওষুধ তৈরির কাজও থেমে নেই। 

সারা বিশ্বে করোনাভাইরাস এত মানুষকে আক্রান্ত করতে পেরেছে, কারণ নতুন এই ভাইরাসটিকে প্রতিরোধ করার মতো কোনো প্রতিষেধক টিকা বা ভ্যাকসিন পৃথিবীর কোনো বিজ্ঞানীর কাছে নেই। তবে জোর গবেষণা চলছে এবং ভ্যাকসিন তৈরির ব্যাপারে কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিও অর্জিত হয়েছে। কিন্তু কোনো নব-আবিষ্কৃত কার্যকর ভ্যাকসিন বাজারে আসতে আরো সময় লাগবে, কমপক্ষে সম্ভবত আরো এক বছর।

কিন্তু তত দিনে এরই মধ্যে আক্রান্ত এই বিপুলসংখ্যক রোগীর চিকিৎসার কী হবে? বিশ্বের দেশে দেশে চিকিৎসক ও ওষুধবিজ্ঞানীরা প্রাণান্তকর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। 

লাখো মানুষের প্রাণ বাঁচানো কুইনাইন থেকে পরবর্তীকালে রাসায়নিক বিক্রিয়া বা সংশ্লেষণের মাধ্যমে ক্লোরোকুইন এবং হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন তৈরি করা হয়েছে, যা ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে কুইনাইনের চেয়েও কার্যকর। 

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় দক্ষিণ কোরিয়া ক্লোরোকুইনকে সর্বপ্রথম ব্যবহার এবং সাফল্য পাওয়ার কথা জানায়। এর পরপরই সানোফি নামের ওষুধ কম্পানিটি ফ্রান্সে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনকে এই চিকিৎসায় ব্যবহার শুরু করে। 

গণমাধ্যমের খবর থেকে দেখা যায় কোরিয়া, ফ্রান্স ও চীনের সাফল্য দেখে যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ তাদের দেশেও ক্লোরোকুইন ও হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনকে নিয়ে করোনাভাইরাসের পরীক্ষায় সাফল্য পেয়েছে, তবে সেটি ‘ইন ভিট্রো’ পরীক্ষায় ‘ইন ভিভো’ পরীক্ষা, তারা এখনো করেনি এবং সে কারণেই এফডিএ ওষুধটিকে এখনো ব্যবহারের অফিশিয়াল অনুমতি দেয়নি। তবে তারা ‘ইন ভিভো’ পরীক্ষা শুরু করেছে, যার ফলাফল পেতে কিছু সময় লাগবে বলে মার্কিন এফডিএ জানিয়েছে।

বাংলাদেশে ছয়টি ওষুধ কম্পানি সিরাপ ও ট্যাবলেট আকারে ক্লোরোকুইন এবং ট্যাবলেট আকারে দুটি কম্পানি হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন তৈরি করে। আর এজিথ্রোমাইসিন তৈরি করে এখানকার ৫০টি ছোট-বড় ওষুধ কম্পানি। তাই এই ওষুধগুলো এ দেশে কোনো চিকিৎসক যদি তাঁর করোনা রোগীদের জন্য ব্যবহার করতে চান তাহলে এগুলোর উত্পাদন, সরবরাহ ও সহজলভ্যতা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সমস্যা হলেও আমাদের দেশে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

এফডিএ যেহেতু ‘ইন ভিট্রো’ পরীক্ষায় ইতিবাচক ফলাফল পেয়েছে এবং যেহেতু দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্স ও চীনে সীমিত আকারে হলেও ভালো ফলাফল দেখা গেছে; অতএব হয়তো এফডিএ-এর ‘ইন ভিভো’ পরীক্ষাসহ আন্তর্জাতিক বড় ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালগুলোর ফলাফলেও কভিড-১৯ এর চিকিৎসায় ক্লোরোকুইন, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ও এজিথ্রোমাইসিন অত্যন্ত সফল বলে প্রমাণিত হবে। এই ওষুধগুলো ব্যবহার করতে হলে আমাদের আরো একটি বড় সুবিধা হলো যে এই তিনটি ওষুধের দামই বিদেশের তুলনায় আমাদের দেশে অনেক কম। ফলে গরিব-নিম্ন আয় ও মধ্যবিত্তরাও এই ওষুধগুলো অনায়াসেই খেতে পারবে। সরকারের স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্কেও এগুলো বিনা মূল্যে বিতরণ করা সরকারের পক্ষে সহজ হবে।

আর যদি এই তিনটি ওষুধ কার্যকর বলে প্রমাণিত না-ও হয়, তাতেও আমাদের হতাশ হওয়ার কারণ নেই। আমাদের কাছে অস্ট্রেলিয়া-জাপান-থাইল্যান্ড-চীন ও ইউরোপের দেশগুলোর উদাহরণ রয়েছে। সেসব জায়গায় যে অ্যান্টিভাইরাল ওষুধগুলো যেমন—অসেলটামিভির, লোপিনাভির, রিটোনাভির এবং রেমডেসিভির ব্যবহার হচ্ছে, কার্যকর বলে অফিশিয়ালি স্বীকৃত হলে আমরাও সেগুলো ব্যবহার করতে পারব। তবে সমস্যা একটাই। এসব অ্যান্টিভাইরালের দাম যথেষ্ট বেশি। তাই আমরা কায়মনোবাক্যে চাইতেই পারি যে ক্লোরোকুইন, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ও এজিথ্রোমাইসিন—এই ওষুধগুলোই যেন সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ও স্বীকৃত হয়ে আসে। নিশ্চয়ই তখন আমাদের দেশের চিকিৎসকরা এগুলোর প্রেসক্রিপশন দিতে ভরসা পাবেন এবং চোখ, হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসের অসুখ এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে এসব ওষুধের প্রেসক্রিপশন সতর্কভাবে লিখবেন।

উন্নত দেশগুলো যেভাবে করোনাকে সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশে অতি সীমিত সম্পদ ও সুবিধাদি নিয়ে যেভাবে সরকার, চিকিৎসক ও সেবিকাসহ স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িত মানুষ, পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী যে পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা দেখিয়েছে, তা প্রশংসাযোগ্য। এখন সামরিক বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব নেওয়ায় তা আরো সুচারুভাবে বাস্তবায়িত হবে বলে বিশ্বাস করি। আগামী দিনগুলোতে যদি হাত ধোয়া ও ঘরে থাকার কাজটা আমরা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি, চিকিৎসার জন্য স্বীকৃত ওষুধগুলোর প্রটোকলও যদি বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে আমরা পেয়ে যাই এবং সামনে যেহেতু কালবৈশাখীর অঝোর বৃষ্টিসহ গ্রীষ্মকাল সমাগত, তখন বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের বিস্তার আমরা ইনশাআল্লাহ অবশ্যই রোধ করতে পারব।

তবে এই ওষুধগুলো বেশ কিছু কম্পানি কর্তৃক আমাদের দেশে তৈরি করলেও প্রেসক্রিপশন দেওয়ার সময় ভালো মানের ওষুধগুলোই যেন সেখানে স্থান পায় তা এই সংকটকালে অন্য সময়ে চেয়েও গভীরভাবে প্রত্যাশা করব।

লেখক : অধ্যাপক  পরিচালক, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কার্যনির্বাহী সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

abmfaroque@yahoo.com