ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

দুর্যোগে বিপর্যস্ত জনপদে প্রয়োজন সতর্কতা

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

প্রকাশিত : ০৮:৩৫ পিএম, ১০ এপ্রিল ২০২০ শুক্রবার | আপডেট: ০৮:৩৭ পিএম, ১০ এপ্রিল ২০২০ শুক্রবার

জনশূন্য ঢাকার নিউমার্কেট এলাকা- সংগৃহীত

জনশূন্য ঢাকার নিউমার্কেট এলাকা- সংগৃহীত

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ এ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। এতে বাংলাদেশও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। প্রাণঘাতি এ ভাইরাস প্রতিরোধে ব্যস্ত পুলিশ, সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীসহ প্রশাসনের সকল স্তর ও পর্যায়ের লোকজন। এ সুযোগে মাদক, চুরিসহ নানা অপরাধের ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে।

অন্যদিকে করোনা ভাইরাসকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একদল সুযোগ সন্ধানী বিভিন্ন গুজব ছড়াচ্ছে। এসব গুজব ছড়িয়ে তারা সুযোগ নিতে তৎপর। এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ করতে হলে জনগনের সচেতনতার পাশাপাশি বাড়াতে হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা এবং সতর্ক থাকতে হবে বলে জানিয়েছেন আপরাধ বিশেষজ্ঞরা। 

মানবিক সেবার পাশাপাশি কোনভাবেই যেন অপরাধের বিস্তার না ঘটে সেজন্য পুলিশকে আরও পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশ মাহপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। 

গত মার্চের শেষের দিকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যত অঘোষিত লকডাউন বা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে রাজধানীসহ দেশের সব অঞ্চল। তিনদফা ছুটি বাড়িয়েছে সরকার। এতে ফাঁকা হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকা। ফাঁকা ঢাকার সড়কে এবং বাসা-বাড়িতে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও আলোচিত বড় বড় অপরাধ খানিকটা কমেছে। 

পুলিশ জানায়, দীর্ঘমেয়াদে ছুটি এবং করোনা আতঙ্কের কারণে মানুষের চলাফেরা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সমসাময়িক সময়ে অপরাধ কমেছে। তবে ফাঁকা ঢাকায় পেশাদার চোর-ছিনতাইকারীদের গতিবিধির ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি রয়েছে। 

তবে নজরদারির সঙ্গে সঙ্গে বাহিনীর তৎপরতা আরও বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক। তিনি বলেন, ‘রাস্তায় লোকজন বা যানবাহন চলাচল নেই। এ কারণে হয়তো অপরাধীরা আড়ালে গেছে। অপরাধও কমেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বেশি দিন এমন থাকবে না। পুলিশসহ সরকারের সবগুলো সংস্থাকে নিশ্চিত করতে হবে যে, অপরাধীরা যাতে আগের জায়গায় ফিরে আসতে না পারে।’

রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা- সংগৃহীত

জানা যায়, গত ১ এপ্রিল মধ্যরাতে রাজধানীর শ্যামলীতে একটি ওষুধের দোকানে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। লোক সমাগম কম থাকায় মাত্র তিন জন মুখোশধারী কয়েক মিনিটের মধ্যেই ডাকাতি করে পালিয়ে যায়। এ দোকানের স্বত্ত্বাধীকারী নাহিদ বিল্লাহ জানান, রাত সাড়ে ১২টার দিকে দোকান বন্ধের প্রস্তুতির সময় একটি পিকআপে তিনজন মুখোশধারী দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ডাকাতি করে। তখন উপস্থিত একজন ক্রেতাসহ, দোকানীকে চাপাতির মুখে নগদ টাকা এবং ল্যাপটপ লুট করে নেয়। 

২৮ মার্চ রাতে রাজধানীর গ্রিন রোডর একটি বাসায় লোহার গ্রিল কেটে স্বর্ণালঙ্কার চুরি করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। ২৬ মার্চ রাতে কারওয়ান বাজারে ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন একটি জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক। গত ২২ মার্চ তেজগাঁও থানাস্থ একটি বাসায় ল্যাপটপ চুরির ঘটনা ঘটে। এসব চুরি যাওয়া ঘটনার কোনটির মালামাল উদ্ধার এবং আপরাধীদের গ্রেফতার করা হয়েছে।। কোনটির আবার হদিসই মেলাতে পারছে না পুলিশ। তবে পুরো মার্চে ঢাকায় শিশু নির্যাতনের কোন মামলা দায়ের হয়নি বলে ডিএমপি সূত্রে জানা যায়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের তৎপরতা থেমে নেই। মাসের শেষের দিকে এসে চুরি-ডাকাতির ঘটনা কমলেও নিত্য নতুন কৌশলে মাদক চোরাকারবারীরা তৎপর রয়েছে। 

তবে কিছু অপরাধ বাড়ার পেছনে বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক কারণকে দায়ী করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘বেকারত্ব বাড়লে অপরাধও বেড়ে থাকে। অধিকাংশেরই অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল। তারা চুরি, ছিনতাই, পকেটমারাসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত হতে পারে। অভাবের তাড়নায় বিভিন্ন বাসায় হানা দিতে পারে। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক থাকতে হবে।’ ছোট অপরাধীরা জীবিকার জন্য বাসা বাড়িতে হানা দিতে পারে এ আশঙ্কার কথা জানিয়ে জিয়া রহমান বলেন, ‘ছোট-খাট কাজ অপরাধ করে যারা জীবিকা নির্বাহ করে তারা এখন বিকল্প পথ হিসেবে বাসা-বাড়িতে হানা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কারণ সময়-সুযোগ অনুযায়ী অপরাধের ধরণ পরিবর্তন হয়। দেশজুড়ে চলমান করোনা ভাইরাস সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে এসব চুরি-ছিনতাইয়ের পরিস্থিতি আরো অবনতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।’

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ‘র (ডিএমপি) সূত্র মতে, গেল মাসে ডিএমপিতে ২ হাজার ৫৫টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে ২টি ডাকাতি, ৫১টি বাসায় চুরি, ১৭টি খুন, ১৪টি দ্রুত আইন, ৫৬টি ধর্ষণ, ১৩২টি নারী নির্যাতনের মামলা, ৬৭টি প্রতারণার মামলা, ১টি মোটরসাইকেল চুরি, ১টি গাড়ি চুরি, ১১৭টি অন্যান্য চুরি, ১৪টি অস্ত্র আইন ও ১ হাজার ১২৭টি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে মোট ২ হাজার ১৩১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৫টি ধর্ষণ, ১২০টি নারী নির্যাতন, ২৯টি শিশু নির্যাতন, ৬১টি প্রতারণায়, ৭৪টি বাসায় চুরি, ১৬টি মোটরসাইকেল চুরি, ১৪টি গাড়ি চুরি, ৮৩টি অন্যান্য চুরি এবং ১ হাজার ২০৫টি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলা। গত জানুয়ারিতে মোট ২ হাজার ২৪৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ২১টি খুন, ২টি ডাকাতি, ৪২টি ধর্ষণ, ৮৬টি নারী নির্যাতন, ৬১টি প্রতারণা, ৬৫টি বাসায় চুরি, ৩০টি মোটরসাইকেল চুরি, ৭টি গাড়ি চুরি, ১০১টি অন্যান্য চুরি, ১৩টি অস্ত্র আইন ও ১ হাজার ৩২৩টি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলা। 

ডিএমপি’র দেওয়া তথ্যে রাজধানীর ৫০টি থানায় গত দুই মাসের চেয়ে মার্চে মামলা দায়ের কম হয়েছে। 

যশোরে ঈদগাহ মোড়- সংগৃহীত

অন্যদিকে কেউ কেউ বলছেন, বড়ো কোনো উত্সব যেমন ঈদ, পূজার সময় রাজধানী ঢাকা ফাঁকা হলে চুরি বা ছিনতাইয়ের সুযোগ খোঁজে অপরাধীরা। ফাঁকা বাসা বাড়িতে চুরি ডাকাতি নিয়ে আতঙ্কে থাকেন সবাই। তখন ফাঁকা রাস্তায় বেড়ে যায় ছিনতাই। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে বড়ো রাস্তা থেকে অলিগলি, সবখানে পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনী নিয়মিত টহল দেওয়ার কারণে এসব অপরাধ কমে গেছে। এছাড়া ত্রাণ বিতরণের সুবিধা এসব অপরাধীরা পাচ্ছেন বলে তারা অপরাধের কার্যক্রম থেকে দূরে রয়েছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, আদালতগুলোতে এখন তেমন জামিন হচ্ছে না। এ কারণে কারাগার থেকে কোনো অপরাধী বের হতে পারছে না। আবার যারা দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীতে পেশাদার অপরাধী হিসেবে কাজ করেছে তারা করোনার আতঙ্কে বাইরে বের হচ্ছে না। তবে তারা আর্থিক সংকটে পড়লে আবার অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে। এমন শঙ্কায় পুলিশের সবগুলো ইউনিটকে সতর্ক থাকতে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশের নিয়মিত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। থানায় মামলা গ্রহণ, মামলা তদন্ত, পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট এবং যে কোনো অপরাধের তথ্য পেলে- সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। করোনার উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রত্যেক পুলিশ সদস্যকে দ্বিগুণ তিনগুণ ডিউটি করতে হচ্ছে।

এমএস/এসি