দেশের স্বার্থেই লড়ে যাচ্ছে মালয়েশিয়া প্রবাসী শিক্ষার্থীরা
শেখ আরিফুজ্জামান, মালায়শিয়া থেকে:
প্রকাশিত : ০৯:০৩ পিএম, ৩ এপ্রিল ২০২০ শুক্রবার | আপডেট: ০৯:৪৯ পিএম, ৩ এপ্রিল ২০২০ শুক্রবার
প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) এর ভয়াল গ্রাস থেকে বাঁচতে দুনিয়াজুড়ে চলছে জরুরি অবস্থা। আক্রান্তের সংখ্যা ঠেকাতে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার পর্যটন নগরী মালয়েশিয়ায় চলছে লকডাউন বা মুভমেন্ট কন্ট্রোল অর্ডারের (এমসিও)। ঘোষিত লকডাউনের আজ ১৭তম দিন অতিবাহিত হচ্ছে।
মানুষের স্বাস্থ্য বিশেষত করোনার মত অনাকাঙ্খিত মহামারি প্রতিরোধ বিষয়ে যখন বিশ্ব হিমসিম খাচ্ছে। তখন মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা দেশের স্বার্থেই লড়ে যাচ্ছেন। তারা ফিরছেন না দেশে। পরিবার পরিজনের মায়া ত্যাগ করে অধিকাংশই থেকে গেছেন ক্যাম্পাসের গন্ডির মধ্যে।
এই লকডাউন বা মুভমেন্ট কন্ট্রোল অর্ডারে (এমসিও) তাদের সুখ দুঃখের কথা শেয়ার করেছেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় একুশে অনলাইন সাথে। নিম্নে তাদের বক্তব্য তুলে ধরা হলো:
ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালয়েশিয়াতে পিএইচডিরত শিক্ষার্থী জহিরুল ইসলাম। পিএইচডি'র পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশী স্টুডেন্টস ইউনিয়ন মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশী স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, আমাদের ইউভার্সিটিতে প্রায় চারশত বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রী অধ্যায়ন করছেন। যারা হোস্টেলে আছেন তাদের জন্য ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে তিন বেলা ফ্রি খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এছাড়া, যে সমস্থ ছাত্র-ছাত্রী ইউনিভার্সিটির আশ-পাশে অবস্থান করছেন ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে তাদেরও খোঁজ খবর নিচ্ছেন। এখানকার গ্রোসারি সুপারশপগুলো বিকাল পর্যন্ত খোলা থাকে। আমরা প্রয়োজনমত জিনিস কিনতে পারি। তবে বিনা প্রোয়োজনে বাহিরে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
এদিকে, বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে অধ্যায়নরত অধিকাংশ বাংলাদেশী শিক্ষার্থী ভালো থাকলেও কিছু সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী সমস্যার মধ্যে রয়েছে। আর এর কারণ হচ্ছে ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে অবস্থান না করা অথবা ক্যাম্পাস থেকে দূরে অবস্থান করায় ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছেন না। তাই আমরা বাংলাদেশী স্টুডেন্টস ইউনিয়ন মালয়েশিয়া (BSUM)'র মাধ্যমে নিয়মিত তাদের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে সমস্যা জেনে সমাধান করার চেষ্টা করছি।
জহিরুল ইসলাম, ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালয়েশিয়াত।
করোনা ভাইরাসে যখন চারিদিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন তখন চা হাতে জানালায় দাঁড়িয়ে নিজ মনে এতটুকু উপলব্ধি করলাম, ভালো আছি সুস্থ আছি এটাই অনেক বড় পাওয়া। সম্প্রতি কভিড-১৯ এ মালশিয়াতে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমেরিকা, জার্মানের মত উন্নত দেশগুলোকে আজ খুব অসহায় লাগছে। নভেল করোনা আমাদের কাছ থেকে যা নিয়ে গেছে তা অপূরনীয় কিন্তু আমরা যদি এর থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি অহিংস পৃথিবী গড়ে তুলতে পারি তাহলে ক্ষতি কি।
গত তিন বছর মালয়েশিয়াতে পড়াশুনা করছি, মাস কয়েক পরে গাউন পরে কনভেনশন নিয়ে দেশে ফিরে যাবো। আমাদের প্রত্যাশাপ অপেক্ষায় আছে পরিবার। পড়াশুনার পাশাপাশি চাকুরী করছি একটি টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানিতে। সময় মতো অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে। ওয়ার্ক ফ্রম হোম হোস্টেলে বসে অফিসের কাজও করছি নিয়মিত।
নিজেই রান্না করে খাচ্ছি আর ইউনিভার্সিটি খাবাদের দায়িত্ব নিয়েছে হেস্টেলে থাকা সকল শিক্ষার্থীদের। আমরা যারা বাবা-মায়ের কাছ থেকে দূরে আছি তাদের সকলের কাছে অনুরোধ থাকবে আপনার কোনো গুজবে কান দেবেন না। আর এমন কোনো কিছু করবেন না যাতে পরিবার-পরিজন সব সময় আশঙ্কার মধ্যে থাকে।
প্রতিটি ক্ষেত্রের যেমন ভালো দিক আছে, তেমনি খারাপ দিকও আছে। করোনা ভাইরাসের কোনো ঔষধ এখন কার্যকর ভাবে কাজ করছে না তাই ঘরে থেকে নিজেকে সময় দেওয়াই বড় ঔষধ বলে মনে করছি।
জয়নাবা রাত্রী, সেগি ইউনিভার্সিটি, কোটা দামানসারা।
আমি জেসমিন মোহাম্মাদ জেবারাল হক, মাল্টিমিডিয়া ইউনিভার্সিটির একজন পিএইচডি ক্যান্ডিডেট। লকডাউন বা মুভমেন্ট কন্ট্রোল অর্ডারের (এমসিও) সরকারি ঘোষণার পরই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ও পুরোপুরি লকডাউন করে দেয়া হয়। কেও বের হতে পারবে না এবং বাহির থেকে কিছু সময়ের জন্য ঢুকতে হলে ফ্যাকাল্টি ডিন এবং নিরাপত্তা প্রধানের অনুমতি নিয়ে ঢুকতে হবে। হোস্টেলে অবস্থানরত ছাত্রছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয় ফ্রি খাবার সরবরাহ করছে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় ভালই সহযোগিতা করছে। ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস অনলাইনে পরিচালিত হচ্ছে এবং পোস্টগ্রাজুয়েট রিসার্চ এসিস্ট্যান্টদের বাসায় বসে গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসিয়াল সকল স্টাফদের বাসা থেকে কাজ করতে বলা হয়েছে, ফলে যে কোন সমস্যায় আমরা ইমেইল কিংবা ফোনে সমাধানের জন্য সহজেই যোগাযোগ করতে পারছি। এছাড়া, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থাকে তারা সবাই অতিরিক্ত খাবার আগেই কিনে রেখেছিলাম এবং সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত মুদির দোকান খোলা থাকে, তাই খাবার নিয়ে কোন ঝামেলায় আমরা এখনো পড়িনি।
জেসমিন মোহাম্মাদ জেবারাল হক, মাল্টিমিডিয়া ইউনিভার্সিটি।
মালয়েশিয়ার জিওমাটিকা ইউনিভার্সিটি কলেজে বিবিএ পড়ছেন সামছুন নাহার ইরা। তিনি বলেন, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় এর পক্ষ থেকে সব সময় খোঁজ খবর রাখছেন। তবে এই সময় সকল প্রকার পাঠদান বন্ধ আছে তবে অনলাইনে পাঠদান এর প্রস্তুতি চলছে। বর্তমানে আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য চেষ্টা করছি। কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসন থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ৩১ মার্চ পর্যন্ত প্রথম লকডাউন ছিল যা আগামী ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আশা করি যদি এই সময় আমরা সঠিক নিয়ম-কানুন মেনে চলি এই অবস্থা থেকে আমরা তাহলে অতি সহজে মুক্তি পাবো। সর্বশেষ বলতে চাই, সকল পক্ষের আন্তরিক প্রচেষ্টায় আমরা ভালো আছি, নিরাপদে আছি। আলহামদুলিল্লাহ।
সামছুন নাহার ইরা, জিওমাটিকা ইউনিভার্সিটি কলেজ।
আল মাদীনাহ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলিক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র মির্জা মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, মালয়েশিয়াতে ধীরে ধীরে করোনা ভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে অবস্থিত আমরা যারা বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী আছি। তারা প্রথম দিকে কিছু বিষয় নিয়ে সমস্যার সম্মুখিন হয়েছিলাম তার মধ্যে অন্যতম হলো-
যদি কোনো ছাত্র করোনাতে আক্রান্ত হয় তাহলে কার সাথে কিভাবে যোগাযোগ করতে হবে? আমাদের ইন্সুরেন্স চিকিৎসার খরচ বহন করবে কি না। এছাড়া লকডাউনের সময়ের মধ্যে যাদের ভিসা পুনরায় নবায়নের সময় হবে তারা কি করবে। কারণ লোকডাউন এর এই সময়কালীন সকল প্রকারের ভিসা নবায়ন স্থগিত করা হয়েছে।
এমন কয়েকটি বিষয় নিয়ে আমরা নিজ নিজ ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল ডিপার্টমেন্ট এর সাথে যোগযোগ করলে তারা আমাদেরকে আসস্থ করে বলেন, যে কোনো সমস্যা হলে ভার্সিটিকে আগে জানাতে হবে এবং ভার্সিটি সকল ধরণের সহযোগিতা করবে। এছাড়া, আমাদের ইউনিভার্সিটি তাদের অনলাইনে একটি ডাটাবেজ তৈরী করেছে যেখানে আমাদেরকে প্রত্যেকদিন আমাদের অবস্থান এবং শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে আপডেট দিতে হচ্ছে। আমাদেরকে মাঝে মাঝে ফ্রি প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী বাসায় এসে দিয়ে যাচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ আমরা এখানে ভালো আছি। এছাড়া ও মালয়েশিয়া তে অবস্থিত বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের সংগঠন বিএসইউএমও আমাদের সার্বক্ষণিক খোজখবর রাখছে। তবে দেশ কে নিয়ে আর দেশে অবস্থিত আমাদের পরিবার পরিজনদের নিয়েই আমরা বেশি চিন্তিত।
মির্জা মুস্তাফিজুর রহমান, আল মাদীনাহ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
এহসানুল হক খান শুভ, ইউনিভার্সিটি টেকনিক্যাল মালয়েশিয়া মেলাকা (ইউটিইএম) এ অধ্যয়নরত আছে। মালয়েশিয়ার অন্যান্য স্টেটের চেয়ে মেলাকাতে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ তূলনামূলক কম। দু’জন মৃত্যু বরণ করেছে । ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে যে সব শিক্ষার্থী আছেন তাদেরকে ইউনিভার্সিটি থেকে প্রয়োজনীয় খাবার ও নানবিদ সহযোগীতা করছেন। বাহিরে অবস্থানরত ছাত্র-ছাত্রীদের শুকনা খাবার দেয়া হচ্ছে। কোন ইন্টারন্যাশনাল ছাত্র-ছাত্রী যদি করোনায় আক্রান্ত হয় ইউনিভার্সিটি সকল ব্যবস্থ্যা গ্রহণ করবে বলে প্রত্যাশা দিয়েছে। লকডাউনের কারণে অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে। কিছু কিছু কোর্সের মিড-সেমিস্টার টেস্ট অনলাইনে নেয়ার ঘোষণা দেয়া আছে। চলমান সেমিস্টার বাতিল বা পেছানো হবে কিনা এ ব্যাপারে কিছুই জানা যায়নি এখনো। সব মিলিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে বলে জানান।
এহসানুল হক খান শুভ,ইউনিভার্সিটি টেকনিক্যাল মালয়েশিয়া মেলাকা (ইউটিইএম)।
মোহাম্মাদ বুরহান উদ্দিন একজন পিএইচডি ক্যান্ডিডেট হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটি মালয়শিয়া এ পড়াশোনা করছেন। পাশাপাশি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের পোষ্ট গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট সোসাইটি'র সাধারণ সম্পাদক এবং বিএসইউএম এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন বেলাই বিনামূল্যে খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে, যার জন্য খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। এছাড়া ক্যাম্পাস এলাকার ভিতরে কিছু মুদি দোকান সীমিত পরিশরে খোলা আছে তাই যার যা দরকার তা কিনতে পারছে অতিসহজে। যার ফলে আমাদের বাইরে যাবার প্রয়োজন হচ্ছে না আর প্রশাসনও আমাদের ক্যাম্পাস এলাকার বাইরে যাবার অনুমতি দিচ্ছে না।
ভিসা নবায়ণের বিষয় নিয়ে একটু চিন্তিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যথাযথ সহযোগিতা করার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। আমাদের ইউনিভার্সিটির আশপাশের এলাকাকে রেড জোন হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আশার কথা হলো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এখনো কোনো করোনায় আক্রান্তের খবর পাওয়া যায়নি। আশা করি আমরা ধীরে ধীরে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাবো।
মোহাম্মাদ বুরহান উদ্দিন, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটি মালয়শিয়া।
অনিকা বরকত, ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালয়েশিয়ার শিক্ষার্থী। উচ্চশিক্ষার জন্য পরিবার-পরিজন রেখে এই দুঃসময়ে বিদেশের মাটিতে থাকা চিন্তার বিষয় হলেও অনিকা বলেন আমরা ভালো আছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এর পক্ষ থেকে সব সময় খোঁজ খবর রাখছেন। তবে এই সময় সকল প্রকার পাঠদান বন্ধ আছে। অনলাইনে পাঠদান এর প্রস্তুতি চলছে। বর্তমানে আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য চেষ্টা করছি। ইউনিভার্সিটি এবং সরকার থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ স্টুডেন্ট ইউনিয়ন থেকেও আমাদের খোঁজ নিচ্ছে।
অনিকা বরকত, ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালয়েশিয়া।
উল্লেখ্য, আজ ৩ এপ্রিল শুক্রবার মালয়েশিয়ায় প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসে নতুন আক্রান্ত হয়েছেন ২১৭ জন এবং মারা গেছেন ৩ জন। সর্বমোট মৃত্যু ৫৩ জন ও আক্রান্ত ৩৩৩৩ জন।
আরকে/