আতঙ্ক নয়, সতর্ক ও শুদ্ধাচারী হউন
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১১:৫৫ পিএম, ৭ এপ্রিল ২০২০ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৪:৩৯ পিএম, ১০ এপ্রিল ২০২০ শুক্রবার
ড. সালেহা কাদের
করোনার ভয়াবহতায় সারাপৃথিবী। প্রতিদিন মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। মারা যাচ্ছে অগণিত মানুষ। কি করুণ মৃত্যু। একা একা আপনজন ছাড়া ধুকে ধুকে মরা। মৃত্যুর পরে আপনজন যাচ্ছে না। গোসল দিচ্ছে না, জানাজা ছাড়া কবর হয়ে যাচ্ছে অনাদরে। গণমাধ্যমে আমরা করুণ চিত্র দেখছি।
এ অবস্থায় আতঙ্কিত না হয়ে আমাদের একমাত্র উপায় সতর্ক এবং সচেতন হওয়া। আবার নিয়ম মেনে চললে ভয়ের কিছু নেই বলছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সুতরাং আসুন নিয়ম মেনে চলি। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলি। স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলি। মাস্ক ব্যবহার করি। ঘরে থাকি। আমাদের অনুধাবন করতে হবে, যেখানে উন্নত বিশ্ব করোনা চিকিৎসা যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে আমাদের কি অবস্থা হতে পারে ভাবা যায় না। এসময় পরিস্থিতি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন হতে হবে। আমাদের গণমাধ্যম যথেষ্ট সচেতন আছে। প্রতিদিনই সুরক্ষা বার্তা, সচেতনতা বার্তা প্রচার করছে। তবে কেউ কেউ না বুঝে কিছু গুজবও ছড়াচ্ছে।আমাদের সবাইকে এসব গুজব থেকে সাবধান থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে আমরা একটা কঠিন সময় পার করছি। সবাই ভালো থাকুন নিরাপদ থাকুন এবং ঘরে থাকুন।
সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি আমাদের যেসব পেশার মানুষ দিন আনে দিন খান, তাদের কথা চিন্তা করতে হবে। তাদের অনেকে এখন বেকারের মত। আসুন এই ক্রান্তিলগ্নে আপনার আশে-পাশের এই মানুষগুলোর সাথে নিজের খাবার ভাগাভাগি করি। কেউ যেন না খেয়ে না থাকে। আবার ত্রাণ বা সাহায্য দিতে গিয়ে আমরা যেন অগোচরেই ভাইরাস বিস্তার না করি। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, মাস্ক ব্যবহার করে স্বাস্থ্য বিধি মেনেই খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করতে হবে।
এই ক্রান্তিকালে আমরা অপূর্ব একটা সুযোগ পেয়েছি আমাদের সন্তানদের সাথে দীর্ঘ সময় ঘরে সময় কাটানোর। আমরা ইচ্ছে করলেই এখন তাদের কোয়ালিটি সময় দিতে পারি। আমরা তাদের বয়স অনুযায়ী শিষ্টাচার, শুদ্ধাচার শেখাতে পারি। যেমন- ঘর গোছানো, বাগানের যত্ন বা রান্নার কাজে আমাদের সাথে ব্যস্ত রাখতে পারি। তাদের সাথে খেলাধুলা, আড্ডা, গল্পে শুদ্ধাচারের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরতে পারি। তাদের সাথে সিনেমা টিভির অহেতুক বিনোদনে মেতে না থেকে শিক্ষণীয় বিষয় দেখতে পারি। তাদেরকে করোনা সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে হবে। তাদেরকে আমাদের সাথে নামাজ পড়াতে পারি বা নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী প্রার্থনা করতে পারি। বিকালে সবাই বাইরে যাওয়ার মত সাজ নিয়ে বাড়িতে গান, নাচ আবৃত্তি বা অভিনয়ের আয়োজন করতে পারি। ডিজিটাল লাইভ প্রোগ্রাম করে বন্ধু বা আত্মীয় স্বজনের খোঁজ খবর নিতে পারি। আসল কথা হলো তাদের সময়গুলো যেন সৃজনশীল আনন্দে কাটে সে দিকে নজর দিতে হবে। অহেতুক আড্ডায় নয়, সময় ব্যয় করতে হবে খুব সতর্কতার সাথে। আমরা সকাল বিকাল তাদের নিয়ে হালকা ব্যায়ামও করতে পারি।
এখানে শুদ্ধাচার নিয়ে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরছি। আমি মনে করি, আমাদের এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। শুদ্ধাচার বলতে সাধারণভাবে নৈতিকতা ও সততা দ্বারা প্রভাবিত আচরণ ও উৎকর্ষ বোঝায়। যার দ্বারা একটি সমাজের কালোত্তীর্ণ মানদণ্ড, নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্য বোঝানো হয়। ব্যক্তি পর্যায়ে এর অর্থ হলো কর্তব্য নিষ্ঠা ও সততা, তথা চরিত্র নিষ্ঠা। সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে আমাদের সরকার জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রয়োগের পদক্ষেপ নিয়েছে, সে লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু হয়েছে। কিন্তু পরিবার পর্যায়ে শুদ্ধাচার চর্চা শুরু না হলে সেটা খুব বেশি উপকৃত হবে না।
যা কিছু ন্যায় ও মানবিক তা-ই শুদ্ধ। আর যা কিছু অন্যায়, জুলুম ও অমানবিক তা-ই অশুদ্ধ। ধর্মের ফলিত রূপ হচ্ছে শুদ্ধাচার আর অধর্মের ফলিত রূপ হচ্ছে দুরাচার। আর স্বাভাবিকভাবেই শুদ্ধাচারী জাতি নির্মাণে শুদ্ধাচারের চর্চা শুরু হতে হবে পরিবার থেকে। কারণ ব্যক্তির শুদ্ধাচার চর্চার লালনভূমি তার পরিবার। পরিবারে শুদ্ধাচারের চর্চা শুরু হলে তা ছড়িয়ে পড়বে চারপাশে, সমাজে। তার প্রভাব পড়বে জাতীয় জীবনে। ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজ শুদ্ধাচারী হলেই দুর্নীতি ও অনাচারমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে উঠবে। কোমলমতি শিশুদের শুদ্ধাচার শেখানোর ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় আরো শক্তিশালি ভূমিকা নিতে পারে। পাশাপাশি আমরা যারা শিক্ষকতা করছি তারাও এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারি। আর পরিবারের ভূমিকা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মনে রাখতে হবে শুধু লেখাপড়া করে কেউ মানবিক হবে না। যদি মানবিক গুণ না থাকে।
শিক্ষার্থীরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারছে না। এ যে ঘরে থাকা তা যেন তাদের কাছে গৃহবন্দি মনে না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। বিশেষ করে তারা যে সময় স্কুলে অতিবাহিত করতো সে সময়টা যাতে সুষ্ঠভাবে কাটে। স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের সমন্বয়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফরম ব্যবহার করতে পারেন। শিক্ষক নিজ ঘরে থেকে ক্লাস রুটিন অনুযায়ী পাঠদান করবেন যা শিক্ষার্থীরা একই সময়ে নিজ নিজ বাসায় বসে অংশগ্রহণ করবে। শিক্ষক বাড়ির কাজ দিবেন যা শিক্ষার্থীরা আপলোড করে দিবে।
কিছু স্কুল এডুক্যাশনাল সফটওয়ার ব্যবহার করছে। যেমন আমাদের চেরী ব্লোসমস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজ ক্লাসটিউনের মাধ্যমে শিক্ষকের বাসা থেকে শিক্ষার্থীদের বাসায় স্কুলের সময় ও রুটিন অনুযায়ী স্কুলের সমস্ত কার্যক্রম চলছে। এ কাজে শিক্ষকের সাথে ভিডিও কলের মাধ্যমে সরাসরি কথা বলার জন্য WhatsApp বা viber ব্যবহার করা যায়।
এছাড়া "আমার ঘরে আমার স্কুল" নামে বিটিভিতে ডিজিটাল ক্লাস ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণির বিভিন্ন বিষয়ে ২৯ মার্চ ২০২০ তারিখ সকাল ৯টা থেকে শুরু হয়েছে। রুটিন প্রাপ্তির ঠিকানা www.dshe.gov.bd . আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ঘোষণা তার ভাষণে দিয়েছন।
শেষে পবিত্র কোরআন থেকে দুটো লাইন দিয়ে আজকের লেখা শেষ করবো। সূরা ইনশিরাহ’র ৫ থেকে ৮ নম্বর আয়াত। ‘মনে রেখ প্রতিটি কষ্টের সাথেই রয়েছে স্বস্তি। নি:সন্দেহে প্রতিটি কষ্টের সাথেই রয়েছে স্বস্তি। [অর্থাৎ, প্রতিটি সমস্যার ভেতরেই রয়েছে তার সমাধান, প্রতিটি সমস্যার ভেতরই রয়েছে নতুন সম্ভাবনা।] অতএব, তুমি দৃঢ়তার সাথে কাজ করো আর যখনই সময় পাও প্রতিপালকের কাছে একান্তভাবে নিমগ্ন হও। আসুন আমরা ঘরে বসে বসে প্রার্থনা করি, মানুষের জন্য দোয়া করি এবং সামর্থ্য অনুযায়ী আসহায় মানুষের জন্য হাত বাড়িয়ে দিই।
লেখক: শিক্ষাবিদ, অধ্যক্ষ- চেরী ব্লোসমস ইন্টারন্যাশনার স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
এসি/এনএস