ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

করোনায় আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশি মির্জা হুদার মৃত্যুতে শোক

আদনান সৈয়দ

প্রকাশিত : ০২:৪০ পিএম, ৩০ মার্চ ২০২০ সোমবার | আপডেট: ০৪:১৯ পিএম, ৩০ মার্চ ২০২০ সোমবার

করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রোববার সন্ধ্যায় নিউইয়র্কের স্থানীয় একটি হাসপাতালে মির্জা হুদা সোহাগ (৪৪) নামে এক বাংলাদেশি মারা গেছেন। তাঁর মৃত্যুর সংবাদে নিউইয়র্ক প্রবাসীদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে।

মির্জা হুদা স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে নিউইয়র্কে বসবাস করতেন। প্রয়াত হুদার আদি নিবাস বাংলাদেশে যশোহর জেলার শহরতলী পালবাড়ি মুর্তির মোড়।

সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে হুদা ডায়বেটিকস ও অন্যান্য শারীরিক রোগে ভুগছিলেন।

তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে তারই এক বন্ধু আদনান সৈয়দ নিজের ফেসবুকে এক হৃদয়স্পশী পোস্ট দিয়েছেন।

তিনি লিখেছেন- 

‘তাকে আমি ডাকতাম মির্জা ভাই বলে। আমার সিনিয়র অথাব জুনিয়র সেই খবর আমি জানি না। সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল ঠিক এমন সম্বোধন থেকেই। মির্জা ভাই আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু ছিলেন। তবে বন্ধু শব্দটায় যেমন গলাগলির একটা সম্পর্ক বুঝায় তাঁর সাথে আমার সম্পর্কটা ঠিক তেমন ছিল না। তাঁর সঙ্গে ছিল আমার দীর্ঘদিনের ভালো এক পেশাদারী, আন্তরিক আবার আত্মিক সম্পর্ক। 

হায়! এই ‘ছিল’ শব্দটা লিখতেও বুকটা আবার কেঁপে উঠলো। সম্ভবত ২০০৯ সাল থেকে মির্জা ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়। অসাধারণ, অমায়িক, চৌকুস আর ভদ্র মানুষ বলতে যা বোঝায় মির্জা ভাই ছিলেন ঠিক তাই। 

আমি তাকে সম্বধোন করতাম ‘মির্জা ভাই’ আর মির্জা ভাই আমাকে বলতেন ‘বস’। তিনি কেন আমাকে বস বলতেন জানি না। তবে তিনি অনেককেই ‘বস’ বলে সম্বধোন করতেন। এটাই ছিল তার স্টাইল। 

আহা! কত স্মৃতি তাকে নিয়ে? কোন স্মৃতিটা ছোব আর কোনটা ছোব না? 

আমি তখন দেলওয়ারে উইলমিংটনে থাকি। আইটি জব করি। কিন্তু মনটা সারাক্ষণ পরে থাকে নিউইয়র্কের দিকে। প্রতি শুক্রবার সপ্তাহান্তে আমি দেলওয়ার থেকে নিউইয়র্ক চলে যেতাম। তখন মির্জা থাকতো ভার্জিনিয়াতে অথবা ওয়াশিংটন ডিসিতে। ঠিক মনে নেই। সেও নিউইয়র্ক যেত। কারণ নিউইয়র্কে তার এবং আমাদের আরেক বন্ধু আকতার ভাইয়ের একটা আইটি স্কুল ছিল। আমাকে দেলওয়ার থেকে মাঝপথে তারা প্রায়ই তুলে নিত। গাড়িতে উঠলেই মির্জা ভাই বলতো, ‘বস, আপনি ড্রাইভ করেন।’

তারপর দেলওয়ার থেকে নিউইয়র্ক এর সেই দীর্ঘ তিন ঘন্টার পথ। আর সেই পথ কত দ্রুত শেষ হয়ে যেত! সেই যাত্রাপথে থাকতো কত আড্ডা! কত গল্প! কত ভবিষ্যত পরিকল্পনা!

আমি বাংলাদেশে আসার সপ্তাহখানেক আগের কথা। হঠাৎ মির্জা ভাইয়ের ফোন।

‘বস, একটা অনলাইন পত্রিকা করতে চাই। আপনার হেলপ দরকার।’

আমি বললাম, ‘আপনি পত্রিকা বেড় করবেন আর আমি থাকবো না? দেশ থেকে ঘুরে আসি তারপর আপনার সাথে বসবো এই নিয়ে।’

সেই ছিল শেষ কথা তার সাথে। আর কী বসা হল মির্জা?

এই কিছুক্ষণ আগে বাংলাদেশ থেকে খবর পেলাম মির্জা ভাই আর নেই। করোনায় তার প্রাণ দিতে হয়েছে। গত কিছুদিন ধরেই সে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এলমহার্স্ট হাসপাতালে ছিল। যদিও সে খবর আমার জানা ছিল। আমার আরেক বন্ধু পাভেল চৌধুরী নিউইয়র্ক থেকে জানিয়েছিল মির্জা ভাই আগের থেকে একটু ভালো। শুনে মনটা কিছুটা হলেও স্বস্থি পেয়েছিল। আজ শুনলাম সে আর নেই। একটা মানুষ এই পৃথিবী থেকে এত দ্রুত ‘নেই’ হয়ে যেতে পারে তা আমি ভাবতেও পারছি না। যে লোকটা দু সপ্তাহ আগেও অফিস করেছে বাচ্চাদের নিয়ে খেলাধুলা করেছে। চোখে তার কতই স্বপ্ন ছিল! শুনলাম ভাবিও নাকি করোনায়া আক্রান্ত।’

হায় নিষ্ঠুর নিয়তি! তার ফুটফুটে দুটো সন্তান আছে। খোদা কী সে খবরটা জানে? পৃথিবী এত কঠিন কেন? এই কি আমাদের সাধের ঠুনকো ভালোবাসার জীবন?

মির্জা ভাই, আপনাকে বিদায় জানাই কীভাবে? ‘বস, এত তাড়াতাড়ি আমাদের কাছ থেকে আপনার চলে যেতেই হল?’

কী অদ্ভুত! এখন আপনার আত্মার শান্তি কামনা করে এই লেখা লিখতে হচ্ছে আমাকে! হায়; পৃথিবীটা কত নিষ্ঠুর! 

আপনার ফুটফুটে দুটো সন্তানের দিকে আমি তাকাতে পারছি না। হ্যা, এখন ভাবিই তাদের একমাত্র ভরসা। প্রাণপণে দোয়া করছি ভাবি যেন খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠেন।

কী দুঃসময়! বিশাল এক মৃত্যুর মিছিলে আমরা হাটছি। এর শেষ কোথায়? কেউ জানি না।

সবাই আমার এই বন্ধুটির আত্মার শান্তির জন্যে দোওয়া করবেন।’

একই ভাবে আকাশ আনোয়ার লিখেছেন-

‘মির্জা হুদা সোহাগকে প্রথম নাম মির্জা নামেই ডাকতো সবাই। অনেক প্রিয় মানুষ, অনেক ভালমানুষ ছিলেন তিনি। নিউইয়র্ক প্রবাসী এই সুন্দর মানুষের মধ্যে সুযোগ বুঝে করোনা ভাইরাস বীজ ছড়িয়েছিল। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে, পরে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন বেশ কিছু দিন।

বাঙালি কমিউনিটি থেকে সবাই দোয়া করেছেন। কিন্তু চিকিৎসার বিদ্যা পারেনি তাকে বাচাঁতে। আমেরিকার নিউ ইয়র্ক এর যশোর কমিউনিটির কম বেশী সবাই পছন্দ করতেন এই মানুষটিকে। যশোহর জেলার শহরতলী পালবাড়ি মুর্তির মোড়ে মির্জা হুদা সোহাগ এর আদি নিবাস।

বিগত কয়েক দিন যাবত করোনা আক্রান্ত হয়ে এ্যালমহাষ্ট হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে থাকাকালীন রোববার সন্ধ্যা ৬:১০ মিনিটে চলে গেলেন এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে।

মির্জা হুদা সোহাগ এর এ আকষ্মিক প্রয়ানে পরিবারটি হারালে একজন নির্ভরতার মানুষকে। আমরা হারালাম একজন বন্ধুকে। এভাবে আরো লিখতে হবে? চাইনা এমন করুন মৃত্যু। আর কতবার লেখার সুযোগ হবে জানিনা। পরিবারটির জন্য রইল স্নেহ আর ভালোবাসা।

বিদায় মির্জা হুদা সোহাগ... বিদায় বন্ধু।’

উল্লেখ্য, মির্জা হুদা সোহাগ যশোর এর সন্তান। ১৯৯১ সালে ‘নতুন খয়েরতলা মাধ্যমিক স্কুল যশোর’ থেকে এসএসসি এবং ১৯৯৩ সালে  
‘ক্যান্টনমেন্ট কলেজ যশোর’ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরবর্তীতে গ্রাজুয়েশন শেষ করে তিনি আমেরিকায় চলে যান এবং সেখানে স্ত্রী, কন্যা ও এক পুত্রকে নিয়ে বসবাস করছিলেন।

মির্জা হুদা সোহাগ নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত দৈনিক বাংলা সংবাদ মাধ্যম ‘বিডিনিউজ.লাইভ’র এডিটর ইন চিফ। এ ছাড়া তিানি ‘আ্যড এন্ড টেক’ নামে একটা সফটওয়্যার কোম্পানিরও কর্নধার।

এসএ/