ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

করোনাকালে লৌকিক বেদনার ভার

বিধান রিবেরু

প্রকাশিত : ১২:১৬ পিএম, ৯ এপ্রিল ২০২০ বৃহস্পতিবার

তখন পৃথিবীতে ঘোর অন্ধকার। কালো মৃত্যুর করাল থাবায় মানুষ দিশেহারা। হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে এখানে সেখানে। মরে কঙ্কাল হয়ে আছে, শুধু মানুষ নয়, গবাদি পশুও। রোগের নাম প্লেগ। এমন মহামারীর ভেতর ধর্মযুদ্ধ শেষে এক নাইট ফিরে এসেছে নিজের দেশে। এসেই মৃত্যুর মিছিল দেখে বিচলিত হয়ে পড়ে সে ও তার সহযোদ্ধা। আতঙ্ক ভর করে তাদের ভেতর। আর এই আতঙ্কগ্রস্ত বাস্তবতায় নাইটের নজরে ধরা দেন স্বয়ং যমদূত। অনেকের সাথে নাইটকেও তিনি নিয়ে যাবেন ওপারে। কিন্তু নাইট চতুর। সে দাবা খেলার কথা বলে মৃত্যুকে ঠেকাতে চায়। চলতে থাকে সকলের অগোচরে সেই পাশাখেলা। এই যে সকলের গোচরীভূত না হওয়া বা ঘুরিয়ে বললে, আতঙ্কিত অবস্থায় নিজেই নিজের মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া, খোদ যমদূতকে দেখতে পাওয়া, যে যমদূত তার উপর নজর রাখছে, এটাকেই আমরা বলি নজর বা গেইজ। যা আবার নতুন করে দেখা যাচ্ছে এই নয়া করোনা ভাইরাস সৃষ্ট মহা মহামারীকালে।

ইঙ্গমার বেরিমানের “সপ্তম সীলমোহর” (১৯৫৭)ছবির নাইটের ভূমিকায় যেন এবার অবতীর্ণ হয়েছি আমরা। নাইট ছিলো মধ্যযুগের। আমরা যেহেতু আধুনিক সময়ের মানুষ, তাই আমরা আরো বেশি কিছু দেখছি, মৃত্যুরও অধিক। সেটা কি? দেখছি, কি বিপুল উৎসাহ ও কর্মযজ্ঞের ভেতর দিয়ে আমরা এই পৃথিবীর প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছি এবং আরো প্রত্যক্ষ করছি, আমাদের বিজ্ঞান ও সভ্যতার বড়াই আসলে কতোটা ঠুনকো। অতি ক্ষুদ্র এক ভাইরাসের ধাক্কাতেই সেই বড়াই ঝনঝন শব্দ করে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। এই দৃশ্য আমাদের সামনে ধরা দিয়েছে এমন এক সময়ে, যখন আমরা আতঙ্কগ্রস্ত। জাক লাকাঁ বলেছিলেন, আতঙ্কের প্রতিভাসে নজর বা গেইজ সর্বদা হাজির থাকে।

লাকাঁর আগে মরিস মার্লো-পঁতি গেইজ সম্পর্কে বলেছিলেন, এই নজর এমন এক নজর, যা আগে থেকেই বিরাজমান, যার চেয়ে থাকা আমাদের দিকেই। আমরা সেটাকে কখনো দেখি, কখনো দেখি না। মার্লো-পঁতি বলতে চাইলেন, এই দেখা ও না-দেখার বিষয়টি নির্ভর করে দেখনেওলার উপর। ভিন্ন নজর নিজের নজরে আসা, এটা তো অনেকটা এরকম যে, আমি দেখতে দিচ্ছি বলেই অন্যে দেখতে পাচ্ছে। এই ভাবনার মধ্য দিয়েই মার্লো-পঁতির থেকে আলাদা পথে হাঁটলেন লাকাঁ। আগে থেকে নজরের হাজির থাকা ‘নজরে পড়তে দেয়া’র শর্তের সাথে সম্পর্কযুক্ত। একটা জিনিস বলে নেয়া ভালো, চর্মচক্ষু আর নজর এক বস্তু নয়। তাই চোখের জ্যোতি দিয়ে যে সবসময় নজর বা গেইজ ধরা পড়ে তাও নয়। ধরা না পড়ার কারণ এর উপর আবরণ বিছানো থাকে—অপরের প্রতিবিম্বই আবরণ হয়ে একে আড়াল করে রাখে।

পুঁজিবাদ এতদিন সেই আড়াল রচনা করে রেখেছিলো আমাদের সামনে। আজ  আমরা যে বেদনার ভার বহন করে চলেছি, যে অসহায়ত্ব আমরা মর্মে মর্মে টের পাচ্ছি, তার কারণ আড়াল সরে গেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি সেই নজরকে, যা আমাদেরই, আমাদের দিকেই এতোদিন অবলা হয়ে তাকিয়েছিলো, আর বলছিল, হে মানবজাতি, এ কি করছো তোমরা? যুদ্ধ-বিগ্রহের নামের তোমরা মানুষ খুন করছো, জীবাণু বোমা তৈরি করছো, মারণাস্ত্র তৈরি করছো, অথচ মানুষ বাঁচানোর নামে তোমরা নেই। তোমাদের গবেষণা তখন তলানিতে গিয়ে ঠেকে। মানুষ বাঁচানোর সূত্রও তোমরা বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করতে চাও। মানুষের চেয়ে তোমাদের কাছে অর্থবিত্ত বড়। জীবনদায়ী ওষুধ তোমাদের কাছে বাজারের আর দশটা পণ্যের মতোই। আজ সেই প্লেগের আমলে আতঙ্কগ্রস্ত নাইটের মতো আমরা যখন আরেক মহামারীর ভেতর পড়লাম, আতঙ্কগ্রস্ত হলাম, তখন তার মতো আমাদের তৃতীয় চক্ষুর উন্মেষ ঘটলো। আমরা দেখলাম, প্রকৃতির প্রতি আমরা কতোটা নিষ্ঠুরতা করেছি এতোদিন। মানুষও যে প্রকৃতির অংশ, একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র, সেটাই ভুলে গিয়েছিলাম বেমালুম। তাই মানুষের অবাধ বিচরণ বন্ধের পরপরই সৈকতে ডলফিনের ফিরে আসা, সাগরলতাদের বিস্তার, হরিণ আর ময়ূরের অবাধ চলাফেরা, স্বচ্ছ ও নির্মল আকাশ আমাদের কাছে অলৌকিক ঘটনা মনে হয়। 

বারবার বলার পরও আমাদের তথাকথিত উন্নত দেশের নীতিনির্ধারক ও গবেষকরা মহামারীর বিষয়টি আমলে নেননি। গত কয়েক বছর থেকেই নানা মহল থেকে সতর্কবাণী দেয়া হচ্ছিল। বিল গেটসের একটি অনুষ্ঠানেও আমরা সেটি দেখেছি। এখন যখন দলে দলে মানুষ মারা যাচ্ছে, চীন থেকে ইতালি, যুক্তরাজ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্র তখন তাদের টনক নড়েছে। এই টনক নড়ার নামই নজরের উদয় হওয়া। আমরা যেন শেক্সপিয়রের সেই নারী চরিত্র লেডি ম্যাকবেথ। যার চোখের সামনে থেকে পর্দা সরে গিয়েছিল, নিজের হাতে যে দেখতে পাচ্ছিল রক্তের দাগ। শতবার ধুয়েও সেই দাগ ওঠানো যাচ্ছিলো না। আন্তোনিও কিনেট বলছিলেন ‘স্পট’ চলে আসে “স্পটলাইটে’র আলোতে। আজ আমরাও সহস্রবার সাবানপানি দিয়ে হাত ধুয়েও আমাদের হাতে লেগে থাকা অবহেলায় মানুষের মৃত্যুর দায় এড়াতে পারছি না। আমরা যেন রাজা ঈদিপাস। করোনা আমাদের কূটের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমরা আমাদের ভুল বুঝতে পারছি। করোনা যেন আমাদের মুখের সামনে আয়না হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা বুঝতে পারছি, জীবনটা আগে, বিলাসিতা পরে। যুদ্ধ অপরিহার্য নয়। পণ্য অনিবার্য নয়।

সলিমুল্লাহ খান প্রায়ই বলেন, একটি দড়ি ততোটুকুই শক্তিশালী, যতটুকু তার সবচেয়ে দুর্বল বা ছেড়া অংশে শক্তি জমা আছে। আজ বোঝা গেলো, মানুষ বাঁচানোর গবেষণা, মানবতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার যে নিরন্তর সাধনা, সেখানেই আমাদের সবচেয়ে বড় গলদ রয়ে গেছে। এই গলদ আমরাই তৈরি করেছি। আমরা ফি বছর যতোটা খরচ করি মারণাস্ত্র বানাতে বা খরিদ করতে, তার কতটুকু ব্যবহার করি জীবন বাঁচাতে? আর গোটা মানবজাতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে যাদের গরিমার শেষ নেই, তারাই আজ অসহায়ের মতো ফ্যালফ্যাল করে মৃত্যুর তাণ্ডবনৃত্য দেখছে। এ যেন বেরিমানের সেই চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্য, যেখানে মৃত্যু নাচতে নাচতে পরপারের দিকে এগুতে থাকে। এজন্য দায়ী আমরাই। এই সহজ সত্যটি এতোদিন আড়ালে ছিলো, বলা ভালো আড়াল করে রাখা হয়েছিল। এক মামুলী সর্দিকাশি সেই আড়াল করা পর্দা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিয়েছে। জানি, মানুষ আড়াল পছন্দ করে। তারা আবার এই পর্দা তুলে নেবে। কারণ, সত্য আছে বলেই তাকে আড়ালের প্রয়োজন পড়ে। সত্য যে নির্মম। কখনো কখনো বদমাশও বটে!

আমাদের দশা এখন ফ্রয়েডের সেই আঙুল চোষা বালকের মতো। ফ্রয়েড দেখাচ্ছেন এই্ ঘটনার তিনটি দিক রয়েছে: বালকটি একটি জিনিস চোষে, বালকটি নিজেই নিজেকে চোষে, আর বালকটি চূষিত, ইংরেজিতে বললে, দ্য বয় ইজ সাকড। এই তিন নম্বর দশাই হলো নিজের নজরের কাছে নিজের ধরা পড়ার ঘটনা। ‘আমি দেখি’, ‘আমি নিজেকে দেখি’, আর ‘আমি দ্রষ্টব্য’— অপরের নজর দিয়ে নিজেকে দেখার মাধ্যমেই মানুষ সাবজেক্ট থেকে অবজেক্টে পরিণত হয়, নিজেই রাজা, নিজেই প্রজা। নিজেই নিজের অধীন হয়ে পড়ে। আজ আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে আমরা করোনার অধীনস্ত, আদতে আমরা আমাদের নজরের কাছেই আজ বন্দী। দড়ির সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটিই আজ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা নিজেদের জন্য যত দড়ি্ই পাকাই না কেন! গোটা পৃথিবীতে একমাত্র কিউবাকেই দেখা গেলো ব্যতিক্রম। পরাক্রমশালীরা এতোদিন যাকে কোনঠাসা করে রেখেছে, এক ঘরে করে রেখেছে, তারাই আজ উঁচুতে ধরে আছে মানবতার ঝাণ্ডা। তারা আতঙ্কিত নয়। কারণ তারা, পৃথিবীর তথাকথিত উন্নত দেশগুলো যে জায়গাটি দুর্বল করে রেখেছিল—স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা— মুনাফাসহ নানা কারণে, কিউবা সেই জায়গাটিতেই জোর দিয়েছে। একারণেই লেডি ম্যাকবেথের মতো পরিণতি হয়নি তাদের। মহামারী সামাল দেয়ার ক্ষেত্রে তাই তারা অন্যদের মতো পাগল হয়ে যায়নি। ভিয়েতনামও আছে এই সাফল্যের কাতারে। অথচ চীনের প্রতিবেশী তারা। নয়া করোনা ভাইরাস ছড়াতে শুরু করে চীনের উহান প্রদেশ থেকেই। প্রথমে শোনা গিয়েছিল স্থানীয় বাজার থেকে ছড়িয়েছে এই ভাইরাস। পরে জানা গেলো আরেক তথ্য বা বলতে পারেন “ষড়যন্ত্র তত্ত্ব”।

রোমহর্ষক তথ্যটি হলো, এই নোভেল করোনার জন্ম নাকি কোন বাদুড় বা ইঁদুড়ের পেটে নয়, মানুষের গবেষণাগারে। কেউ বলছে এই গবেষণা যুক্তরাষ্ট্রের, কেউ বলছে চীনের। এই কুকর্ম যারই হোক, এই তত্ত্ব যদি সত্যি হয়, তাহলে উপরের কথাগুলো আরো জোরালো হয়। এ যেন নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারা। ভূট্টার গুদামে আগুন দিয়ে খই খাওয়া। এই ঘটনা সত্য হলে, পূর্বে আমাদের যে অভিযোগ—মানুষের প্রতি অবহেলা, মুনাফার প্রতি অতি লোভ, আধিপত্য বিস্তারের খেলা ইত্যাদি—সেগুলোর সাথে যুক্ত হবে আত্মঘাতী প্রবণতা। এ যেন সেই বালক, যে নিজেকেই নিজে চুষে খাচ্ছে, আনন্দ পাচ্ছে নিজের ক্ষয়ে।

জীবাণু অস্ত্র বানিয়ে হোক, আর চিকিৎসা শাস্ত্রকে মুনাফার হাঁস বানিয়ে হোক, এই যে মানবসমাজ ক্রমেই নিজের ধ্বংস নিজে ডেকে আনছে, ধ্বংসটাকে তরান্বিত করছে, এই যে তারা ভুলে যাচ্ছে—পৃথিবীতে অতো বড় যে ডায়নোসর, তারাও টিকে থাকে নি—এই সত্য যে তাদের দিকে আজ অপলক তাকিয়ে আছে, সেই নজরের উপর থেকে আজ বাজার সর্বস্ব বিচ্ছিনতাবাদের পর্দা সরে গেছে। কি আশ্চর্য, আজ আর তারা বিচ্ছিন্ন থাকতে চাইছে না! বরং যূথবদ্ধ হতে চাইছে। সম্মিলিতভাবে মারণব্যাধীর মোকাবিলা করতে চাইছে। সত্যিকারের মানবধর্ম যেন আজ ঠিকরে ফুটে উঠছে তাদের ভেতর থেকে। কিন্তু এতদিন তারা স্বার্থপরের মতো একা একা বেঁচে থাকতে চেয়েছে। নিজে বেঁচে অন্যকে গুড়িয়ে দিতে চেয়েছে। আজ তারা গোটা মানবজাতিকে বাঁচিয়ে রাখার চিন্তা করছে। এই চিন্তা আগে কেউ করেনি, তা নয়, বুর্জোয়া সমাজ তাদের ‘পাগল’ বলে আখ্যা দিয়েছে। আজ যেন সকলেই পাগল হয়েছে। আগের যারা ‘পাগল’, আজ কি তারা সুস্থ বলে প্রমাণিত হলো না?

দিনের পর দিন মানুষের প্রতি, প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি, এমনকি নিজেদের প্রতি অমানবিক ও নিষ্ঠুর হয়ে থাকা এবং অর্থবিত্তের প্রতি লোলুপতার যে বাস্তবতা আজ আমাদের সামনে উন্মোচিত হলো, যে লৌকিক বেদনার ভারে আজ আমরা ভারাক্রান্ত হলাম, সেটা লাঘব করার দায়িত্বও আমাদের। বোধদয় হয়েছে বোধ হয়। আমরা নজরপ্রাপ্ত হয়েছি। নিশ্চয় আমরা নতুন করে অঙ্গীকারাবদ্ধ হবো এবং সেটা ভঙ্গ করবো না। আমরা জানি, আমরা একদিন মরে যাবো। সকলেই। কিন্তু কেমন মৃত্যু চাই আমরা? সব মরণ কি সমান?

লেখক: প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক  

এমবি//