ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫,   মাঘ ৩০ ১৪৩১

মুক্তির পথ দেখাবে প্রার্থনা ও মানবিকতা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০১:১৭ পিএম, ৩০ মার্চ ২০২০ সোমবার | আপডেট: ০২:১৭ পিএম, ৩০ মার্চ ২০২০ সোমবার

করোনায় আক্রান্ত বিশ্বের মানুষ। চারিদিকে এক অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ এমন এক মহামারি যা সবার মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। সবাই ঘরবন্দি হয়ে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তবে অতি সাধারণ মানুষ ভাইরাসে আক্রান্ত না হলেও খাদ্য সংকটে পড়েছে তারা। শ্রমজীবী অসহায় মানুষ না পারছে কারও কাছে হাত পাততে, না পারছে কাজ করতে। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে মানবতাই পরম ধর্ম হয়ে মানুষের কাছে হাজির হয়েছে।

অতীতে কোন মহামারি বা সঙ্কট একটি নির্দিষ্ট স্থান বা জাতিকে আক্রান্ত করলেও করোনা পুরো বিশ্বকে অচল করে দিয়েছে। যদিও এই সঙ্কট মানুষকে এক হতে শিক্ষা দিয়েছে। শিক্ষা দিয়েছে মানবিক হওয়ার। শুধু আক্রান্ত মানুষই নয়, বিশ্বের সকল রাষ্ট্রপ্রধানও দিনে দিনে মানবিক হয়ে উঠছেন। তারা তাদের সব শক্তি দিয়ে চেষ্টা করেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেন না এই মহামারিকে। ফলে সৃষ্টিকর্তার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা ছাড়া কোন উপায় থাকছেনা।

এ অবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষা- কঠিন বিপদের দিনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা ও মানবিকতাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন ধর্মীয় গুরু ও চিন্তাবিদরা। তারা বলছেন- নিজের আত্মিক পরিশুদ্ধির জন্যে, নিজের মনের পরিশুদ্ধির জন্যে, মননের পরিশুদ্ধির জন্যে, সৃজনশীলতার পরিশুদ্ধির জন্যে এবং ব্রেনটাকে আরও ভালোভাবে কাজে লাগানোর জন্যে এই সময়টা ব্যয় করতে পারেন। এই সময়ে সবচেয়ে ভালো হচ্ছে প্রাণায়ামের চর্চা করা, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুলের সান্নিধ্য চাওয়া।

যারা সনাতন ধর্মাবলম্বী রয়েছেন, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রয়েছেন, খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী রয়েছেন- এ সময় তারা তাদের একাগ্র নিমগ্ন প্রার্থনায় ডুবে গিয়ে একটা নতুন মাত্রা নিয়ে আসতে পারেন। 

বর্তমান এ অবস্থায় বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসী মানুষ নিজ নিজ ধর্মের নির্দেশনা মেনে চলতে চেষ্টা করছেন। নিজের বিশ্বাস নিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছেই ক্ষমা প্রার্থনা করছেন তারা।

এ বিষয়ে বিভিন্ন ধর্মগুরুদের মতামত নিচে দেওয়া হলো : 

অসুস্থ ব্যক্তির সেবা-যত্ন করা, তার খোঁজ-খবর নেওয়া ও শান্তনার বাণী শোনানো হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর সুন্নত। বিশ্বনবী রোগীর সেবাযত্ন করাকে সবে চেয়ে নেক আমল ও ইবাদত হিসেবে ঘোষণা করেছেন। 

এ বিষয়ে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের ভারপ্রাপ্ত খতিব মাওলানা মিজানুর রহমান বলেন,-

বিশ্বব্যাপী ভীতি ছড়ানো করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে। এখানে একটা শিক্ষা আছে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে এরকম আলাদা নয় যে, তার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে তার কোনও খোঁজই নিলাম না। বরং তাকে সাহস, হিম্মত ও আর্থিকভাবে সহযোগীতা করতে হবে। অর্থাৎ, সামর্থ্য অনুযায়ী সবধরণের সহযোগিতা চালিয়ে যাওয়া।’

তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘এমন হিংস্র প্রাণী থেকে দূরে থাকো, যা তোমার ক্ষতি করতে পারে। এমন রোগীর থেকে দূরে থাকো, যার মাধ্যমে অপর কেউ ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।’

বর্তমানে করোনার আক্রান্তদের ক্ষেত্রে ঠিক এই বিষয়টাই প্রতীয়মান। যা ইসলামের সেই শিক্ষা থেকেই এসেছে। অর্থাৎ, আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে কেউ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হোন কিংবা বিপদে না পড়েন, তাই তাকে নিরাপদ জায়গায় রাখা জরুরি। কিন্তু ওই ব্যক্তির সম্পর্কে আমাদের সভানুভূতি থাকতে হবে। 

যিনি আক্রান্ত কিংবা অসুস্থ হলেন তার পরিবারকে মানসিকভাবে উৎসাহ দেয়া ও আর্থিকভাবে সহযোগিতাসহ বিভিন্নভাবে তাদের পাশেও দাঁড়াতে হবে। যেহেতু এসময় তিনি একা থাকেন, তাই তার পরিবারকে সান্তনা ও সবধরণের সহযোগিতা করতে হবে। 

খ্রিস্টান ধর্মগুরু কার্ডিনাল প্যাকট্রিক ডি’রোজারিও (সিএসসি, আর্চবিশপ, ঢাকা) বলেছেন,-

‘করোনা ভাইরাস শুধু মহামারি নয়, এটা এখন বিশ্ব জুড়ে আতঙ্ক। এ বিষয়ে বাইবেলে কি বলা আছে তা সরাসরি বলা যাবে না। কারণ বাইবেল হচ্ছে- ইশ্বরের বাণী। আর এই বাণী আসে মানুষের সঙ্গে সংলাপ করতে গিয়ে। মানুষের পরিস্থিতি, মানুষের অবস্থা কী? সেখানে ইশ্বর কী চান সেই কথাই বাইবেলে লেখা আছে। তবে বাইবেলের যুগেও দেখা গেছে- অনেক মহামারি ছিল। সেই মহামারিটা দুইভাবে দেখা যেতো। একদিকে- ইতিবাচন। অন্যদিকে নেতিবাচক। নেতিবাচক হিসেবে দেখা যেতো সেটি ছিল ইশ্বরের শাস্তি। মানুষ পাপ করেছে তাই তাকে তিনি শাস্তি দিচ্ছেন। আর ইতিবাচক হিসেবে দেখা গেছে- ইশ্বর আহ্বান করছেন একটা নতুন কিছু হওয়ার জন্য। ওই সমস্যার মধ্য দিয়ে নতুন পথ খুঁজে নেওয়ার জন্য।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই করোনাকে প্রতিহত করতে মানুষ অনেক ধরণের উপায় গ্রহণ করছেন। যা খুবই ভালো উদ্যোগ। কারণ মানুষ মানুষের কল্যাণ চাইছে। সরকার যে যে উপায় গ্রহণ করেছেন সেগুলোকে সাধাবাদ জানাতে হবে। তারপরেও প্রশ্ন থেকে যায় যে- মানুষ এই সময় কী করবে। এ ক্ষেত্রে আমি বলবো- আমরা ইশ্বরে বিশ্বাসী। তার উপরে বিশ্বাস রাখবো। সে জন্য পুরো জগতে প্রার্থনা চলছে, উপবাস চলছে, ত্যাগ স্বীকার চলছে। সে জন্য মানুষের মধ্যে বিশ্বাস আছে যে ইশ্বর মানুষকে সম্পূর্ণভাবে নিচিহ্ন করবেন না। আপাতত একটা সমস্যা হতে পারে কিন্তু সেটাই শেষ নয়। বর্তমান অবস্থা দেখে এটা বলা যাবে না যে এখনই সব শেষ।’

ধর্মগুরু কার্ডিনাল প্যাকট্রিক ডি’রোজারিও বলেন, ‘মাঝে মাঝে নিরাবতাও খুব সজোরে কথা বলে। আমরা দেখছি সারা বিশ্বে একটা নিরব ভাব বিরাজ করছে। এই ঢাকার দিকে তাকলেই বোঝা যাবে- কয়েকদিন আগে কেমন ছিল, আর বর্তমানে কেমন আছে। যে যুবক যুবতিরা ঘরের বাইরে থাকতো তারা আজ ঘরমুখো হয়েছে। এমনটাই হওয়ার কথা। কাজেই সব অশুভর মধ্যে শুভ লক্ষণগুলো কী তা দেখতে হবে।’

‘আমি এটা বলতে চাই যে- বাংলাদেশ এমন একটা দেশ, তার প্রকৃতি, তার খাদ্য সামগ্রী, তার জীবনযাত্রা তথা সবকিছুর মধ্যে একটা শক্তি আছে। সেই শক্তিটা হচ্ছে সহ্য করার শক্তি। আমাদের জীবনে অনেক কিছু আসবে, তবে এই সহ্য শক্তির মাধ্যমে আমরা সব মোকাবেলা করতে পারব।’- বলেন এই ধর্মগুরু।

তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় না করোনা বাংলাদেশে খুব একটা বিস্তৃতি লাভ করবে।’

আমি সব ধর্মের মানুষের উদ্দেশ্যে বলব- ‘নিরাশ না হয়ে আমাদের যতটুকু শক্তি আছে তা দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। এটাই আমাদের শক্তি। এটাই আমাদের বৈশিষ্ট।’ 

তিনি বলেন- ‘প্রথমত- আমি বলতে চাই রাষ্ট্র যেসব সিদ্ধান্ত নেয় তা মেনে চলা উচিত। কারণ তারা যেসব নির্দেশনা দিচ্ছে তা মানুষের মঙ্গলের জন্য। সুতারাং আমরা কেনো এটা অবহেলা করব।

দ্বিতীয়ত- আমরা শুধু মানুষ না। আমরা ইশ্বরিয়। যা ইশ্বরের তা ইশ্বরকে দাও। তার সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে। এতেই মুক্তি মিলবে।’

অপরদিকে, মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের মূল উপায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা আর সতর্কতা। সব ধর্মই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার ওপর গুরুত্ব দেয়। করোনা যখন বিশ্ব মহামারি ঠিক তখন ধর্মীয় চিন্তাবিদেরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলারই পরামর্শ দিচ্ছেন। নামাজ, প্রার্থনা ও উপাসনা ঘরে বসে করার কথাও বলছেন তারা। এ অবস্থায় বিচলিত না হওয়ার আহ্বান ধর্মীয় নেতাদের। বিপদে ধৈর্য ধরে সতর্ক থাকার পরামর্শ ধর্মগুরুদের। 

ইসকন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক চারু চন্দ্রদাস ব্রহ্মচারী বলেন,-

’দেশের বিভিন্ন মন্দিরে যাতায়াত সীমিত করে দিয়েছি। আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানগুলো শুধু আমরা যারা ভিতরে আছি, তারাই করছি। দেশে যত হিন্দু আছে, তাদের সব অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করে দিয়েছি। কোনও অনুষ্ঠানেই আমরা অংশগ্রহণ করছি না। আমরা এখন টেম্পল কোয়ারেন্টাইনের মধ্যে আছি। কারণ আমরা মন্দির থেকে বাহিরে যাচ্ছি না। আবার বাহির থেকে কাউকে ভিতরেও আসতে দিচ্ছি না।’

তিনি বলেন,  দর্শনার্থীদের আমরা একটা সময় বেধে দিয়েছে। ওই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যারা আসবে, তারা স্রষ্টাকে দর্শন করে চলে যাবে। আবাসিক এলাকায় কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। কারণ কার ভিতরে কী আছে, তা বলা যায় না। আর আমরা মন্দিরে যারা আছি, তারা ধর্মীয় চর্চা বাড়িয়ে দিয়েছি। আমরা স্রষ্টার কাছে পার্থনা করছি, করোনা ভাইরাসটা যেন আর বেশি না হয়। আমাদের দেশে যেন এ মহামারি আর বড় আকার ধারণ না করে। এজন্যই আমরা আমাদের ধর্মীয় চর্চা বাড়িয়ে দিয়েছি। যে বাংলাদেশর সবাই সুস্থ থাকে, ভালো থাকে। এই প্রার্থনা আমরা করছি। 

ভক্তদের উদ্দেশে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, সে সব পদক্ষেপ যেন তারা মেনে চলেন। যেমন মাস্ক ব্যবহার করবেন, দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলবেন, বেশি লোকের সঙ্গে কথা বলবেন না। আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। শুধু বিধি নিষেধগুলো পালন করলে আর প্রার্থনা করলে স্রষ্টা এ মহামারি থেকে আমাদের রক্ষা করবে।

এসএ/