বিপদে ‘ভগবদগীতা’র প্রার্থনা
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৩:৩৯ পিএম, ৪ এপ্রিল ২০২০ শনিবার
প্রার্থনা হচ্ছে একাগ্রচিত্তে চাওয়া এবং পাওয়ার প্রক্রিয়ায় নিজেকে বিলীন করে দেয়া। প্রার্থনায় অবিচল বিশ্বাস ও সেই সঙ্গে নিরলস পরিশ্রম করলেই বুঝতে হবে প্রার্থনার সাথে প্রার্থনাকারী একাকার হয়ে গেছেন। স্রষ্টা প্রার্থনা পছন্দ করেন এবং তা কবুল করেন। তিনি আপনার প্রার্থনার ফল সঙ্গে সঙ্গে বা যথোপযুক্ত সময়ে বা পরকালে দিতে পারেন। গীবতকারী, হারামখোর, দুর্নীতিবাজ ও জালেমের প্রার্থনা কবুল হয় না। তবে সর্বান্তকরণে তওবা করলে ভিন্ন কথা। শাশ্বত ধর্মীয় শিক্ষার আলোকে মাতৃভাষায় গ্রন্থিত এ প্রার্থনায় আসুন সবাই নিমগ্ন হই অনন্ত কল্যাণের প্রত্যাশায়।
আসুন জানার চেষ্টা করি প্রার্থনার বিষয়ে ‘ভগবদগীতা’ কি বলেছে,
যখনই ধর্মের অবক্ষয় এবং অধর্মের উত্থান ঘটে, হে ভারত! তখনই আমি আবির্ভূত হই। দুষ্টের বিনাশ এবং সজ্জনের রক্ষায়
ধর্ম প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত আমি আসি যুগে যুগে।
-জ্ঞানযোগ: ৭-৮
শাশ্বত সত্যের গান: সনাতন হিন্দু ধর্মের মূল শাস্ত্রগ্রন্থ বেদ। বেদের জ্ঞানের নির্যাস উপনিষদ। উপনিষদের নির্যাস ভগবদ্গীতা। তাই যুগে যুগে কোটি কোটি ভক্তের কণ্ঠে বার বার উচ্চারিত হয়েছে গীতার শ্লোক। পরমেশ্বরের বাণী আলোকিত করেছে তাদের চেতনালোক। উদ্বেলিত করেছে তাদের হৃদয়, প্রশান্ত হয়েছে মন। ভগবদ্গীতায় রয়েছে সেই শাশ্বত বাণী-ঈশ্বরার্থে সকল কর্ম করো।
আসক্তি ত্যাগ করো। ইন্দ্রিয়সংযম করো। ত্যাগী হও। দাতা হও। তুমি মোক্ষ লাভ করবে।
১.
চিন্তা করলে আসক্তি সৃষ্টি হয়; আসক্তি সৃষ্টি করে কাম। কাম পরিণত হয় ক্রোধে। ক্রোধ বিচারবুদ্ধি নষ্ট করে। দ্বিধাদ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। চিত্তকে বিক্ষিপ্ত করে। চিত্ত বিক্ষিপ্ততা ও বুদ্ধিবিভ্রম মানুষের সর্বনাশের কারণ হয়। [সাংখ্যযোগ : ৬২-৬৩]
২.
প্রশান্তচিত্ততা সর্বদুঃখের বিনাশ ঘটায়; শুভবুদ্ধির ঘটায় উন্মেষ। বিদ্যা-বুদ্ধি স্থিতি লাভ করে। [সাংখ্যযোগ : ৬৫]
৩.
প্রশান্ত মনই আত্মজয়ী। তিনি সংযুক্ত হন পরমাত্মার সাথে, সুখ-দুঃখ, সম্মান বা অপমানে তিনি সমভাবে অবিচলিত। [ধ্যানযোগ:৭]
৪.
জল যেমন পদ্মপাতাকে সিক্ত করতে পারে না, তেমনি যিনি ঈশ্বরার্থে সকল কর্ম করেন, পাপ তাকে স্পর্শ করতে পারে না। [সন্ন্যাসযোগ: ১০]
৫.
মানুষের অধিকার শুধু কর্মে। ফলে তার অধিকার নাই। কাজ করো। নিজেকে কর্মফলের কারক মনে কোরো না। আবার নিজেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে দিও না। [সাংখ্যযোগ : ৪৭]
৬.
ধর্মযুদ্ধে নিহত হলে তুমি স্বর্গ লাভ করবে। আর জয়ী হলে রাজ্য ভোগ করবে। হে অর্জুন! ধর্মযুদ্ধই তোমার স্বধর্ম। তাই সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, জয়-পরাজয়কে সমান মনে করে তুমি যুদ্ধে অবতীর্ণ হও। [সাংখ্যযোগ : ৩৭-৩৮]
৭.
অহিংসা, অকপটতা, বিনয়, ক্ষমা, সহিষ্ণুতা, আত্মসংযম, গুরুসেবা, ইন্দ্রিয়সুখে অনীহা, প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ, স্ত্রী-পুত্র বা সম্পদে অনাসক্তি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, অভিমানশূন্যতা, ভোগীদের সংসর্গ ত্যাগ, শুভাশুভতে সাম্যভাব, অবিচল বিশ্বাস ও ঈশ্বরে নির্ভরতা, আত্মানুসন্ধানে ধ্যানে নিমগ্নতা-এই গুণাবলিই যথার্থ বিদ্যা বা জ্ঞান। এর বিপরীত সবকিছুই অবিদ্যা। [ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞবিভাগযোগ : ৭-১১]
৮.
অবিদ্যা-আক্রান্ত, অবিশ্বাসী ও সন্দিগ্ধচিত্তরা সবসময় বিনাশিত হয়। সংশয়ী মানুষের ইহকাল বা পরকালÑকোনো কালেই সুখ নাই। অতএব তোমার অবিদ্যাপ্রসূত সংশয় জ্ঞানরূপ খড়গের আঘাতে ছিন্ন করো। ব্রহ্মজ্ঞানের শ্রেষ্ঠমার্গ নিষ্কাম কর্মযোগ অবলম্বন করে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ো। [জ্ঞানযোগ : ৪০-৪২]
৯.
ব্রহ্মজ্ঞান সকল অবিদ্যানাশক। জ্ঞানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনোকিছুই ইহলোক-পরলোকে নাই। দীর্ঘ সাধনা দ্বারাই ব্রহ্মজ্ঞানে অন্তর উদ্ভাসিত হয়। ব্রহ্মজ্ঞানে অন্তর উদ্ভাসিত হলেই পরম প্রশান্তি বা মোক্ষ লাভ হয়। [জ্ঞানযোগ : ৩৮-৩৯]
১০.
মহিলা, বৈশ্য, শুদ্র বা নিকৃষ্টজন্মা ব্যক্তিও পরমেশ্বরে সমর্পিত হয়ে মোক্ষ লাভ করতে পারে। [রাজগুহ্যযোগ : ৩২]
১১.
ক্রমাগত সাধনা দ্বারা ভয়শূন্য, ক্রোধবর্জিত, আসক্তি-রহিত এবং আমাতে সমর্পিত হয়ে অতীতে বহুজন আমার গুণে গুণান্বিত হয়েছেন। হে অর্জুন! যে যে-রূপে আমাকে উপাসনা করে, আমি সে-রূপেই তার সামনে উদ্ভাসিত হই। [জ্ঞানযোগ: ১০-১১]
১২.
সৎ গুরুতে সমর্পিত হও। বিনম্রচিত্তে জানতে চাও। অকৃত্রিম সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দাও। তা হলেই তুমি তার কাছ থেকে
ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে পারবে। [জ্ঞানযোগ : ৩৪]
১৩.
অসুররা (দানবীয় স্বভাবের ব্যক্তিরা) বলে, এ জগতে সত্যাসত্য বলে কিছু নাই, কোনো নীতি-নৈতিকতা নাই, ধর্ম নাই, ঈশ্বর নাই। কাম থেকে এর সৃষ্টি কামেই সমাপ্তি। [দৈবাসুরসম্পদ্বিভাগযোগ : ৮]
১৪.
একজন দুরাচারী ব্যক্তিও যদি সকল অন্যায় পরিত্যাগ করে আমার আন্তরিক ভজনায় নিমগ্ন হয়, তবে তার শুভসংকল্পের জন্যে তাকে সাধু মনে করা যেতে পারে। তিনি দ্রুত ধার্মিক হয়ে প্রশান্তি লাভ করবেন। আমার আন্তরিক ভক্ত কখনো ধ্বংস হতে পারে না। [রাজগুহ্যযোগ : ৩০-৩১]
১৫.
স্থান-কাল বিবেচনা করে কোনো প্রতিদানের প্রত্যাশা না করে উপযুক্ত পাত্রে প্রদত্ত দান সাত্ত্বিক বা উত্তম দান। প্রতিদানের প্রত্যাশায় অনিচ্ছাসত্তে প্রদত্ত দানকে রাজসিক দান বলা হয়। অযোগ্য পাত্রে অনাদরে এবং অবজ্ঞা সহকারে যে দান, তা হচ্ছে তামসিক। [শ্রদ্ধাত্রয়বিভাগযোগ : ২০-২২]
১৬.
কর্মফল চিন্তামুক্ত, কামনা-বাসনা রহিত, দুঃখ ও আনন্দকে সমভাবে গ্রহণকারীই নিত্য সন্ন্যাসী। তিনি অনায়াসে সকল বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেন। [সন্ন্যাসযোগ : ৩]
১৭.
বিশুদ্ধ বুদ্ধিতে পারঙ্গম হয়ে ইন্দ্রিয়সমূহ বশীভূত করে, আসক্তি ও দ্বেষ বর্জন করে নির্জনবাস, স্বল্পাহার, বাকসংযম ও ধ্যানে নিবিষ্ট হয়ে দেহ ও মনের ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ এনে অহংকার, দম্ভ, লোভ, কাম, ক্রোধ ও পরিগ্রহ থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়েই একজন ব্রাহ্মণ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। [মোক্ষযোগ : ৫১-৫৩]
১৮.
অতিভোজী, নিতান্ত অনাহারী, অতি ঘুমবিলাসী, একেবারেই কম ঘুমায় তারা কখনো ধ্যানে সফল হয় না। যিনি নিয়মানুযায়ী আহার করেন, কাজ করেন, বিশ্রাম নেন, যার নিদ্রা ও জাগরণ নিয়মের ছন্দে ছন্দায়িত, তিনি ধ্যানে সফল হন। তার দুঃখের বিনাশ ঘটে। বিচরণ করেন আত্মার আনন্দলোকে। [ধ্যানযোগ : ১৬-১৭]
১৯.
যোগী যিনি তিনি দুটি পথ জানেন। তিনি কখনো অন্ধকার গহ্বরে পতিত হন না। অতএব হে অর্জুন! তুমি সর্বদা ব্রহ্মজ্ঞানে সমাহিত হও। দুটি পথ সম্পর্কে যিনি সুস্পষ্টভাবে জানেন এবং সমর্পিতের পথে চলেন, তিনি বেদ পাঠ, যজ্ঞানুষ্ঠান ও দানের চেয়ে অধিক পুণ্যে আপ্লুত হন। ভক্তযোগী প্রত্যাবর্তন করেন পরম সত্তায়। [অক্ষরব্রহ্মযোগ: ২৭-২৮]
২০.
অতএব তোমার মনকে আমাতেই সমাহিত করো, সকল যুক্তিবুদ্ধি আমাতেই নিবিষ্ট করো। নিঃসন্দেহে অনন্তলোকে তুমি আমার সাথেই থাকবে। যদি একাগ্রচিত্তে মনকে আমার প্রতি নিবিষ্ট করতে না পারো, তবে যোগাভ্যাসের মাধ্যমে বার বার আমাকে পেতে সচেষ্ট হও। তুমি যদি ক্রমাগত যোগাভ্যাস করতে অক্ষম হও তবে ঈশ্বরের পছন্দনীয় কর্মে একনিষ্ঠ হও। ঈশ্বরের পছন্দনীয় কাজ করতে করতেই তুমি সিদ্ধিলাভ করবে। আর যদি তাতেও অসমর্থ হও তবে ইন্দ্রিয় সংযমপূর্বক সর্বকর্ম আমাতে সমর্পিত করো। [ভক্তিযোগ : ৮-১১]
(মহাজাতক’র ‘আলোকিত জীবনের হাজার সূত্র: কোয়ান্টাম কণিকা’ বই থেকে নেওয়া)
এমএস/