ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

ত্রাণ কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতা প্রয়োজন নীতিমালা

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

প্রকাশিত : ০৪:৫৩ পিএম, ৬ এপ্রিল ২০২০ সোমবার | আপডেট: ০৯:০৪ পিএম, ৮ এপ্রিল ২০২০ বুধবার

নষ্ট ভাত ধুয়ে শুকিয়ে চাল বানাচ্ছেন ৭০ বছরের বৃদ্ধা সাবিয়া বেগম- সংগৃহীত

নষ্ট ভাত ধুয়ে শুকিয়ে চাল বানাচ্ছেন ৭০ বছরের বৃদ্ধা সাবিয়া বেগম- সংগৃহীত

অবশেষে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের আক্রমনে সবকিছু স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রায় অর্ধ মাস ধরে চলা বিছিন্নতার (লকডাউন) জন্য বিড়ম্বনায় পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। কাজ না থাকলে যাদের চলে না তাদের জীবন ধারণের সংকট দেখা দিচ্ছে। এ অবস্থায় অন্যের সাহায্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। 

সারাদেশে বিচ্ছিন্নভাবে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু হলেও বেশির ভাগ নিম্ন আয়ের মানুষরা এসব পাচ্ছেন না। কারণ এসব ত্রাণ কার্যক্রমে বেশির ভাগ ধারাবাহিকতা এখনও আসেনি। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থা এবং বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থা শহরে এবং শহর এলাকার বাইরে গ্রামে স্বল্প পরিসরে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। 

রোববার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ত্রাণপ্রার্থী অসহায় মানুষকে দলবেঁধে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। কেউ কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও কিছুই পাচ্ছেন না। এমনই একজন মালিবাগ এলাকার আব্বাস আলী। তিনি জানান, খেটে খাওয়া মানুষ তিনি। সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন আব্বাস আলী। এখন তাকে মানুষের কাছে হাত পাততে হচ্ছে কিছু ত্রাণ পেলে তিনি আর বের হবেন না। ধানমন্ডি এলাকায় কথা হয় কুলসুম বেগমের সঙ্গে। তিনি বাচ্চাসহ অপেক্ষা করছেন ত্রাণের জন্য। কোনো গাড়ি এসে থামলেই মনে করেন এই বুঝি ত্রাণ এলো। তাই দৌড়ে যান গাড়ির কাছে। কিন্তু তার সঙ্গে যখন কথা হয়, তিনি জানান এখন পর্যন্ত কিছু পাননি। তাই অপেক্ষা করে আছেন। তিনি বলেন, ‘এখানে ভিক্ষা করে পরিবার চালাতাম। কিন্তু এখন রাস্তায় কোনো মানুষ নেই। তাই ভিক্ষাও পাচ্ছি না।’ নিম্ন আয়ের এমন ত্রাণ প্রার্থীদের শহরের অলিগলিতে দেখা গেলেও মধ্যবিত্ত অনেক মানুষই রাস্তায় নামেতে পারছেন না। তারাও অনেকে কষ্টে আছে বলে জানা যায়। 

এখন ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে বিচ্ছিন্নভাবে। বিশেষ করে ব্যক্তি উদ্যোগে দেয়া সাহায্যদাতার নিজ নিজ এলাকায় ত্রাণ দেওয়ার ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলে ভালো হয় বলে মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। তারা বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাকে ভিন্ন ভিন্ন আকারে ভাগ করে দেওয়া যেতে পারে। নির্দিষ্ট করা থাকলে দাতা এবং গ্রহীতার সমন্বয় করা সহজ হয়। এ ক্ষেত্রে যথাযথ মানুষজনের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হয়। যারা রাস্তায় নামতে পারছেন তারাই শুধু ত্রাণ পাচ্ছেন। যারা রাস্তায় যেতে পাড়ছেন না তারা ত্রাণ পাচ্ছেন না। আবার রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও সাহায্য পাচ্ছেন না কেউ কেউ। 

ঢাকার একটি এলাকায় বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ দেয়া হয়। সেই সাহায্য নেয়ার জন্য মানুষের ভিড়- বিবিসি

ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন’র (ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি) উদ্যোগে ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। এ ত্রাণ বিতরণ ধীরে ধীরে বিভিন্ন এলাকায় চলছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন যারা লোক লজ্জার ভয়ে হাত পেতে নিতে পারেন না তাদের জন্য হটলাইন চালু করেছে। যেখানে ফোন দিলে খাবার না থাকলে ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়। কিন্তু বেশির ভাগ অসহায় ও দুস্থদের কাছে সিটি করপোরেশনের এ উদ্যোগের কথা এখনও পৌঁছায়নি।

গত কয়েকদিন ধরে মতিঝিল ও সেগুনবাগিচা এলাকায় ত্রাণ দিচ্ছে ‘সঙ্গে থাকি’ নামক সংগঠন। এ সংগঠনের প্রধান জসিম উদ্দিন খান বলেন ‘রাস্তায় নেমে ত্রাণ বিতরণ করা কঠিন হয়ে উঠেছে। কারণ ত্রাণ দিতে দেখলেই মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এতো বেশি মানুষ আসে যে তাদের সবাইকে দেয়া সম্ভব হয়ে উঠছে না।’ তিনি জানান, এখন তারা একটা অ্যাপ তৈরী করছেন। রাজধানীর মধ্যে কেউ তাদের কাছে সাহায্যের আবেদন করলেই তারা বাসায় পৌঁছে দিচ্ছেন সাহায্য। 

এদিকে তালিকা প্রস্তুত করে বাসা বা বাড়িতে গিয়ে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিতে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অনেক জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিম্ন আয়ের ঐ সব মানুষের বাসা বা বাড়িতে গিয়ে ত্রাণ বিতরণ করছেন। তবে ত্রাণ দেওয়ার ঐ ছবি জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের ফেইসবুক পাতায় ছড়িয়ে দিচ্ছেন তারা। এ সব ছবিতে সারাদেশের হাজার হাজার মানুষ লাইক, শেয়ার ও কমেন্টস করছেন। এতে সামাজিকভাবে বিব্রত হচ্ছেন দুর্যোগকালীন কর্মহীন নিম্ন আয়ের মানুষজন। 

অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে এর বিপরীত চিত্রও দেখা গেছে। অনেক কর্মকর্তা আবার নীরবে ত্রাণ বিতরণ করে যাচ্ছেন। এই দুর্যোগে দিনরাত জনগণের সেবায় ব্যস্ত রয়েছেন। ত্রাণ কাজে সাধারণের পাশে গোপনে দাঁড়িয়ে অধস্তনের কাজ দেখভাল করছেন। করছেন না কোনো ফটোসেশন।

ত্রাণের দ্রব্য প্রস্তুত করা হচ্ছে- একুশে টেলিভিশন

এছাড়া ত্রাণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় সামাজিক দূরত্ব বা স্যোসাল ডিসটেন্স মানা হচ্ছে না বলে অনেকে অভিযোগ করেন। গাদাগাদি লাইনে দাঁড়িয়ে এবং ত্রাণ নিতে ভীড় করছেন ত্রাণ প্রত্যাশীরা। এতে সামাজিক সুরক্ষা ও দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে না। 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. সানজিদা ফরহানা একুশে টেলিভিশনকে বলেন, ‘কিছুটা সমন্বয়হীনতা কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক সমন্বয় জরুরী। অতিসত্ত্বর এলাকাভিত্তিক কমিটি করে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করতে বা অব্যাহত রাখতে হবে। ঐ কমিটিরই দায়িত্ব থাকবে সংশ্লিষ্ট এলাকায় ত্রাণ কার্যক্রম নিশ্চিত করা।’ ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালার প্রয়োজন রয়েছে উল্লেখ করে এ নৃবিজ্ঞানী বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রায়ই বিভিন্ন দুর্যোগ দেখা দেয়। এক্ষেত্রে একটা নীতিমালা অবশ্যই জরুরী। এ নীতিমালায় ত্রাণদাতা থেকে শুরু করে ত্রাণ প্রত্যাশী এবং এসবের সমন্বয়ের কথা উল্লেখ থাকবে।’ 

ত্রাণ প্রত্যাশী অনেক ক্ষেত্রে প্রাপ্যের চেয়ে বেশি পেতে বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেন এবং বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বপ্রাপ্তরা লুটপাটু করে থাকেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন ঘটার কারন কি দেখেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উন্নত দেশে বিভিন্ন দুর্যোগ হলেও এমন কিন্তু ঘটে না। আমাদের দেশে এমন ঘটার কারন হলে আমরা সমাজের চাপের চেয়ে আইন ও শাস্তির চাপটাই বেশি দেখি। অর্থাৎ শাস্তি ও আইনের ভয় আছে কিন্তু সমাজ কি মনে করবে বা আমি এমনটি করতে পারি না সেই নৈতিকতা বিলুপ্ত।’

এমএস/