ঢাকা, রবিবার   ০১ ডিসেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১৭ ১৪৩১

রূপালী আঁধার

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:২৯ পিএম, ৭ এপ্রিল ২০২০ মঙ্গলবার | আপডেট: ১০:৩০ পিএম, ৭ এপ্রিল ২০২০ মঙ্গলবার

মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় ট্রেনে। কপোতাক্ষ এক্সপ্রেসে রাজশাহী থেকে নওয়াপাড়া যাওয়ার পথে সে ছিল আমার সহগামিনী। বয়স বোধকরি বাইশ-তেইশ বছর হবে। সঙ্গে ছিল একটি ছোট ফুটফুটে পরীর মতন মেয়ে। মুখোমুখি আসনে বসে ছিলাম আমরা। সুযোগ পেলেই মেয়েটি আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিল। টের পেয়ে আমিও মেয়েটির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠলাম। তখন সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। এ বয়সে সাধারণত মানুষ কৌতূহল প্রবণ হয় বেশি। একহারা গড়নের মেয়েটির বড় বড় মায়াবী চোখের চাহনি আমাকেও মেয়েটির প্রতি সেদিন আগ্রহী করে তুলল। 


কোন প্রকার ভণিতা না করেই মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম
কোথায় যাবেন আপনি?
খুলনা।
তুমি কোথায় যাবে?
আমি অনেকটা বিব্রত আর সেই সাথে অবাক হলাম। অপরিচিত কেও সম্বোধন করছে তুমি, তাও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কোন ছাত্রকে। সম্মানে ঘা লাগলো খুউব। ভাবলাম, কথা বলা এটুকুই থাকুক, কিন্তু মেয়েটির সরলতা, মায়াবী চোখের চাহনি, আর অপরূপ সৌন্দর্য আমাকে চুপ থাকতে দিলো না। 
গলাঝেড়ে সংকোচে বললাম-
আমিও আপনার গন্তব্যের কাছাকাছি কোথাও যাবো।
মেয়েটি একগাল হেসে পুনরায় বলল
এটা কেমন কথা হলো?
কাছাকাছি বলতে কি বুঝাতে চাইছ তুমি?
নওয়াপাড়া, খুলনা কিংবা তোমার গন্তব্য যেখানে, সেটা বলো।
আমি চুপ করে রইলাম। ভাবলাম কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। যত কথা বলবো, তত ভুল হবে। তার চেয়ে ভালো, চুপ থাকা। আমাদের ধর্মও তো তাই বলে। চুপচাপ ছিলাম বেশ খানিকটা সময়, কিন্তু সাথে থাকা ছোট মেয়েটি আমাকে চুপ করে থাকতে দিলো না। ওর মায়ের কাছ থেকে মেয়েটি আমার কোলে এসে বসলো। বসে অনর্গল কথা বলতে লাগলো। ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে বিশ্বচরাচর সম্পর্কে সবকিছু আমার কাছ থেকে জানতে চেষ্টা করলো। 
ওর মা যথাসম্ভব মেয়েটিকে নিবারণ করার চেষ্টা করে যখন বিফল হলো, তখন মুচকি হেসে বললো
তুমি কিছু মনে করো না। ছোটবেলা থেকে মা ছাড়া কাউকে পায়নি তো, তাই কাউকে ভালো লাগলে অকারণ বিরক্ত করতে থাকে।
না  না, এটাকে বিরক্ত বলছেন কেন ? 
বাবা, চাচা– কিংবা আপনজন কেউ নেই ওর ?
মেয়েটির মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো
থাক এসব।
ও আচ্ছা, তোমার নাম তো বললে না?
আমার নাম লুৎফর, লুৎফর রহমান।
কে কে আছে তোমার বাড়িতে?
মা আর ছোট বোন যামিনী; বাবা মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর হয়।
বা! চমৎকার নাম তোমার ছোট বোনের।
হুম, নামটি আমার নানা রেখেছিলেন। আমার নানা ছিলেন কবিয়াল। মুখে মুখে গান রচনা করতে পারতেন। বেশ সাহিত্যিক রস ছিল তার মধ্যে। ছোট বোনটির জন্মের পর নানা আমার মাকে বললেন, 
ওর নাম রাখলাম যামিনী।
যামিনী ; মানে রাত্রি, আমাদের মা মেয়ের জীবন যেমন।
আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
আমার বোনের নামের সাথে আপনার আর আপনার মেয়ের জীবনের কি সম্পর্ক বুঝলাম না?
মেয়েটি একটু মুচকি হাসার চেষ্টা করলো। লক্ষ্য করে দেখলাম, হাসির অন্তরালে যেন শ্রাবণের মেঘরাশি মেয়েটির সমস্ত ফর্সা মুখমণ্ডলকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। আমি আর কথা বাড়ালাম না। 
আমার নীরবতা দেখে মেয়েটি প্রসঙ্গ পাল্টে বললো
তুমি কোথায় যাবে, বললে না?
নওয়াপাড়া যাব।
তারপর দু’জনেই নীরবে বসে রইলাম। ট্রেন ছুটছে পাগলা ঘোড়ার মতন দুরন্ত বেগে। রাতের অন্ধকার সেই সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছে সমানতালে। 

কৃষ্ণপক্ষের রাত। মধ্যরাত পার হলে আকাশে চাঁদের দেখা মিললো। চাঁদের ক্ষীণ আলো এসে পড়ছে মেয়েটির সমস্ত শরীর জোড়ে। সে আলোয় মেয়েটিকে অপরূপ মায়াবতী লাগছে। ট্রেনের সবাই প্রায় ঘুমে অচেতন। 
মেয়েটি কাছে এসে চুপিচুপি বললো
একটা কথা বলবো, রাখবে?
আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম।
মেয়েটি দুঃখিত গলায় বলল
তোমার ঠিকানাটা আমাকে দেবে?
মেয়েটির প্রতি আমি ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ে ছিলাম; 
কোনো কিছু না ভেবেই বললাম
কেন নয়?
পকেটে একটা পুরনো চিঠি ছিল। মায়ের লেখা চিঠি। চিঠি সমেত খামটি আমি মেয়েটির হাতে এগিয়ে দিলাম। 
বললাম
এটাতে আমার স্থায়ী; অস্থায়ী দু’টি ঠিকানাই রয়েছে। আপনি চাইলে যে কোনো ঠিকানায় যোগাযোগ করতে পারবেন। 
আর, আপনার নামটি কিন্তু আমাকে এখনো বলেননি। 
মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলল
রূপা।
আমি বললাম
শুধুই রূপা, আগে পিছে কিছু নেই ?
সে আবার হাসল ; সে হাসিতে মেয়েটির শরীর দুলে উঠল। অসম্ভব ভালো লাগল মেয়েটিকে। হাসি থামিয়ে পুনরায় মেয়েটি বলল
আমাদের মতন মানুষদের নামে কি আসে যায়।
আমি বললাম
আপনার কথার মাথা-মুণ্ডু কিছু বুঝলাম না।
মেয়েটি কোন জবাব দিল না। আনমনে জানালা দিয়ে তাকিয়ে কৃষ্ণপক্ষের নিরাভরণ প্রকৃতির দীনহীনরূপ উপভোগ করতে লাগলো।

শেষরাতের দিকে ট্রেন এসে নওয়াপাড়া স্টেশনে থামল। আমি মেয়েটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ট্রেন থেকে নামলাম। ট্রেন ছেড়ে দিলে দেখলাম, মেয়েটি জানালা দিয়ে শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার বুকের ভিতরটা হু হু করে ওঠলো। চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রুও গড়িয়ে পড়লো।

ছুটি শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এলাম। প্রথম প্রথম রূপার কথা খুব মনে পড়তো, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রূপার ঠিকানা নেয়া হয়নি। রূপা চিঠি লিখবে, সে আশায় প্রহর গুণতাম। 
তারপর কাজের ব্যস্ততায় রূপার কথা একরকম ভুলেই গেলাম। এভাবে বছর দুই কাটলো। হঠাৎ একদিন ডাকপিয়ন এসে দরজায় কড়া নাড়ল। দরজা খুলে দেখি আমার নামে আসা একটি চিঠি। বানিয়াশান্তা থেকে রূপা লিখেছে। আমি অবাক হয়ে চিঠিটা খুলে এক নিশ্বাসে পড়লাম। গোটা গোটা হাতের লেখায় খুব সংক্ষিপ্ত একটি চিঠি। 
চিঠিতে লেখা
প্রিয় লুৎফর রহমান,
আজ দীর্ঘদিন পর চরম দুঃসময়ে তোমাকে স্মরণ করছি। নিজের বলতে
পৃথিবীতে ছোট মেয়েটি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। বানিয়াশান্তার নিষিদ্ধ পল্লির চারদেয়ালের মাঝেই আমার আর আমার মেয়ের জগৎ সীমাবদ্ধ। আমি আজ শয্যাশায়ী। তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। বেঁচে থাকতে দেখা না হলেও, মরে গেলে আমার দেহটাকে ধর্মমতে সৎকার করো।
ইতি
রূপা চৌধুরী।

চিঠিটা পড়ে বেদনাভারাক্রান্ত মনে আকাশের দিকে তাকালাম। ঘন কালো মেঘরাশি সমস্ত আকাশ জুড়ে ছুটোছুটি করছে। একটি নিরাশ্রয় অসহায় মেয়ের অসহায়ত্ব চোখের সামনে ভেসে ওঠলো। রূপার অন্তিম ইচ্ছা পূরণ করতে ছুটে গেলাম বানিয়াশান্তায়। ততক্ষণে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। মৃত্যুর পর রূপাকে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে পশুর নদীর নোনা জলে।

নদীরধারে দাঁড়িয়ে রূপাকে খুব মনে পড়লো। রূপা, আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমার সৎকার করতে পারিনি। পৃথিবীতে ভালোবাসা, একটু স্নেহের পরশ কিংবা কারো প্রতীক্ষা ভাগ্যে না জুটলেও, পরপারের ট্রেনে সহযাত্রিণী হতে আমার অপেক্ষায় থেকো।
 
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখ দু’টো জলে ভিজে ওঠলো, মনের গহীনে তীব্রকষ্ট অনুভব করলাম
পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে ফিরতি ট্রেনে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এলাম।

লেখক- শিক্ষক (বাংলা), সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ।     
এসি