ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

আসুন না, আমরা একটু মানবিক হই

মঈন বকুল

প্রকাশিত : ০৭:৩১ পিএম, ১১ এপ্রিল ২০২০ শনিবার | আপডেট: ০৭:৩২ পিএম, ১১ এপ্রিল ২০২০ শনিবার

বাসা বাড়িতে কত খাবারই না নষ্ট হচ্ছে। প্রতিদিন সেসব খাবার ফেলে দিতে হচ্ছে ডাস্টবিনে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে প্রতিদিন কত টাকাই না আমরা খরচ করছি, তার কোনো হিসেব নাই। একবার চোখটা বন্ধ করে ভাবুন না প্লিজ... দেখুন প্রতিদিন বেহিসাবি কত টাকা আমরা খরচ করছি। 

নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করুন- করোনা ভাইরাসের এই ক্রান্তিকালে দেশের কত মানুষ না খেয়ে আছে! কত মানুষ এক বেলা খেয়ে আছে! কত মানুষ আপনাদের মতো বিত্তবানদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে! কত মানুষ রাস্তায় বসে আছে, একটু সহযোগিতা পাবার আশায়। আসুন না আমরা একবার চিন্তা করি। একটু মানবিক হই। 

বিশ্বজুড়ে চলছে করোনা মহামারি। এশিয়া-ইউরোপ থেকে শুরু করে বিশ্বের কোথাও নিরাপদ না। শুধু লাশের মিছিল। লাশের গন্ধে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। যারা মারা যাচ্ছে তারা তো যাচ্ছেই, কিন্তু তার থেকেও বেশি কষ্টে আছে যারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় ছটফট করছে, মৃত্যুর প্রহর গুনছে।

পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই করোনা ভাইরাসে এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় সোয়া ১৭ লাখের বেশি। মারা গেছে এক লাখেরও বেশি মানুষ। তবে পৌনে ৪ লাখের মতো রোগী ইতোমধ্যে সুস্থ হয়েছে। যা আমাদের জন্য আশার দিক।

এছাড়া গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর প্রথম দিকে কয়েকজন করে নতুন আক্রান্ত রোগীর খবর মিললেও গত ক’দিনে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে এ সংখ্যা। সবশেষ হিসাবে দেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৪৮২। মারা গেছে ৩০ জন। সুস্থ হয়ে উঠেছে ৩৬ জন। প্রতিনিয়ত ভয়াবহ অবস্থার দিকে যাচ্ছে দেশের অবস্থা। 

দেশের এই ক্রান্তিকালে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে মানবেতর জীবন যাপন করছে আমাদেরই আশপাশে থাকা সমাজের অসহায়-গরীব-দুঃখী মানুষগুলো। দিনে এনে দিন খাওয়া মানুষগুলো রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকছে শুধু একটু সাহায্যের আশায়।

অনেকেই এই অসহায়দের পাশে দাঁড়ালেও তা পর্যাপ্ত নয়। দেখা যাচ্ছে, আশপাশের কিছু মানুষ এই বিপদে এগিয়ে আসছে। তবে সমাজের বিত্তবানদের খুব একটা অংশগ্রহণ নেই। কিন্তু অনেকেই আছেন যাদের  টাকা পয়সার কোনো হিসেব নাই। ইচ্ছে করলেই অনেকের দায়িত্ব নিতে পারেন। শুধু একটু ইচ্ছার অভাব। 

ভাল খারাপ মিলেই আমাদের সমাজ। আমরা প্রতিদিনই বিভিন্ন মিডিয়ায় কিছু সাহায্য সহযোগিতার নিউজ পাই। কিন্তু এতো বড় একটি জনগোষ্ঠির জন্য কি তা পর্যাপ্ত? এরমধ্যেও কিছু মানুষ আছে যারা লোক দেখানো সাহায্য সহযোগিতা করছেন। আবার অনেকে আছেন এসব লোক দেখানো সামান্য কিছু বিতরণ করে ত্রাণের জিনিসপত্র লুটপাট করছেন। আবার অনেকেই আছেন যারা গোপনে গোপনে নিজের সর্বস্ব দিয়ে অসহায়দের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।

আমরা যদি বুকে হাত দিয়ে একবার ভাবি, আমার বাড়ির পাশের গরীব অসহায় মানুষটি কি খেয়েছেন? নাকি না খেয়ে ঘুমিয়ে গেছেন? আমরা যদি ভাবি আমাদের সমাজের কথা। সমাজের সবাই কি খেয়ে আছে নাকি না খেয়ে আছে? দেশের করুণ এই মুহূর্তে তাদেরকে নিয়ে ভাবার দায়িত্ব কার? এই প্রশ্নের উত্তর দিবে কে? আমি মনে করি এই দায়িত্ব আমার, আপনার, সমাজের বিত্তবানদের। আমরা ইচ্ছা করলেও এই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারিনা। 

ছোটকালে পড়েছি, দান মানুষকে বড় করে। দান সম্পদকে পরিশুদ্ধ করে। দানে বাড়ে সম্পদ, বৃদ্ধি পায় মর্যাদা। দানকারীকে মহান আল্লাহ তায়ালাও ভালোবাসেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, সদকা সম্পদ হ্রাস করে না।

দান-সদকার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘খেজুরের একটি টুকরা দান করে হলেও তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার চেষ্টা কর।’ বুখারি, মুসলিম। 
হজরত উকবা বিন আমের (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই দান-সদকা কবরের আজাব বন্ধ করে দেয়। আর কিয়ামতের দিন বান্দাকে আরশের ছায়ায় জায়গা করে দেয়।’ তাবারানি, বায়হাকি। 

হজরত আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মানুষের জীবদ্দশায় এক দিরহাম দান করা তার মৃত্যুর পর এক শ দিরহাম দান করার চেয়ে উত্তম।’ 

আবু দাউদ, মিশকাত। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন, ‘দান সম্পদ কমায় না, দান দ্বারা আল্লাহ বান্দার সম্মান বাড়ানো ছাড়া কমান না। কেউ আল্লাহর ওয়াস্তে বিনয় প্রকাশ করলে আল্লাহ তাকে মানুষের কাছে বড় করে তোলেন।’ মুসলিম।

ইসলামে দান বা সদকার গুরুত্ব অপরিসীম। দান করার জন্য ধনী হওয়ার প্রয়োজন নেই, সুন্দর ইচ্ছাই যথেষ্ট। দান শুধু অর্থ বা সম্পদ প্রদানে সীমাবদ্ধ নয়। কারও শুভ কামনা, সুন্দর ব্যবহার, সুপরামর্শ, পথহারাকে পথ দেখানো, পথ থেকে অনিষ্টকারী বস্তু সরিয়ে ফেলা- এ জাতীয় সব কর্মই দান। 

দানের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনগণ! তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন আল্লাহর স্মরণ থেকে তোমাদের গাফিল না করে। যারা এ কারণে গাফিল হয়, তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত। আমি তোমাদের যা দিয়েছি, তা থেকে মৃত্যু আসার আগেই ব্যয় কর। অন্যথায় সে বলবে, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে আরও কিছুকাল অবকাশ দিলেন না কেন? তাহলে আমি সদকা করতাম এবং সৎকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।’ সূরা মুনাফিকুন, আয়াত ৯-১০।

সূরা বাকারার  ২৭১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,  ‘যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-খয়রাত কর, তবে তা কতই না উত্তম। আর যদি দান গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্তদের দিয়ে দাও, তবে তা তোমাদের জন্য আরও উত্তম। আল্লাহ তোমাদের কিছু গুনাহ দূর করে দেবেন। আল্লাহ তোমাদের কাজকর্মের খুব খবর রাখেন।’। 

ইসলাম ছাড়াও অন্যান্য ধর্মে দানের বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে বলা হয়েছে। যেমন- ঋগবেদ, ভগবদ্গীতা, বাইবেলেও দানের ব্যাপারে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে। 

ঋগবেদে বলা হয়েছে, “নিঃশর্ত দানের জন্যে রয়েছে চমৎকার পুরস্কার। তারা লাভ করে আশীর্বাদধন্য দীর্ঘজীবন ও অমরত্ব”-ঋগবেদ-১.১২৫.৬

বাইবেলে ঘোষণা করা হয়েছে, “ যখন দান করো গোপনে কর। তোমার নীরব দান সদাপ্রভু দেখছেন। তিনি তোমাকে পুরস্কৃত করবেন।”-মথি ৬:৩-৪

বেদে দান করা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি দুঃস্থদের সাহায্য করে না, অজ্ঞানী এবং অন্তঃদৃষ্টিহীন তার সকল উন্নতিই বৃথা, সকল সম্পত্তিই অনর্থক। যে অন্যদের সাহায্য করে না, অন্যকে অভুক্ত রেখে কেবল নিজে খায় সে মূলত পাপই ভোজন করে।’

‘ভোগে নয় ত্যাগেই প্রকৃত সুখ’ অতি মমার্থ একটি বাক্য। আমরা যদি একবার চিন্তা করি- আজ আছি কাল নাও থাকতে পারি। চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যেতে পারে হৃদযন্ত্র। তাহলে আমাদের কিসের এতো দাম্ভিকতা, কিসের এতো অহংকার, কিসের এতো বড়াই। একবার এই নিঃশ্বাসটা বন্ধ হলেই তো সব অন্ধকার। সব কিছু পড়ে থাকবে। কিছুই সঙ্গে যাবে না। তাই আসুন আমরা দেশের এই ক্রান্তিকালে মানুষের পাশে দাঁড়াই, বেশি বেশি দান করি, মানুষকে ভালবাসি, মানুষের পাশে থাকি  আর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদেরকে এই কঠিন বিপদ থেকে রক্ষা করেন। 

লেখক-সাংবাদিক