এবার তাকান, ক্যামেরা-এ্যাকশন!
আহমেদ মুশফিকা নাজনীন
প্রকাশিত : ০১:১৩ পিএম, ১ এপ্রিল ২০২০ বুধবার | আপডেট: ০১:২৫ পিএম, ১ এপ্রিল ২০২০ বুধবার
প্রায়ই সময় অনুরোধ আসে, অমুক ভাই....মাস্ক দিয়েছে, নিউজটা দেখালে ভালো হয়, একটু পর আবার ফোন, তমুক স্যার স্যানিটাইজার দিয়েছে একটু টিভিতে দেখান। সারাদিন-রাত-বিকেল এরকম অনুরোধের আসরের ফোন আসে বেশ কয়েকবার।
তাদের অনুরোধে ছবি গুলোয় মনোযোগ দেই। দেখি, কিছু দান সামগ্রী টেবিলের উপর রাখা। কয়েকজন উৎসাহী মানুষ ধরে আছে সেগুলো। সেখানে দাতার চোখ গ্রহীতার দিকে নয়, ক্যামেরার দিকে। যেন সকল মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু এখন ক্যামেরা। যেখানে দান করে নয়, দান দেখানো নিয়ে দাতা আসলে উৎসাহী। আরো ভালো করে দেখি অসহায় মানুষগুলো রোদের মধ্যে দানের বস্তু ধরে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে।
তাকে বারবার বলা হচ্ছে ক্যামেরার দিকে তাকাতে। হয়নি, আরেকবার নিতে হবে। না আরও একবার। এভাবে ক্লিক ক্লিক করে ছবি নেয়া শেষ। এবার দান দেয়াও শেষ। দাতা ও তার অনুসারীরা এবার হাসিমুখে জাবর কাটেন। বস, অনেকগুলো ক্যামেরা এসেছে। এবার সব টিভি চ্যানেলে নিউজে যাবে। নিজের চেহারা টিভিতে দেখবেন বলে আত্মতৃপ্তিতে ঢেকুর তোলেন দাতা। ফোনে অনেককে বলেনও টিভি দেখার জন্য।
ভালো করে রাশ ফুটেজে দেখি দূরে গ্রহীতার বউ বসে আছে মলিন মুখে। একসময় হয়তো স্বচ্ছল বাড়ির মেয়ে ছিলেন। নদী ভাঙনে সব চলে গেছে। হাত পাততে বড় লজ্জা হয় তার। কিভাবে হাত বাড়াবেন বুঝতে পারছেন না। ছোট মেয়েটার মুখ বারবার চোখে ভাসে। খাবার না নিয়ে গেলে না খেয়ে থাকতে হবে তাদের। কদিন থেকে শুধু শাক লতা পাতা খাচ্ছেন। স্বামীর ধমক খেয়ে সংকোচ ঝেড়ে উঠে দাঁড়ান। মাথায় ঘোমটা টেনে কুণ্ঠিত পায়ে এগিয়ে যান দান নিতে।
সুপ্রিয় দাতা, একবারও কি ভেবেছেন যিনি দান নেন, এ দান নিতে তার কত ছোট হতে হয়। কতটা লজ্জা পেতে হয় তাকে। দান নেয়া নিশ্চয় সুখকর কিছু নয়। আত্মসম্মানে লাগার কথা। লাগেও। কিন্তু জীবন যেখানে জটিল সেখানে দুহাত বাড়ানো ছাড়া আর কি করতে পারে এই অসহায় মানুষগুলো। আর তাদের অসহায়ত্ব নিয়ে খেলা খেলে কিছু মানুষ।
ভাবতে বসি মূল উদ্দেশ্য কী আপনার, দান নাকি প্রচার?
নিজের ঢোল নিজে পেটাও। এ নীতিতে আত্মপ্রচার আজ সমাজে তুঙ্গে। এরমধ্যে সরকারী বেসরকারি সব ধরনের মানুষই আছেন। যে যা করেনা আজ তাও বলে। যে যা করে আজ তাও বলে।
সেই ছোটবেলায় প্রবাদ পড়েছিলাম, আপনারে বড় বলে বড় সেই নয়, লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়। প্রবাদের কথাগুলো যেন আজ হালকা হতে হতে বাতাসে উড়ে বেড়ায় করোনার মতো। করোনার মতো সে আজ আশ্রয় খুঁজে বেড়ায় লজ্জাহীনদের মাঝে। তাদের লজ্জাহীনতা দেখে বড় মানুষরাই আজ যেন বড় লজ্জা পায়। তারাই মুখ লুকায়। আর লজ্জাহীনরা বড় বড় কথার তুবড়ি ছোটান। তাদের ক্ষমতার দম্ভে স্তম্ভিত মানুষ।
অনেকেই হয়তো দ্বিমত করবেন, দান করে দেখালে সমস্যা কি? এতে অনেক মানুষ জানবে। তারা উৎসাহিত হবে। একদম ঠিক। তবে কোনটা সত্যিই দান আর কোনটা লোক দেখানো মানুষ কিন্তু আজ সত্যিই তা বোঝে।
এক অফিসে চাকরি করতাম। এক ঈদের সময় দেখি অফিসে রাজ্যের পুরোন কাপড়। কোনটা ছেঁড়া, কোনটা রঙ জ্বলে যাওয়া। শুনলাম এগুলো গ্রামে পাঠানো হবে গরীবদের দেয়ার জন্য। এত টাকা এদের। আর ঈদের সময় ছেড়া নোংরা জামা এগুলো দেয়া হচ্ছে?
মনে পড়ল নেপালে ভূমিকম্পের সময় ভারত থেকে ত্রাণ সামগ্রী হিসেবে পুরোন কাপড় পাঠানো হয়। নেপাল সরকার সবিনয়ে তা ফেরত পাঠিয়ে দেয়। পারলে ভালো কাপড় দিবে নয়তো নয়। তাদের কথা, আমার দেশের নাগরিক ব্যবহৃত কাপড় পরবে না। ভারত লজ্জা পেয়ে ফেরত নেয়। পরে ভালো কাপড় পাঠায়।
আমরা অনেকেই হয়তো আলমারিতে খুঁজে দেখি কোন জামাকাপড়গুলো পরার যোগ্য নয়, সেগুলো মানুষকে দিয়ে দেই। গরীবদের খাওয়াতে গেলে হাড্ডি-চর্বি ভর্তি মাংসগুলো দেই। আর নিজের জন্য ভালো মাংস রেখে দেই। এভাবে দান করে বিরাট সওয়াবের কাজ করে ফেলেছি বলে মনে করি। আসলেই কি তাই?
এই যে ফেসবুকে করোনা নিয়ে কত যে লাইভ দেখলাম। সবাই কি সচেতনতার জন্য করেছেন? নিজের আত্মপ্রচারের জন্য কি অনেকে করেননি? আপনি লাইভ করে আপনার টাইমলাইনে রাখুন। অন্যকে বিরক্ত করা কেন?
বলা হয় গোপনে দান করার কথা। দান করার সময় যেন ডান হাত যেন না জানে বাম হাতের কথা। বাম হাত না জানে ডান হাতের কথা। অথচ আজ?
দান আজ প্রচারে প্রসার যেন। ৫শ টাকার দান করলে প্রচারের জন্য খরচ করি ৫ হাজার টাকা। গরীব অসহায় মানুষদের সামনে রেখে এক ধরনের মহান সাজা। অন্যের পরামর্শে নয়, নিজেই নিজেকে শোধরান। দেখানো নয়, ক্যামেরায় নিউজের জন্য নয়, দান করুন সত্যিই মন থেকেই। সেটা যতটুকুই হোক না কেন। মন থেকে করা কাজ ঠিকই বুঝতে পারে মানুষের মন।
লেখক- সাংবাদিক