ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

সড়ক দ্বীপের পরিবারটি নিখোঁজ

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

প্রকাশিত : ০৭:০৭ পিএম, ৮ এপ্রিল ২০২০ বুধবার | আপডেট: ০৯:০০ পিএম, ৮ এপ্রিল ২০২০ বুধবার

রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা। ৮ নম্বর রোডের লেক পাড়ের সড়ক দ্বীপ। এ দ্বীপেই এক পরিবারের বসবাস। চার সদস্যের একটি ছোট পরিবার। পরিবারের কর্তা এক নারী। স্বামী পরিত্যক্তা এক মেয়ে, নাতি এবং পঙ্গু জোয়ান ছেলে নিয়ে মাজেদা বেগমের সংসার। 

কয়েক বছর ধরে লেকপাড়ের এ সড়ক দ্বীপে বসবাস। কিন্তু প্রায় পনের দিন হলো তাদের কোন খোঁজ নেই। প্রতিদিন অফিসে যাওয়া, আসার পথে গাড়ির জানালা থেকে উঁকি মেরে তীক্ষ্ণ চোখে পরিবারটির খোঁজ করি কিন্তু পাই না। প্রতিদিন এক সময় তা নয়, বিভিন্ন সময়। কোন দিন সকাল, কোনদিন দুপুর বা বিকেল আবার কোন দিন রাতে। হয়ত সড়ক দ্বীপ থেকে একটু সরে আস্তানা গেড়েছে এই ভেবে গত পরশু নেমে পড়লাম ওদের খোঁজে। আশে পাশে দৃষ্টির দূরত্বে খুঁজলাম কিন্তু হদিস মেলাতে পারলাম না। কিন্তু যাবে কোথায় এ পরিবারটি! কোথাও তো যাওয়ার জায়গা নেই। 

চাঁদপুরের অধিবাসী এ পরিবারের বাড়ি-ঘর, জমি-জিরাত সব মেঘনার গর্ভে বিলিন হয়েছে। স্বামীর মৃত্যুর পর মাথা গোঁজার শেষ ঠাঁই বেহাত হলে মাজেদা বেগম রাজধানীতে আসেন। অকূল পাথারে তাদের কেউ নেই। কংক্রিটের নগরীতে এসে এখানে ওখানে লাথি, ঠেকা খেয়ে শেষমেষ ধানমন্ডির লেক পাড়। এখান থেকে ওদের কেউ খেদিয়ে দেয়নি। হয়তো এখানে প্রতিযোগিতার অভাব। আর উঁচু দালান ও দামি ব্রান্ডের গাড়ির মালিকরা তাদের এলাকার লেকের পাড়ে কোন ছিন্নমূল জনমানব আস্তানা গাড়ল তার হিসেব নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। এ প্রয়োজন মনে করেনি বলেই হয়ত ওরা অভিজাত দালানের নীচে পথের পাশে টিকে গেছে গোটা এক বছর। 

কিন্তু এখন ওরা যাবে কোথায়? দেশের এই অবস্থায় কোথায় যেতে পারে ওরা। ওদের তো যাওয়ার জায়গাও নেই। প্রায় কয়েক মাস হলো ওদের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। মাজেদা বেগম ও তার মেয়ে পার্কে আগতদের কাছে ফুল বিক্রি করতেন। নাতি মাত্র হাঁটতে শিখেছে। ছেলেটা পঙ্গু হওয়ায় ঝুপরিতে শুয়ে বসেই দিন গুজরান করে। এ নগরীতে এখন তাদের খোঁজ নেই। কোথায় যেন চলে গেছে মৃত্যুর ভয়ে। অথচ মাজেদা বেগমের সঙ্গে কথা হলে প্রায়শ আক্ষেপ করে বলতেন, এ জীবন তার ভালো লাগে না। এর চেয়ে মরণ আরও বেশি ভালো। অথচ সেই মাজেদা বেগমই মৃত্যুর ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অথবা শূন্য পার্কে পেট চলবে না ভেবে অন্য কোথাও চলে গেছেন। সে সম্ভাবনা কম। অন্য কোথাও গেলে যে খাবার জুটবে তার নিশ্চয়তা নেই। কোভিড-১৯ এক পর্যুদস্ত অবস্থার সৃষ্টি করেছে। বিশাল নগরী কিন্তু নাগরিকরা নেই। শূন্য নগরীতে বুকের ভিতর হাহাকার করে। অবশ্য উপায় নেই। এ মরণঘাতী করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের মৃত্যু ঘটবে এ আশঙ্কাই বেশি। প্রতিদিনই মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। তবে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা হয়তো একটু কমানো যেতে পারে। সে হলো সচেতনতা। তাই তো সবাই বাড়ির মধ্যে। রাস্তায় আছেন শুধু আইন প্রয়োগ ও বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ এবং আমাদের মতো সাংবাদিকরা। বাড়ির বাইরে না বেরোলে আপনার আমার হয়ত কয়েক মাস চুলা জ্বলবে। কিন্তু মাজেদা বেগমদের কি হচ্ছে? আপনি বা আমি রাস্তায় বের হলেই না তাদের পেটে খাবার পড়বে। কিন্তু এখন তো বের হওয়ার উপায় নেই সেটা নিজের জন্য এবং অপরের জন্য। তাহলে কি মাজেদা বেগমরা বাঁচবেন না, কিভাবে বাঁচবেন! সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বা বিভাগ এবং বেসরকারী উদ্যোগ হয়তো মাজেদাদের অন্নের সংস্থান করছে । কিন্তু পরিতাপের বিষয় মাজেদা বেগমের মতো ছিন্নমূল মানুষেরা এ ত্রাণ পাচ্ছে না। প্রায় এক মাসের কাছাকাছি হবে বাংলাদেশে ক্রান্তিকাল চলছে। আগামী বেশ কয়েকটা দিন এর থেকেও কঠিন হবে। মানুষের পেটে খাবার না পড়লে সে কিন্তু মৃত্যুর ভয় বা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে না। রাস্তায় বেরিয়ে আসবে। এখন যারা মাজেদাদের খাবার লুট করছেন তখন তারা বাঁচতে পারবেন তো! 

আমি এটা মানতে নারাজ যে বাংলাদেশের মতো একটা রাষ্ট্র তার অসহায় নাগরিকদের কয়েক মাস খাইয়ে রাখতে পারবে না। অবশ্যই পারবে। তবে বলবানরা যদি তা কেড়ে নেন তাহলে দুর্বলরা কি করবেন। শুধু সরকারের দায়িত্ব পালন শেষ করলে হবে না। যথাযথ ব্যক্তি খাদ্য পেলেন কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। এখানে রাষ্ট্রের কাছে এসব নাগরিকরা পাওনাদার। পাওনাদার তার প্রাপ্য বুঝে পেলেন কিনা তা দেনাদারকেই তো নিশ্চিত করতে হবে। এখনও সারাদেশ থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছে যে, না খেয়ে মানুষ দিন যাপন করছে। যারা দিনে পরিশ্রম করে খাবার নিশ্চিত করতো তাদের জন্যই বিভিন্ন ব্যবস্থা। নিশ্চয়ই আপনার আমার জন্য এ ব্যবস্থা নয়। তাহলে মাননীয় মাতব্বর সাহেব আপনি কেন লুট করছেন?

সেদিন বিকেলবেলা ব্যক্তিগত কাজে শ্যামলীতে গিয়েছিলাম। সময় লাগবে ভেবে অফিসের গাড়ি ছেড়ে দিতেই বিপত্তি। কাজ শেষ এখন আসবো কিসে। একটা রিক্সা পেলাম। অবাক করার বিষয় হলো রিক্সাওয়ালা উপযুক্ত ভাড়ার চেয়ে অনেক কম দাবি করলেন। আমি চড়ে বসে জানতে চাইলাম, এত কম ভাড়া চাওয়ার কারণ কি? রিক্সাওয়ালার জবাবে আমি বেশ অবাক হয়েছি। শুধু অবাক হইনি কষ্টও পেয়েছি। উপযুক্ত বা বেশি ভাড়া চাইলে যদি যাত্রী না উঠে তাই কম চেয়েছে। প্রয়োজনে অনেক কষ্ট করবেন তারপরও বাজার তো করতে হবে। কিন্তু তিনি কষ্ট যে করবেন, সে শক্তিও পাচ্ছিল না বলে মনে হলো। নাম নুর আলম। বয়স ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশ হবে। রাজধানীর হাজারীবাগে বোন, বোনের ছেলে এবং নিজের ছেলেকে নিয়ে চারজনের সংসার। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আর বিয়ে করেননি নুর আলম। স্বামী পরিত্যক্ত পোশাক শ্রমিক বোনেরও কোন সঞ্চয় নেই। তখন দেশে এ অবস্থার ১৩ দিন হয়ে গেল। ঘরে চাল নেই বলে রিক্সা নিয়ে বের হয়েছেন। বিকেল পর্যন্ত তিন চাকার বাহনটি চালিয়ে একশত পঞ্চাশ টাকা রোজগার হয়েছে। এর মধ্যে রিক্সার মালিককে একশত টাকা দিতে হবে। সরকারের ত্রাণ পাননি তিনি। শুধু চারখান সাবান পেয়েছেন। তাও কোন এনজিও’র কর্মীরা দিয়ে গেছেন। স্থানীয় কাউন্সিলর নাকি বলে আসছেন আগামী পরশু ত্রাণ দিবেন কিন্তু সেই পরশু চার বার পার হয়ে গেলেও সেই কাঙ্খিত পরশু আর আসেনি। ঘরে চাল শেষ, হাতে টাকা নেই। দুপুরে ভাত ও আলু সিদ্ধ খেয়ে বের হয়েছেন। তেল, লবন বা মরিচ কিছুই নেই। নুর আলমের ত্রাণ দরকার নেই দরকার রিক্সা চালানোর সুযোগ কিন্তু করোনার এ পরিস্থিতিতে তা সম্ভব না তা তিনিও জানেন। কিন্তু পেট চলবে কিভাবে? আর রাস্তায় বের হলেও যে রোজগার হবে তা তো নয়। গন্তব্যে পৌঁছে তাকে বাড়তি টাকা দিতে গিয়ে বিপত্তি বাঁধল। তিনি নিবেন না। তাকে বুঝালাম এতে হয়ত আপনার আরও তিন বা চার দিনের সংসারের বাজার হবে, এতটুকু সহযোগিতা তো করতেই পারি। কিন্তু তিনি দান নিবেন না। 

তার কথা, এ সময় রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাকে খাওয়ানো। আমি অবাক হলাম। যে লোক ঠিকমতো উচ্চারণে কথা বলতে পারেন না। পড়তে জানেন না (আমাকে শুরুতেই বলেছিলেন) তিনি কিনা অধিকারের খবর রাখেন। রাষ্ট্রের কি দায়িত্ব, কি নয় তা জানেন। তার অসহায়ত্বের অবস্থায় আমার চোখ ছল ছল করে উঠল। কিন্তু প্রকাশ না করেই আবারও জোর করলাম কিন্তু নিবে না। শেষে বললাম, আচ্ছা ধার নেন। পরে শোধ করে দিবেন। আত্মসম্মানে কারও দান নিবেন না কিন্তু চুলা জ্বলবে কিভাবে ভেবে অস্থির হচ্ছেন। মনে মনে হয়তো কোন কিছুই স্থির করতে পারছিলেন না। তবে ধারের কথা বললে রাজী হলেন। আমার ফোন নাম্বারটা চেয়ে নিলেন। 

আমি আর পিছনে তাকালাম না। নেমেই হেঁটে চললাম। আহা মানবজীবন। ক্ষুধার জ্বালা যে কত বড় জ্বালা তা কেবল তারাই বোঝেন যারা এ কষ্টে পড়েছেন। কথিত ‘জনদরদী’রা বুঝবেন কিসে। যাদের প্রতি বেলার খাবারে ১০ থেকে ২০ প্রকার মূল খাবারের সহযোগি উপকরণ থাকে। রাষ্ট্র এখন যে ত্রাণ দিচ্ছে তা কি আসলেই ত্রাণ। ত্রাণ মানে কি ভিক্ষা। আমার জানা মতে ভিক্ষা বা দান তো নয়। তো যারাই ত্রাণ দিচ্ছেন তারা এমন ভাব করছেন যে, দুই চার মুঠো ছিটিয়ে দিবেন আর কাক পক্ষি এসে সদলবলে খেয়ে যাবে। ত্রাণ হলো রাষ্ট্রের কাছে অসহায় নাগরিকদের আমানত। তারা সারা বছর ট্যাক্সের টাকা দিয়ে রাষ্ট্রকে পালেন তো দুর্যোগের সময় সেটা বুঝিয়ে না দিলে কেমন কথা। রাষ্ট্র দিচ্ছে না এটা বললে মিথ্যা বলা হবে কিন্তু কিভাবে দিচ্ছে এবং কাদের মাধ্যমে দিচ্ছে। ত্রাণের পণ্য অসহায়দের বাড়ি বাড়ি রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা পৌঁছে দিয়ে আসবেন। বিনয়ীভাবে বলে আসবেন, এটা রাষ্ট্র থেকে তারা প্রাপ্ত হচ্ছেন, আবারও পাবেন। মনে রাখতে হবে, তারা গরীব হোক বা অসহায়, তারাও রাষ্ট্রের সম্মানিত নাগরিক। তাদের সেবায় রাষ্ট্র নিবেদিত। তবে কষ্টের ও পরিতাপের বিষয় হলো আমরা নানান বিষয় নিয়ে গর্ব করি। কিন্তু সেই জাতির মধ্যেই আজ জনপ্রতিনিধিরা ত্রাণ চুরি করছে, চিকিৎসকরা রোগী দেখছেন না, পুলিশ এই সময়ে এসেও ঘুষ খেতে ছাড়ছে না। অবশ্য সবাই যে করছে তা নয়। তবে দুই একজন করলেই হয়, সবার করতে হয় না। একবার জুতা পেটা করলে যে ইজ্জ্বত যাবে হাজার বার করলেও তার থেকে বেশি যাবে কি? গর্বটাই যেন লজ্জা পেয়ে কুঁকড়ে উঠছে বারবার! 

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। ই-মেইল: shafi9312@gmail.com

এসি