ইতালিতে মৃত্যুর হার এতো বেশি কেন?
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১০:৩৩ এএম, ১ এপ্রিল ২০২০ বুধবার | আপডেট: ১০:৩৫ এএম, ১ এপ্রিল ২০২০ বুধবার
মহামারি করোনা ভাইরাস মৃত্যুপুরী বানিয়ে ফেলেছে ইতালিকে। বেড়েই চলেছে লাশের মিছিল। এই ভাইরাসে দেশটিতে আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ৭৯২ জন। প্রাণ হারিয়েছে রেকর্ড ১২ হাজার ৪২৮ জন।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ইতালিতে প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি সেখানে প্রথম মৃতের ঘটনা ঘটে। এরপর মাত্র ৩৮ দিনের ব্যবধানে ১২ হাজার মৃত্যুবরণ করেছে।
করোনা ভাইরাস বিশ্বের ২০০টির ও বেশি দেশে ছড়িয়েছে। কিন্তু ইতালিতে মৃতের হার এতো বেশি কেন? এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
প্রথমত, ইতালি বিশ্বের দ্বিতীয় দেশ যেখানে সবচেয়ে বেশি বয়স্ক মানুষ বাস করে। এক্ষেত্রে জাপানের পরেই তাদের অবস্থান। আর করোনা ভাইরাস বয়স্ক মানুষদের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ইতালির মানুষের গড় বয়স ৭৮ (সূত্র : স্বাস্থ্যসংস্থা)! সে কারণে আক্রান্তদের বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না। যদিও ব্যতিক্রম কিছু ঘটনাও রয়েছে। ১০২ বছর বয়সী ইতালিকা গ্রোন্দোনা করোনা জয় করে বাড়ি ফিরেছেন। ১০১ বছর বয়সে আরো একজন করোনা জয় করেছেন সেখানে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী এই রোগে আক্রান্ত হলে গড়ে তিন দশমিক চার শতাংশ মানুষ মারা যান। যেখানে ইতালিতে এই হার পাঁচ শতাংশ।
লাইভ সাইন্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মৃত্যুর হার বেশি হওয়ার একটি কারণ হতে পারে দেশটির জনসংখ্যায় প্রবীণদের সংখ্যাধিক্য। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইতালির বাসিন্দাদের প্রায় ২৩ শতাংশের বয়স ৬৫ বা তার বেশি। দেশটিতে বসবাসরত মাঝবয়সী জনসংখ্যা ৪৭ দশমিক তিন শতাংশ। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে এই হার ৩৮ দশমিক তিন শতাংশ। দ্য লোকালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইতালিতে যারা এই সংক্রমণে মারা গেছেন তাদের বেশিরভাগের বয়স ৮০ থেকে ৯০।
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের এপিডেমিওলজির সহযোগী অধ্যাপক অব্রি গর্ডন বলেন, মৃত্যুর হার সবসময় জনসংখ্যার হারের উপর নির্ভর করে।
ইতালির প্রবীণ জনসংখ্যার বিষয়ে গর্ডন বলেন, ‘কম বয়সী জনসংখ্যা বেশি এমন দেশগুলোর তুলনায় বয়স্ক জনসংখ্যা বেশির দেশে মৃত্যুর হার বেশি হবে।’
টেম্পল ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ পাবলিক হেলথের এপিডেমিওলজিস্ট ক্রিস জনসন বলেন, ‘মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যান্সার বা ডায়াবেটিসের মতো রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ জাতীয় পরিস্থিতি যাদের আছে করোনা ভাইরাস তাদেরকে মারাত্মকভাবে অসুস্থ করে তোলে।’
জনসন বলেন, ‘আমরা সম্ভবত জানি না যে ইতালিতে কত মানুষ আসলে সংক্রমিত হয়েছে। খুবই অল্প লক্ষণ যাদের কিংবা কম বয়সীরা সাধারণত পরীক্ষা করতে যান না।’ জনসনের ধারণা সে হিসেবে ইতালিতে সত্যিকারের মৃত্যুর হার বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর হারের কাছাকাছিই হবে।
দ্বিতীয়ত, ইতালি ছয় সপ্তাহ আগে লকডাউন করলেও সেখানকার মানুষ সেটা মানেনি। চীনের মতো তারা কড়াকড়িভাবে লকডাউন করতে পারেনি। আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকায় একটা সময় লকডাউন না মানায় জরিমানা শুরু হয়। জরিমানার পরিমাণ বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ডলারে ঠেকেছে (প্রায় ৩ লাখ টাকা)। তবুও তাদের ঘরে রাখা যাচ্ছে না। বর্তমানে কেউ বিনা প্রয়োজনে বাইরে বের হলে তাকে সরাসরি জেল-হাজতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
তৃতীয়ত, সংস্কৃতিগত প্রভাবের কারণেও সেখানে মৃত্যুহার বেশি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অধ্যাপক ডেলা গিউস্তার মতে ইতালীয়দের বেশি বাইরে বের হওয়ার প্রবণতা ও স্পর্শের সংস্কৃতিও এক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে।
তিনি বলেন, আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য কিংবা আয়ারল্যান্ডের মানুষ পরস্পরের মধ্যে যতটুকু ব্যবধান রাখে ইতালির ক্ষেত্রে সেই ব্যবধান অনেক কম থাকে। সেখানকার মানুষ একে অপরকে হ্যালো বলার সময় চুমু খায়।
আক্রান্ত এলাকায় স্কুল বন্ধ করে দিয়েও অনেক অভিভাবককে বিচ্ছিন্ন (আইসোলেশন) রাখা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ডেলা গিউস্তা। তিনি জানান, লোম্বার্দি এলাকায় স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার পরও অভিভাবকরা তাদের বাচ্চাদের অন্যান্য অঞ্চলের পর্বত ও সমুদ্র এলাকায় ছুটি কাটাতে নিয়ে গেছে। ‘তারা ভেবেছিল বাচ্চাদের তারা নিরাপদ রাখছে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে এ ধরনের আচরণের ফলাফল ভালো হয়নি।’ বলেন তিনি।
চতুর্থত, ভয়ঙ্কর তথ্য হচ্ছে ইতালিতে আক্রান্ত ও মৃতের পরিমাণ আরো অনেক বেশি। যে সংখ্যাটা প্রকাশ পাচ্ছে সেটা প্রকৃত নয়। ইতালি এখন কেবল সবচেয়ে খারাপ অব্স্থা যাদের তাদের পরীক্ষা করছে। সবাইকে করতে পারছে না। সে কারণেও বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। প্রতিদিন ৫ হাজারের মতো টেস্ট করে তারা। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। হাজার হাজার ইতালিয়ান পরীক্ষার অপেক্ষায় ঘরে বসে আছেন। একটা সময় স্বাস্থ্যকর্মীদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। ছিল না প্রয়োজনীয় লোকবল। সে কারণে তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে টেস্ট করতেও পারেনি। তাতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে হু হু। বেড়েছে মৃতের সংখ্যাও।
পঞ্চমত, একই অঞ্চলে বেশি সংখ্যক আক্রান্ত থাকা এর একটি অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের রোগতত্ত্ববিষয়ক সহযোগী অধ্যাপক অব্রি গর্ডন মনে করেন, ইতালিতে মৃত্যুহার বেশি হওয়ার আরেকটি কারণ হতে পারে, এক এলাকায় অনেক বেশি আক্রান্ত থাকা, যাদের কিনা চিকিৎসা সেবা জরুরি। একটি অঞ্চলে অনেক বেশি আক্রান্ত থাকলে সেখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর অনেক বেশি চাপ পড়ে এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে যায়; যেমনটা চীনের উহানে হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে। চীনের উহানে করোনায় মৃতের হার ৫.৮ শতাংশ। আর গোটা দেশে মৃতের হার ০.৭ শতাংশ।
ষষ্ঠত, পদক্ষেপ ও ব্যবস্থাপনার সংকটের কারণেও বাড়তে পারে এই মৃত্যু সংখ্যা। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ইতালিজুড়ে নতুন করে আরও যেসব কড়াকড়িমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা কেবল নজিরবিহীনই নয়, অস্থিতিশীলও। লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এন্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক জন এডমুন্ড বলেছেন, এ ধরনের বিধিনিষেধের প্রভাব খুব স্বল্পমেয়াদি হবে। দীর্ঘমেয়াদে এগুলোর বাস্তবায়ন না হলে মহামারি অবস্থা আরও বেশিদিন থেকে যাবে বলে শঙ্কিত তিনি।
অবশ্য ইতালির বতমান পদক্ষেপগুলোকে ‘অসাধারণ’ ও ‘পুরোপুরি যথার্থ’ বলে উল্লেখ করেছেন অধ্যাপক ডেলা। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে সরকারের প্রতিক্রিয়া খুব ধীর ছিল।
তবে আশার বিষয় হচ্ছে দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসছে। হয়তো চলতি সপ্তাহের শেষ দিকে মৃতের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে। কারণ, ইতালিতে করোনা ভাইরাস পিক পয়েন্টে আছে। এখান থেকে নিম্নমুখী হবে।
এমবি//