নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে যেভাবে বাঁচলেন তিন করোনা রোগী
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১০:২০ এএম, ৪ এপ্রিল ২০২০ শনিবার | আপডেট: ১০:২৮ এএম, ৪ এপ্রিল ২০২০ শনিবার
ব্রিটেনে করোনা ভাইরাস মৃত্যুর সংখ্যা এখন তিন হাজারেরও বেশি। কিন্তু তারপরও তেত্রিশ হাজারের বেশি সংক্রমিত মানুষের মধ্যে অনেকেই সম্পূর্ণভাবে সেরে উঠেছেন।
এদের মধ্যে বেশিরভাগেরই উপসর্গ তেমন গুরুতর ছিল না। কারও কারও দেহে কোন উপসর্গই দেখা যায়নি। কিন্তু অনেকের দেহে কোভিড-১৯ এর উপস্থিতি শনাক্ত হওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।
এধরনের তিনজনের সাথে কথা বলেছে - যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এবং এখন সেরে উঠেছেন।
'আমার আর আমার বাচ্চার জীবন রক্ষার লড়াই একসাথে চলছিল'
ক্যারেন ম্যানারিং ইংল্যান্ডের কেন্ট-এ থাকেন। তিনি যখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন তখন তিনি ছয়মাসের অন্ত:সত্ত্বা। তিনি তার চতুর্থ সন্তানের জন্মদানের জন্য তৈরি হচ্ছিলেন।
মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে তার জ্বর এবং প্রচণ্ড কাশি শুরু হয়। কিন্তু ডাক্তাররা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে চায়নি। এই অবস্থা নিয়ে ১১ দিন পার হওয়ার পর তার অবস্থার অবনতি ঘটে।
"আমি ফোনে ৯৯৯ ডায়াল করি। আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে ফোন করার কয়েক মিনিটের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স এসে হাজির হয়," ক্যারেন বলছিলেন, "শ্বাস নেয়ার জন্য আমাকে রীতিমত লড়াই করতে হচ্ছিল। তারা আমাকে সাথে সাথে অক্সিজেন দিতে শুরু করে।"
ক্যারেনের দেহে পরীক্ষার পর করোনাভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়ে। তার দুটি ফুসফুসেই নিউমোনিয়া ধরা পড়ে। হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে তাকে এক সপ্তাহ ভর্তি থাকতে হয়।
সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলছিলেন, "কাউকে আমার কাছে আসতে দেয়া হতো না। সেটা ছিল আমার জন্য একেবারেই দু:সময়। খুবই নি:সঙ্গ ছিলাম।"
"দুই-তিন দিন আমি একেবারে বিছানায় পড়ে ছিলাম। টয়লেটে যাওয়ার শক্তি ছিল না। হাসপাতালের বিছানার চাদর বদলাতে হলে আগে আমাকে উল্টে দিতে হতো।"
"যখন আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হতো তখন আমি বেল টিপে নার্সদের ডাকতাম। কিন্তু তারা সাথে সাথে আমার কাছে আসতে পারতো না। তাদের আগে নিরাপদ পোশাক পরতে হতো এবং শুধুমাত্র তারপরই তারা আমার কাছে আসতে পারতো।"
"তবে আমি সারাক্ষণ আমার পরিবারের সাথে ফোনে কথা বলতাম। তারাই আমাকে সাহস যোগাতো। আমার ভয় হতো যে আমি বোধহয় আর বাঁচবো না। আমার পরিবারও আমার জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছিল।
"প্রতিবার নিশ্বাস নেয়ার সময় আমাকে খুব কষ্ট করতে হতো। আমি আমার নিজের জীবন এর আমার বাচ্চার জীবনের জন্য লড়ে যাচ্ছিলাম।"
ক্যারেন জানালেন, যেদিন তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন সেদিনের স্মৃতি তার এখনও মনে আছে। হাসপাতালের দরোজার বাইরে পা রাখা মাত্রই ঠাণ্ডা তাজা বাতাস তার মুখে পরশ বুলিয়ে দিয়েছিল।
"বাড়ি ফেরার সময় আমার মুখ মাস্ক-ঢাকা ছিল। কিন্তু গাড়ির জানালা সেদিন আমি খুলে রেখেছিলাম। বাতাসের স্পর্শ খুব ভাল লাগছিল। জীবনের তুচ্ছ বিষয়গুলোকেও অনেক মূল্যবান বলে মনে হচ্ছিল।"
'আমি চাইছিলাম কেউ আমাকে একটু সাহায্য করুক'
জেসি ক্লার্ক জানতেন তিনি করোনাভাইরাসের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। তিনি কঠিন এক কিডনির রোগে ভুগছিলেন। পাঁচ বছর আগে তার একটি কিডনি ফেলে দিতে হয়েছিল।
২৬-বছর বয়সী শেফিল্ড শহরের এই বাসিন্দা যেদিন থেকে প্রচন্ডভাবে কাশতে শুরু করলেন এবং তার শ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে লাগলো, তখন তিনি বুঝলেন পরিস্থিতি গুরুতর। আর এর কয়েকদিনের মধ্যে তার হাঁটাচলার শক্তিও থাকলো না।
"আমার বুকের পাঁজর, পিঠ এবং পেটে প্রচণ্ড ব্যথা দেখা দিয়েছিল," বলছিলেন জেসি, "মনে হচ্ছিল আমার সারা শরীরে কেউ খুব করে পিটিয়েছে।"
প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যেদিন ব্রিটেনে লকডাউন ঘোষণা করলেন - তার দু'দিন পর জেসির বয়ফ্রেন্ড টম তাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। কিন্তু নিরাপত্তার খাতিরে জেসিকে সাথে সাথে আলাদা ঘরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়।
"একা একা থাকতে আমার খুব ভয় করতো। কিন্তু আমার অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে আমি চাইতাম কেউ আমাকে একটু সাহায্য করুক," জেসি বলছেন, "আমাকে একটি সবুজ মাস্ক পরিয়ে দেয়া হলো। এরপর আমাকে যে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে শুধুমাত্র কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা করা হচ্ছিল। ওয়ার্ডে প্রতিটা বেড ছিল আলাদা। প্রতিটি রোগীর ক্ষেত্রে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা হচ্ছিল।"
"আমার করোনাভাইরাস পরীক্ষা হয়নি। তবে ডাক্তার আমাকে জানালেন সবার পরীক্ষার প্রয়োজন হবে না। কারণ আমার যে করোনাভাইরাস হয়েছে তা দেখেই বলে দেয়া যায়। ডাক্তার আমাকে বললেন, আমার ফুসফুসে প্রদাহের জন্যই আমার শরীরে ব্যথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, আমাকে স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকতে হবে এবং পেইনকিলার খেতে হবে।"
"এর আগে আমি কখনই শ্বাসকষ্টে ভুগিনি। কিন্তু আর শ্বাস নিতে পারবো কিনা, কিংবা এটাই এই ভাইরাসের স্বাভাবিক উপসর্গ কিনা, সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকা খুবই ভয়ের ব্যাপার।
জেসিকে ছয় ঘণ্টা হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। কিন্তু বাড়ি ফেরার পাঁচদিন পরও জেসি ঠিকমত হাঁটাচলা করতে পারছিলেন না। তার শরীর এতটাই দুর্বল হয়ে গিয়েছিল যে তিনি দিনে ১৮ ঘণ্টা করে ঘুমাতেন।
"বয়স যাদের কম তাদের কারো কারো মনে এই বিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে করোনাভাইরাস তাদের ছুঁতে পারবে না," জেসি বলছেন, "কিন্তু এখন সেই ধারণা পাল্টে গেছে। এখন তারা একে গুরুত্বের সাথেই নিচ্ছে।"
'আমি খুবই অন্ধকার এক জায়গায় চলে যাচ্ছিলাম'
স্টুয়ার্ট বয়েলের দৃঢ় বিশ্বাস, কয়েক সপ্তাহ আগে গির্জার এক বৈঠক থেকেই তিনি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হন।
"বৃহস্পতিবার ঐ বৈঠকে আমরা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেছিলাম। কিন্তু রবিবারের মধ্যে আমাদের অনেকের মধ্যে ফ্লুয়ের মতো উপসর্গ দেখা দেয়," বলছিলেন তিনি।
এর পরের ১০ দিনের মধ্যে ৬৪-বছর বয়সী স্টুয়ার্টের অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে।
"প্রথমদিকে সমস্যাটা ছিল বেশি বোঝা যাচ্ছিল না," তিনি ব্যাখ্যা করছেন, "কিন্তু সিঁড়ি বেয়ে ওপরতলায় ওঠার সময় আমি বুড়ো মানুষের মতো হাঁপাচ্ছিলাম। কিছুদিনের মধ্যেই আমার হাঁটাচলা করার ক্ষমতাও চলে গেল। ভাইরাস আমার ফুসফুসকে আক্রমণ করে বসলো, আর তাকে ঠেকানোর কোন ক্ষমতাই আর আমার রইলো না।"
স্টুয়ার্টের পরিবার তখন অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আনে এবং তাকে হাসপাতালে সরিয়ে নেয়া হয়।
"ব্যাপারটা সিনেমার মত করে ঘটলো," বলছিলেন তিনি, "তারা আমাকে হাসপাতালের 'রেড জোন'-এ নিয়ে গেল। সেখানে নানা রকম পরীক্ষা চালানো হলো। তারা বুঝতে পারলো আমার করোনাভাইরাস হয়েছে। এরপর তারা আমার ফুসফুসে অক্সিজেন দেয়া শুরু করলো।"
"এর পরের কয়েক ঘণ্টা ধরে আমি বেশ কয়েকবার এমন একটা জায়গার কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম যে জায়গাটা ছিল খুবই অন্ধকার। আমার ভাবলাম, 'এই বোধহয় শেষ।' কিন্তু আমি বাঁচতে চাইছিলাম।"
"আমার ফুসফুসের ভেতরে যে লড়াই চলছিল তা আমি খুব টের পাচ্ছিলাম। আমার অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে এই লড়াই চালাতে হয়েছিল। অতিরিক্ত অক্সিজেন পাওয়ার পর আমার দেহ বল ফিরে পায় এবং অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে ভাইরাসকে দেহ থেকে বের করে দেয়। হাসপাতালের কর্মীরা কাজ করছিলেন চমৎকারভাবে। কিন্তু আপনাকে সাহায্য করার চাইতে বেশি কিছু তারা করতে পারবেন না। এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে নেই কোন ওষুধ। আপনাকে একমাত্র রক্ষা করতে পারবে আপনার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা।"
গত শনিবার স্টুয়ার্টকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরিয়ে আনা হয়।
তিনি বাড়িতে এখন স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।
তার শ্বাসনালী এবং ফুসফুসের উপশমের জন্য তিনি প্রচুর পানি পান করছেন।
সূত্র: বিবিসি