ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

চা বাগান বন্ধ হলে দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতির আশংকা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:৫৫ পিএম, ৩০ মার্চ ২০২০ সোমবার

দেশের সবচেয়ে বেশি চা বাগানের সংখ্যা মৌলভীবাজার জেলায়। এ জেলার উৎপাদিত চা দিয়েই দেশের অধিকাংশ মানুষের চায়ের চাহিদা পুরণ হয়ে থাকে। চা একটি কৃষজ দ্রব্য। এটির কাঁচামাল পচনশীল। তাই করোনা ঝুঁকির মধ্যে চা বাগান কর্তৃপক্ষ বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে উৎপাদন অভ্যাহত রেখেছেন। 

তবে কয়েকটি বাগানে গত শনিবার থেকে স্বেচ্ছায় কাজে যাচ্ছেন না বেশ কিছু শ্রমিক। এদিকে সোমবার সকাল ৯টা থেকে ১১ টা পর্যন্ত ফিনলে টি এর গান্ধি ছড়া ও রাজঘাট চা বাগানের শ্রমিকরা মজুরীসহ ছুটির দাবীতে দুই ঘন্টা কর্ম বিরতি পালন করে। 

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় জেলার অধিকাংশ চা বাগানেই করোনা সচেতনতা অবলম্বন করে কাজ চলছে। তবে দুএকটি বাগানে শ্রমিকরা নিজ উদ্যোগে পাতা উত্তোলন বন্ধ রেখেছেন। শ্রীমঙ্গলস্থ এম এম ইস্পাহানি টি লিমিটেড এর জেরিন চা বাগানে গিয়ে দেখা যায়। তাদের বাগানের প্রবেশদ্বার বন্ধ রয়েছে। পাশেই রয়েছে হাত ধুয়ার শক্ত ব্যবস্থা। বাগান থেকে খাবার বা অন্য কিছু সংগ্রহে বাহিরে গেলে হাত পা ধুয়েই বাগানের ভিতরে প্রবেশ করতে হবে। বাহিরের লোকের প্রবেশ নিষেধ। বাগানে বসবাসরত কারো আত্মীয় গেলে গেটেই বাঁধার সমূখীন হচ্ছেন। আমরা দুজন গণমাধ্যমকর্মী সেখানে গেলে আমাদের বেলায়ও একই নিয়ম। তবে চা বাগান ব্যবস্থাপকের সাথে কথা বলে আমাদের দুজনের মধ্যে একজন ভালো করে হাত ধুয়ে এবং পায়ে স্প্রে ছিটিয়ে ভিতরে প্রবেশ করি। 

এসময় কথা হয় হয় জেরিন চা বাগানের উপ-মহা ব্যবস্থাপক সেলিম রেজা চৌধুরীর সাথে। তিনি জানান, সরকার সবাইকে বাড়িতে থাকতে বলেছেন। বার বার হাত ধোয়ার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছেন। আমাদের বাগান মানে আমাদের বাড়ি আমরা আমাদের বাড়িতে লকডাউন হয়ে আছি। ঘরের ভিতরে থাকলে যেভাবে রান্নাবান্ন করে খেতে হয় ঘরের কাজ করতে হয় আমরাও সেরকম কাজই করছি। চা বাগানে শ্রমিকরা পাতা তুলেন সব সময়ই অনেক দুরত্ব বজায় রেখে। একজনের সাথে আরেকজনের মিশে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। কারণ একেক জনের একটি নির্ধারিত জায়গা রয়েছে পাতা উঠানো জন্য।

একজনের নির্ধারিত স্থানে অন্য শ্রমিক প্রবেশ করে পাতা তুলেন না। তবে দুপুরে তারা খেতে বসলে এক সঙ্গে গোল হয়ে বসে খায় এবং পাতা ওজনের সময় তারা একজনের পেছনে আরেকজন লাইন ধরে দাঁড়ায় সেখানে সব সময় ৩-৪ ফুট দুরত্ব বজায় থাকে এবং তলব (মজুরী) নেয়ার সময় লাইন ধরে নেয়। এ ক্ষেত্রে তারা বাগান শ্রমিকদের বিশেষ ব্রিফিং দিয়ে খাবারের সময় দুরত্ব বজায় রেখে বসে খাওয়ার সিস্টেম চালু করেছেন। পাশাপাশি খাওয়ার সময় ওই জায়গায়ই সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার বিশেষ ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তলব নেয়ার সময় অনুরুপ দুরত্ব নির্ধারণ করে দিয়েছেন। টাকা ধরার পর বাসায় হাত ধুয়ার জন্য সতর্ক করে দিয়েছেন। একই সাথে তাদের প্রত্যেক শ্রমিক ও শ্রমিক সন্তানদের মাস্ক বিতরণ করেছেন।

তিনি আরও বলেন, পাতা ওজনের সময়ও লাইনের দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়াও ফ্যাক্টরীতে প্রত্যেক শ্রমিকই আলাদা আলাদা কাজ করেন। এক এক জনের দুরত্ব ২০-২৫ ফুট করে। তিনি জানান, সরকারের নির্দেশ মতো তারা তাদের বাগানের চার পাশে এবং প্রত্যেক শ্রমিকের বাড়ির আশে পাশে জীবানুনাশক স্প্রে করেছেন। একই সাথে তাদের বাগানের পাশের গ্রামগুলোতে ও বাজার এলাকাও তারা নিজস্ব অর্থায়নে স্প্রে করে দিয়েছেন। সেলিম রেজা আরো জানান, একই নিয়মে তাদের মীর্জাপুর ও গাজীপুর চা বাগানে পাতা উত্তোলন অব্যাহত রয়েছে। 

এ সময় জেরিন চা বাগানের ডা: সবুর খান জানান, তারা বাগানের হাসপাতালে নিয়মিত রোগী দেখছেন এবং শতর্ক রয়েছেন করোনার কোন উপসর্গ দেখলেই তারা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে অবহিত করবেন।

এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য বিশ্বজিৎ দেববর্মা জানান, জেরিন চা বাগানের ব্যবস্থাপক তার নির্বাচনী এলাকায় বাগানের লোক দিয়ে দুই রাউন্ড স্প্রে করে দিয়েছেন। একই কথা জানান, শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রেসক্লাবের সদস্য এসকে দাশ সুমন জানান, জেরিন চা বাগানের সাপোর্ট নিয়ে তারা শ্রীমঙ্গল উপজেলার বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় এবং গ্রামাঞ্চলে জীবানুনাশক স্প্রে করেছেন এবং আগামী এক সাপ্তাহ এ কার্যক্রম চলবে। 

এদিকে শ্রীমঙ্গল ফিনলে টির বিভিন্ন চা বাগানে গিয়ে দেখা যায় একই অবস্থা। শ্রীমঙ্গল ফিনলে টির ভাড়াউড়া চা বাগানের প্রবেশের গেট চারপাশ থেকেই বন্ধ রয়েছে। বাহিরের কারোরই এখানে প্রবেশের সুযোগ নেই। এর ভিতর দিয়ে অন্যান্য বাগানে যেতে গেলেও গেটের দারোয়ান  আটকাচ্ছেন সেই গাড়ি গুলোকে। এ ব্যপারে কথা হয় ভাড়াউড়া চা বাগানের জেনারেল ম্যানেজার ও বাংলাদেশীয় চা সংসদ সিলেট সার্কেল এর ব্র্যান্স চেয়ারম্যান গোলাম মো: শিবলীর সাথে। 

তিনি জানান চা পাতা একটি পঁচনশীল দ্রব্য। এটি উত্তোলনের পর বৈজ্ঞানিক নিয়মে নির্দিষ্ট প্রদ্ধতিতে ও সময়ে প্রকৃয়াজাত করতে হয়। তা মানা না হলে এর গুনগতমান ঠিক থাকবে না। অন্যদিকে পাতা তুলার সার্কেল রয়েছে। ৭ থেকে ৮ দিনে এক সার্কেল পাতা উঠানো বন্ধ করলে ওই সার্কেলে পাতা উঠানোর প্রকৃয়া বাধাগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে পাতা উত্তলনের যে অংশ দুটি পাতা একটি কুঁড়ি তা থাকবে না। এক দুই সার্কেলে পাতা না উঠালে পাতা বড় হয়ে যাবে যা চা প্রকৃয়াজাতের উপযোগী হবে না। এমতাবস্থায় জেলা প্রশাসন থেকেও তাদের বাগান বন্ধ রাখার কোন নির্দেশে দেয়া হয়নি। জেলা প্রশাসন থেকে বাহিরের লোক যেন বাগানে প্রবেশ না করে সে বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তিনি জানান, তাদের প্রত্যেকটি বাগানে করোনা সর্তকীকরণের শুরু থেকেই তারা জীবানুনাশক স্প্রে করছেন এবং শ্রীমঙ্গল থানা পুলিশের আহব্বানে তিনি পুরো শ্রীমঙ্গল শহর তার লোক দিয়ে স্প্রে করে দিয়েছেন। এ ব্যপারে শ্রীমঙ্গল থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুস ছালিক জানান, ভাড়াউড়া চা বাগানের জেনারেল ম্যানেজারের সহায়তায় তারা পুরো শ্রীমঙ্গল শহরে এক রাউন্ড জীবানুনাশক স্প্রে করেছেন।

এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন জানান, করোনা শতর্কতায় চা বাগানের নিরাপত্তার স্বার্থে তারা এই সময়ে চা বাগানের ভিতরে বাহিরের লোক প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন এবং বাগানের ভিতরে স্থাপিত মদের পাট্টা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

এদিকে করোনা সতর্কতা জারি করার পর কিছু চা শ্রমিক নেতা বাগানে ছুটি ঘোষণা করার আবেদন করলেও চা বাগানের কার্যক্রম করোনা ছড়ানোর প্রকৃয়ায় পড়েনা এবং এটি পঁচনশীল কৃষিজ বলে তারা বাগান বন্ধ করে দেননি বলে জানান চা বাগান মালিক পক্ষ। তারা জানান, সরকার প্রেরিত নিয়ম মেনে নিরাপদ দূরত্ব এবং বার বার হাত ধোয়া কার্যক্রম পরিচালনা করে বাগান চালু রেখেছেন।

 এ ব্যপারে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহ সভাপতি পংকজ কন্দ জানান, করোনা সচেতনতায় এবং এ থেকে রক্ষার জন্য চা শ্রমিকদের বেতন ঠিক রেখে ছুটি প্রদানের জন্য চা শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে মালিক পক্ষসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। 

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী জানান, মজুরীসহ ছুটি দেয়ার জন্য সরকার ও বাগান কর্তৃপক্ষকে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু কোনো সাড়া পাননি। এদিকে ছুটি না দেয়ায় শ্রমিকরা নিজ উদ্যোগেই শ্রীমঙ্গলের সাতগাঁও, ও মাজদিহি এবং কমলগঞ্জের সমশের নগর, কানিহাটি, দেওছড়া, বাগিছড়া, দেবল ছড়া, মৃত্তিঙ্গার ফাঁড়িসহ ১০টি বাগানে শনিবার থেকে শ্রমিকরা  কাজে যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।

তবে বাগান কর্তৃপক্ষ বন্ধ না দিলেও কয়েকজন শ্রমিক নেতার প্ররোচণায় শ্রীমঙ্গল সাতগাঁও চা বাগানে শনিবার থেকে কাজে যাচ্ছেন না শ্রমিকরা। এতে চা বাগানটি মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে বলে জানান, সাতগাঁও চা বাগানের ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, সরকারের নিয়ম মেনেই তারা বাগান চালু রেখেছেন। কিছু শ্রমিক নেতা বাগান বন্ধের জন্য তাকে অনুরোধ করলে তিনি জানান, এই সময়ে বাগান বন্ধ হলে তারা দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতির মুখে পড়বেন। তিনি জানান, দেশের অবস্থা তারা নজর রাখছেন বাগানের দিকেও তারা কড়া নজর রেখেছেন প্রয়োজন হলে তারা ছুটি দিবেন। তা ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে ছুটির জন্য কোন নির্দেশনাও নেই।
বিভাগীয় শ্রম অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো: নাহিদুল ইসলাম বলেন, মন্ত্রনালয়ের একটি নির্দেশনা রয়েছে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকি না রেখে নিয়ম মেনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। 

আর ফিনলে টির এর চীফ ওপারেটিং অফিসার তাহ্সিন আহমদ জানান, এই মুহুর্তে খড়া চলছে গাছে প্রতিনিয়ত পানি দিতে হচ্ছে। পানি না দিলে গাছ বাঁচানো যাবে না। এখন বাগান বন্ধ দিলে চা শিল্প দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতির মুখে পড়বে। তিনি জানান, এটি অন্যান্য ঘন অবস্থানের ইন্ডাস্ট্রির মতো না। তা ছাড়া তারা সব সময় নজর রেখেছেন প্রয়োজন হলেই তারা এ বিষয়ে ব্যাবস্থা নিবেন কারণ শ্রমিকরাইতো বাগানের প্রাণ। 

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ চা গবেষনা কেন্দ্রের পরিচালক ড. মোহাম্মদ আলী জানান, এখন পানি দিয়েই গাছ রক্ষা করা কষ্ট হচ্ছে। পানি না দিলে গাছ মরে যাবে। আর গরমের কারণে বিভিন্ন রকম পোকার উপদ্রপ দেখা দিবে। তাই ক্রীট নাশকও স্প্রে করতে হবে। অন্যদিকে পাতা না উঠালে তা বড় হয়ে যাবে। আর পাতা বড় হলে এর পত্ররন্ধ দিয়ে পাতা অতিরিক্ত পানি চুষে নিবে। যা আরো বড় রকমের ক্ষতির মুখে পড়বে চা বাগান।

আর চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের পরিচালক ড. রফিকুল হক জানান, তারা প্রত্যেক চা বাগানের মালিকদের ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন শ্রমিকদের মাস্ক বিতরণ এবং হাত ধোয়ার বিষয়ে সচেতন করতে। একই সাথে বাগানে কোন প্রবাসী থাকলে তাদের হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে এবং সবসময় করোনা বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে। আর করোনা সচেতনায় সরকাররের নির্দেশনা যেন তারা অবশ্যই পালন করেন।

এ ব্যপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা চেয়ারম্যান রনধীর কুমার দেব বলেন, এই সময়ে যেন চা শ্রমিকরা করোনা সচেতনাতায় সরকারের নিয়ম মেনে চলতে পারে সে বিষয়ে চা বাগান মালিকদের কড়া নজর রাখতে হবে। কারণ এই চা শ্রমিকরাই চা বাগানের মূল উৎস।

একে/এসি