ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৯ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচেতনা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:২০ এএম, ১২ এপ্রিল ২০২০ রবিবার | আপডেট: ০৩:০৯ পিএম, ১২ এপ্রিল ২০২০ রবিবার

‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু, বিরহবেদন লাগে! তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে!!’
বাইশে শ্রাবণ! শুধু একটা দিন নয়! নয় অঝর শ্রাবণের বর্ষণ মুখরিত হৃদয় মন্থন শুধু! বাইশে শ্রাবণ পঁচিশে বৈশাখের পূর্ণ বৃত্তায়ন! এক ইন্দ্রপতনের স্মৃতিবিজরিত মহাকাব্য! বাংলার ইতিহাসের এক স্থিরবিন্দু সম ঐতিহাসিক সমাপতন! চলে গেলেন বিশ্ববন্দিত কবি রবীন্দ্রনাথ! চলেই কি গেলেন? নাকি শাশ্বত মহাসত্যের মত চিরন্তন হলেন! জল বাতাস সবুজ মাটি আর নীল আকাশের মত দিগন্ত বিস্তৃত সত্য হয়ে উঠলেন! "তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি!" ঠিক তাই, বঙ্গজীবনের পরতে পরতে তিনি রবীন্দ্রনাথ, আনন্দ অনন্ত জাগ্রত পূর্ণ সত্ত্বা! "তমসো মা জ্যোতির্গমোঃময়!’

‘জীবন আর মরণ তো একই সত্ত্বার দুই দিক- চৈতন্যে ঘুম আর জাগরণ যেমন!" বলেছিলেন কবি বাসন্তী দেবীকে; ১৫ই কার্ত্তিক ১৩৩৮-এ লেখা একটি পত্রে! কবির প্রজ্ঞায় ধরা পড়েছিল মৃত্যু কিন্তু বিলুপ্তি নয়! নয় মহাশূন্য! কবি অনুভব করেছিলেন, মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই জীবনের পরিপূর্ণ মুক্তি! সম্পূর্ণ প্রকাশ! পুরানো যা কিছু, তাকে নূতনের জন্য জায়গা করে দিয়ে যেতে হবে! মৃত্যুর সেই দূয়ারেই জীবনের মহাযজ্ঞ! আর মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই পরিণতির মাত্রায় প্রকাশিত হয় জীবন, তার পূর্ণতায়! সেই পরিপূর্ণতারই এক মহাকাব্যিক ক্ষণ বাইশে শ্রাবণ! রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ! বঙ্গ সংস্কৃতির ধ্রুপদী লগ্ন! বাংলার  ইতিহাসে এক যুগান্তরের সূচনা!

বাইশে শ্রাবণ তাই, শুধু মাত্র কবির মৃত্যুর দিন নয়! বাইশে শ্রাবণ ব্যক্তিত্বের সীমানা ছাড়িয়ে অসীম নৈর্ব্যক্তিক অনন্তে কবির সত্য হয়ে ওঠার দিনও বটে! রবীন্দ্রনাথকে সম্যক উপলব্ধি করতে হলে তাঁর এই সত্যমূল্যেই করতে হবে তাঁকে অনুভব! মৃত্যুকে বিলুপ্তির হাহাকারের সীমানায় যে দেখা, যে দেখার মধ্যে দিয়ে আপামর মানুষ কালের পথরেখা ধরে শোকে কাতর হয়ে বিলাপ করে চলে; রবীন্দ্রনাথেই বলে গেছেন, সে দেখা খণ্ডিত দেখা! তা অসম্পূর্ণ! তাই তা পূর্ণ সত্য নয়! শোক আমাদের গতি রোধ করে দাঁড়িয়ে থাকে! মুছে যেতে থাকে সামনের পথরেখা! জীবনের প্রবাহমানতা বিঘ্নিত হয়, শোকের আতিশয্যে বিহ্বল হয়ে আমরা মৃত্যুকে তার সত্যমূল্যে অনুভব করি না!

জীবনকে তার সত্যমূল্যে অনুভব করতে হলে মৃত্যুর প্রেক্ষিতে তাকে অনুধাবন করা প্রয়োজন! আত্মজীবনীর পরতে পরতে সে কথা উপলব্ধি করেছিলেন কবি তাঁর দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায়! তিরিশের দশকের অন্যতম প্রধান কবি সদ্য তরুণ অমিয় চক্রবর্তীকে লিখলেন, "....আমি ক্রমে বুঝতে পারলুম জীবনকে মৃত্যুর জানলার ভিতর দিয়ে না দেখলে তাকে সত্যরূপে দেখা যায় না! মৃত্যুর আকাশে জীবনের যে বিরাট মুক্তরূপ প্রকাশ পায় প্রথমে তা বড় দুঃসহ! কিন্তু তার পরে তার ঔদার্য্য মনকে আনন্দ দিতে থাকে! তখন ব্যক্তিগত জীবনের সুখদুঃখ অনন্ত সৃষ্টির ক্ষেত্রে হাল্কা হয়ে দেখা দেয়!" (৮ই আষার ১৩২৪) এখানেই রবীন্দ্র চেতনার অনন্যতা!

               রবীন্দ্রনাথের জীবনে মৃত্যুর সাথে প্রথম দেখা হয় জননী সারদা দেবীর মৃত্যুতে! কবির বয়স তখন তেরো! সারদা দেবীর মৃত্যু হয় ২৭শে ফাল্গুন ১২৮১ (১০ই মার্চ ১৮৭৫)! কবির বৌদি প্রফুল্লময়ী দেবীর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, হাতের উপর লোহার সিন্দুকের ডালা পড়ায় আহত আঙ্গুল পরে বিষিয়ে যায়! এর থেকেই মৃত্যু হয় সারদা দেবীর! কবির শৈশব কালের এই মৃত্যু তাকে বিশেষ ভাবে অভিভুত করতে পারে নি! কারণ ঠাকুর পরিবারের সাংসারিক আবহাওয়ায় কবির শৈশবের অধিকাংশ সময়ই কেটেছিল গৃহভৃত্যদের পরিমণ্ডলে! তার উপর অষ্টমগর্ভের সন্তান হিসেবে মাতৃ সাহচর্য্য পাননি সেরকম! ফলে মাকে হঠাৎ হারানোর অভাবটা সেই শৈশবে অনুভব করেননি কবি!
 এই প্রসঙ্গে জীবনস্মৃতিতে লিখছেন রবীন্দ্রনাথ, "মার যখন মৃত্যু হয়, আমার বয়স তখন অল্প! অনেকদিন হইতে তিনি রোগে ভুগিতেছিলেন, কখন যে তাহার জীবনসংকট উপস্থিত হইয়াছিল তাহা জানিতেও পাই নাই! এতদিন পর্যন্ত যে ঘরে আমরা শুইতাম সেই ঘরেই স্বতন্ত্র শয্যায় মা শুইতেন! কিন্তু তাঁহার রোগের সময় একবার কিছুদিন তাঁহাকে বোটে করিয়া গঙ্গায় বেড়াইতে লইয়া যাওয়া হয়- তাহার পরে বাড়িতে ফিরিয়া তিনি অন্তঃপুরের তেতলার ঘরে থাকিতেন! যে রাত্রিতে তাঁহার মৃত্যু হয় আমরা তখন ঘুমাইতেছিলাম, তখন কত রাত্রি জানি না, একজন পুরাতন দাসী আমাদের ঘরে ছুটিয়া আসিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, "ওরে তোদের কি সর্বনাশ হল রে!"
 "তখনই বউঠাকুরানী তাড়াতাড়ি তাহাকে ভর্ৎসনা করিয়া ঘর হইতে টানিয়া বাহির করিয়া লইয়া গেলেন পাছে গভীর রাত্রে আচমকা আমাদের মনে গুরুতর আঘাত লাগে এই আশঙ্কা তাহার ছিল! স্তিমিত প্রদীপে, অস্পষ্ট আলোকে ক্ষণকালের জন্য জাগিয়া উঠিয়া হঠাৎ বুকটা দমিয়া গেল, কিন্তু কী হইয়াছে ভালো করিয়া বুঝিতেই পারিলাম না! প্রভাতে উঠিয়া যখন মার মৃত্যু সংবাদ শুনিলাম তখনো সে কথাটার অর্থ ভালো করিয়া বুঝিতেই পারিলাম না! বাহিরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম, তাহার সুসজ্জিত দেহ প্রাঙ্গণে খাটের উপরে শয়ান! কিন্তু, মৃত্যু যে ভয়ংকর সে দেহে তাহার কোনো প্রমাণ ছিল না; সেদিন প্রভাতের আলোকে মৃত্যুর যে-রূপ দেখিলাম তাহা সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর!"

               "জীবন হইতে জীবনান্তের বিচ্ছেদ স্পষ্ট করিয়া চোখে পড়িল না কেবল যখন তাঁহার দেহ বহন করিয়া বাড়ির সদর দরজার বাহিরে লইয়া গেল এবং আমরা তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ শ্মশানে চলিলাম তখনই শোকের সমস্ত ঝড় যেন একেবারে এক দমকায় আসিয়া মনের ভিতরটাতে এই একটা হাহাকার তুলিয়া দিল যে, এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘরকরনার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না!"কবির মাতৃস্মৃতির এই বয়ানে একটা বিষয় পরিস্কার! তাঁহার মনস্তত্বের পরিসরে, বালক বয়সে মৃত্যুর সাথে এই প্রথম সাক্ষাৎকারের অনুভবটুকু বরাবরই ক্রিয়াশীল ছিল! প্রথম দেখা মৃত্যুর এই শান্ত সমাহিত রূপটিই তাঁর চেতনায় মৃত্যুর একটা স্থায়ী ছবি গড়ে তুলেছিল!

তবুও জীবনস্মৃতির এই পর্বেই বললেন কবি, শোককে ভুলবার শক্তি শৈশবেই প্রবল থাকে! শৈশব কোনো আঘাতকেই গভীরভাবে গ্রহণ করে না! "এইজন্য জীবনে প্রথম যে মৃত্যু কালো ছায়া ফেলিয়া প্রবেশ করিল তাহা আপনার কালিমাকে চিরন্তন না করিয়া ছায়ার মতোই একদিন নিঃশব্দপদে চলিয়া গেল!"
"কিন্তু আমার চব্বিশবছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়!" কবি বলছিলেন তাঁর প্রিয় বৌঠাকুরানী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর কথা ! কাদম্বরী আত্মহত্যা করেন! তাঁর এই আকস্মিক মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল ঠাকুরবাড়ি সহ রবীন্দ্রনাথকে! জীবনে এই প্রথম উপলব্ধি করলেন মৃত্যশোকের সুতীব্র যন্ত্রণা! প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যথা!

               কবির জীবনে মৃত্যুর এই প্রথম সুতীব্র অভিঘাত তাঁর সমগ্র সত্ত্বায় গভীর অনুরণন তুলে দিল! আকাশভরা সূর্য তারার এই যে পার্থিব জীবন, সেখানে বাকি সবকিছুই যেখানে আপন ছন্দে গতিশীল, সেখানে, জীবনের প্রিয় মানুষটিকে মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার আকস্মিক যে ছন্দপতন- সেই আঘাত; জীবনের একটা দিক যখন পুরো শূন্য করে দিয়ে যায়, সেই শোকের হাহাকারের সাথে পরিপার্শ্বের ছন্দময় চলমান জীবনের মাধুর্য্যকে মেলানো যে কি কঠিন সাধনা, সে কথা কাদম্বরীর আত্মহত্যায় প্রথম উপলব্ধি করলেন কবি শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রনাথ! প্রিয়জন বিয়োগের এই শূন্যতাকে মনের গভীরে মেনে নিয়ে জীবনের চলমান ছন্দে সামঞ্জস্য বিধান করা তো সহজ কথা নয়!

               শোকের এই নিবিড় অন্ধকারে মন যেমন ডুবে যায়, ঠিক তেমনই জীবাত্মার অন্তর স্বরূপ এই হাহাকারের বেড়া কেটে আলোকিত জীবন প্রবাহের মধ্যে মুক্তি পেতে চায়! কিন্তু সেই মুক্তি পাবার পথ সাধারণ ভাবে জানা থাকে না বলেই আমরা শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ি! আর তার ফলেই জীবন মৃত্যুর যুগল ছন্দের সঙ্গতের তালটুকু নিজেদের শোকগ্রস্ত পরিসরে ধরতে ব্যর্থ হই! কিন্তু তিনি রবীন্দ্রনাথ! কাদম্বরীর মৃত্যুই তাঁকে পথ দেখিয়ে দিল! অনুভব করলেন মানুষ "নিশ্চল সত্যের পাথরে গাঁথা দেওয়ালের মধ্যে চিরদিনের কয়েদি" নয়! উপলব্ধি করলেন "শোকের এই শূন্যতাকে মানুষ কোনোমতেই অন্তরের সঙ্গে বিশ্বাস করিতে পারে না! যাহা নাই তাহাই মিথ্যা, যাহা মিথ্যা তাহা নাই!"

               তাই, "যাহাকে ধরিয়াছিলাম তাহাকে ছাড়িতেই হইল, এইটিকে ক্ষতির দিক দিয়া দেখিয়া যেমন বেদনা পাইলাম তেমনি সেইক্ষণেই ইহাকে মুক্তির দিক দিয়া দেখিয়া একটি উদার শান্তি বোধ করিলাম! সংসারের বিশ্বব্যাপী অতি বিপুল ভার জীবনমৃত্যুর হরণপুরণে আপনাকে আপনি সহজেই নিয়মিত করিয়া চারি দিকে কেবলই প্রবাহিত হইয়া চলিয়াছে, সে ভার বদ্ধ হইয়া কাহাকেও কোনোখানে চাপিয়া রাখিয়া দিবে না, একেশ্বর জীবনের দৌরাত্ম্য কাহাকেও বহন করিতে হইবে না, এই কথাটা একটা আশ্চর্য নূতন সত্যের মতো আমি সেদিন যেন প্রথম উপলব্ধি করিয়াছিলাম!" লিখেছিলেন কবি জীবনস্মৃতির পাতায়! এই ভাবে প্রিয়জনের মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই ঐকান্তিক জীবনের রহস্য উপলব্ধি করলেন রবীন্দ্রনাথ!

               অতি প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যাথায় আমরা এতটাই বিহ্বল হয়ে থাকি বলেই নিজেদের জীবনের সীমানায় মৃত্যুর সৌন্দর্যটুকৄ অনুভব করতে পারি না! মৃত্যুর অন্ধকারই যে জীবনকে নিরন্তর আলোকিত করে রাখে, অনুধাবন করতে পারি না সেই সত্যও! টের পাই না, মৃত্যু এসেই প্রিয়জনকে আরও নিবিড়ভাবে অনুভবের-  মূল্যবান পরিসরটুকু প্রস্তুত করে দিয়ে যায়! কিন্তু সময়ের সাথে শোকের তীব্র দাহ প্রশমিত হয়ে এলে, পিছন ফিরে যতই স্মৃতিচারণ করি, ততই কিন্তু মৃত্যুর সেই অনিবার্য যন্ত্রণার মুহূর্ত্ত ছাপিয়ে জীবনের স্মৃতিবিজরিত অম্লান মুহূর্ত্তগুলির সুখস্মৃতিতেই সবাই মগ্ন হই, সুখানুভূতির স্পর্শে! এখানেই তো মৃত্যুর সৌন্দর্য! মৃত্যু তাই কেবলই জীবনের রঙ ফোটায়!
 রবীন্দ্রনাথের প্রিয়, "ছুটি"র মৃত্যু হল ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৩০৯ (২৩শে নভেম্বর, ১৯০২)! মৃত্যুকালে মৃণালিনী দেবীর বয়স হয়েছিল ঊনত্রিশ বছর! কবির তখন চল্লিশ! সমাপ্তি ঘটল মাত্র ১৯ বছরের দাম্পত্যপর্বের! সম্ভবত এপেণ্ডিসাইটিস হয়েছিল তাঁর! ঘটেছিল চিকিৎসাবিভ্রাট! এলোপ্যাথি ও হোমিওপ্যাথির যুগপৎ প্রয়োগে কোনটিই ফলপ্রসু হয়নি! পুত্র রথীন্দ্রনাথ স্মৃতিচারণ করেছেন, "মৃত্যুর আগের দিন বাবা আমাকে মায়ের ঘরে নিয়ে গিয়ে শয্যাপার্শ্বে তাঁর কাছে বসতে বললেন! তখন তাঁর বাকরোধ হয়েছে! আমাকে দেখে চোখ দিয়ে কেবল নীরবে অশ্রুধারা বইতে লাগল!" শান্তিনিকেতন গড়ে তোলার প্রথম পর্বেই কবি হারালেন তাঁর অন্যতম সহযোগীকে! শুরু হল আবার তার একলা চলা!

               কবির জীবনে স্ত্রীর মৃত্যুও বিশেষ অভিঘাত ফেলে যায়! তার পরিচয় রয়ে গেছে স্মরণ কাব্যগ্রন্থের ছত্রে ছত্রে! রয়ে গিয়েছে সমকালীন অনেক গানের কলিতে! স্মরণ গ্রন্থে লিখছেন-
"আজিকে তুমি ঘুমাও, আমি জাগিয়া রব দুয়ারে- রাখিব জ্বালি আলো!
তুমি তো ভালো বেসেছ, আজি একাকী শুধু আমারে বাসিতে হবে ভালো!"

               মৃত্যুর মধ্যে যে শোক, সেই শোকের শত যন্ত্রণা ছাপিয়েও এই যে ঐকান্তিক প্রেম; এই প্রেমের শক্তিই আমাদের সংলগ্ন রাখে জীবনের প্রবাহমানতার সাথে! কবি তাই মৃত্যুর মধ্যে বিচ্ছিন্নতাকে স্বীকার করেননি! মৃত্যুও প্রবাহমান জীবনের প্রধানতম অনুষঙ্গ! এই বোধ জাগ্রত থাকলে, শোক আমাদের পরাজিত করতে পারে না, বরং উত্তীর্ণ করে জীবনের পূর্ণতায়!

               এক বছরের মধ্যে হারালেন মেজ মেয়ে রেণুকাকে! ২৮শে ভাদ্র, ১৩১০ (১৪ই সেপ্টেম্বর, ১৯০৩) বেশ কিছুদিন যক্ষায় ভুগতে থাকা কন্যাকে আসন্ন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করছিলেন! স্মৃতিচারণে লিখছেন কনিষ্ঠা কন্যা মীরা দেবী, "বাবা রোজ সকালবেলায় ওঁকে বারান্দার এককোণে বসে উপনিষদ থেকে মন্ত্র পাঠ করে তার মানে বুঝিয়ে দিতেন! এমনি করে তাঁর মনকে সংসারের বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করবার পথে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিলেন যাতে ছেড়ে যেতে বেশি কষ্ট না পান! এই সময় বাবা যেন রাণীদিকে বেশি কাছে টেনে নিয়েছিলেন!" মৃত্যুশয্যায় রেণুকা কবির হাত ধরে আব্দার করেছিলেন, "বাবা ওঁ পিতা নোহাসি বলো!" অথচ কন্যার জীবন রক্ষার জন্যে কি না করেছিলেন কবি!

 কিন্তু মৃত্যু যখন অনিবার্য তখন তাকে শান্ত চিত্তে বরণ করে নিতে হয়! প্রাণের কষ্ট যখন মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে পরিত্রাণের পথ খোঁজে, তখন তার পথরোধ করে দাঁড়িয়ে জীবনকে অসম্মান করতে নেই! শোকের হাহাকারকে কোলাহলে মুখর না করে, মৃত্যুর আবহে জীবনের অপরিমেয় মূল্যকে অনুভব করা দরকার! এই শিক্ষা রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের জীবনের দুরন্ত শোকাবহ সুতীব্র অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই অর্জন করেন! প্রিয়জনের মৃত্যুশোক তাঁকে থামিয়ে দেয়নি! এগিয়ে দিয়েছে সৃজনশীলতার নতুন নতুন পল্লবিত শাখা প্রশাখার শাশ্বত পরিমণ্ডলে! এখানেই রবীন্দ্রনাথের অনন্যতা! মৃত্যুকে তিনি জীবনের চিরন্তন ছন্দের শাশ্বত তাল বলে উপলব্ধি করলেন শোকোত্তীর্ণ শান্তির মধ্যেই!

               রেনুকার মৃত্যুর দেড় বছরের মধ্যে কবি হারালেন তাঁর জীবনের দীক্ষাগুরু, পিতা দেবেন্দ্রনাথকে! মহর্ষির মৃত্যু হয় ৬ই মাঘ,১৩১১ (১৯শে জানুয়ারী ১৯০৫)! বয়সের ভারে দেহ রাখলেন তিনি ৮৯তম বছরে! কবির জীবনে এইপ্রথম মৃত্যুশোক এল সময়ের স্বাভাবিক গতিতে! অকাস্মাৎ অনাহূতর মতো নয়! মহর্ষির মৃত্যুর সাথে শেষ হল একটা শতাব্দী! কবি সাঁকো হয়ে রইলেন দুই শতাব্দীকে ধারণ করে! পিতার হাত ধরেই সংস্পর্শে এসেছিলেন উপনিষদের! বেদান্ত দর্শনের অন্তরেই ব্যক্তি জীবনের সাথে বিশ্বছন্দের সম্পর্ক সূত্রটিকে প্রথম অনুধাবন করেন কবি! আর এই বিষয়ে মহর্ষিই ছিলেন তাঁর প্রথম সহায়ক! ফলে পিতার মৃত্যুকে শোকের হাহাকারে নয়, জীবনের বড়ো ক্ষেত্রেই বরণ করলেন!

 "যে রাত্রে শমী গিয়েছিল সে রাত্রে সমস্ত মন দিয়ে বলেছিলুম বিরাট বিশ্বসত্তার মধ্যে তার অবাধ গতি হোক! আমার শোক তাকে একটুও যেন পিছনে না টানে, ......শমী যে রাত্রে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় (রাস পূর্ণিমা) আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েচে তার লক্ষণ নেই! মন বললে কম পড়েনি - সমস্তর মধ্যেই সবই রয়ে গেছে, আমিও আছি তার মধ্যে! সমস্তর জন্যে আমার কাজও বাকি রইল! যতদিন আছি সেই কাজের ধারা চলতে থাকবে...যা ঘটেচে তাকে যেন সহজে স্বীকার করি, যা কিছু রয়ে গেল তাকেও যেন সম্পূর্ণ সহজ মনে স্বীকার করতে ত্রুটি না ঘটে!"
 সদ্য সন্তান হারা কন্যা মীরাদেবীকে লেখা পত্রে (১২ই ভাদ্র, ১৩১৪) সান্ত্বনা দিয়ে কথাগুলি বলছিলেন কবি! কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ মারা যান ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৩১৪ (২৩শে নভেম্বর ১৯০৭) সম্পূর্ণ আকস্মিক ভাবে; মুঙ্গেরে বন্ধুর মামাবাড়ি বেড়াতে গিয়ে কলেরায় অকাল প্রয়াণ হয় শমীন্দ্রনাথের, মাত্র বারো বছর বয়সে! আদর করে কবি যাকে শমী ঠাকুর বলে ডাকতেন! কবি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর এই সন্তানটি তাঁর মতোই প্রতিভা নিয়ে জন্মেছে! তাই শমীকে হারানোর ব্যাথা গভীর ভাবেই বেজে ছিল তাঁর প্রাণে! কিন্তু ব্যক্তিগত সেই শোককেও বিশ্বসত্যের ছন্দের সাথে এই ভাবে মেলাতে পেরেছিলেন বলেই তিনি রবীন্দ্রনাথ! দুঃখ শোকের মধ্যেও যিনি বিশ্বপথিক !

               শান্তিনিকেতন থেকে, ১৪ই শ্রাবণ ১৩২৫  শ্রীমতি রাণু অধিকারীকে লিখছেন কবি, "আমার খুব দুঃখের সময়েই তুমি আমার কাছে এসেছিলে; আমার যে মেয়েটি সংসার থেকে চলে গেছে সে আমার বড়ো মেয়ে, শিশুকালে তাকে নিজের হাতে মানুষ করেছি, তার মত সুন্দর দেখতে মেয়ে পৃথিবীতে খুব অল্প দেখা যায়! কিন্তু সে যে মুহূর্ত্তে আমার কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেল সেই মুহূর্ত্তেই তুমি আমার কাছে এলে- আমার মনে হল যেন এক স্নেহের আলো নেবার সময় আর এক স্নেহের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেল! আমার কেবল নয়, সেদিন যে তোমাকে আমার ঘরে আমার কোলের কাছে দেখেছে তারই ঐ কথা মনে হয়েছে! তাকে আমরা বেলা বলে ডাকতুম!" বেলা অর্থাৎ মাধুরীলতার মৃত্যু হয় ২ জৈষ্ঠ ১৩২৫ (১৬-৫-১৯১৮)!
কিন্তু দুঃখ শোকে কাতর হয়ে বিহ্বল হলে তো চলবে না কবির! ঐ পত্রেই রাণুকে জানাচ্ছেন, "কেননা আমার উপরে যে কাজের ভার আছে; তাই আমাকে দুঃখ ভোগ করে দুঃখের উপরে উঠতেই হবে! নিজের শোকের মধ্যে বদ্ধ হয়ে এক মুহূর্ত্ত বৃথা কাটাবার হুকুম নেই আমার!" এরও আগে  শমীর মৃত্যুর পরপরই ৮ই জানুয়ারী ১৯০৮ বন্ধু জগদীশচন্দ্রকে লিখছেন,"আমাদের চারিদিকেই এত দুঃখ এত অভাব এত অপমান পড়িয়া আছে যে নিজের শোক লইয়া অভিভূত হইয়া এবং নিজেকেই বিশেষরূপে দুর্ভাগা কল্পনা করিয়া পড়িয়া থাকিতে আমার লজ্জা বোধ হয়!" এই ভাবে বৃহত্তর সমাজের দুর্দশার প্রেক্ষিতে ব্যক্তিগত শোকের উর্দ্ধে উঠে সামাজিক কর্মে ও তাঁর সৃজনশীলতায় নিজেকে সক্রিয় ও ফলবান রেখেছিলেন!

               দুঃখ শোকের খুঁটিতে বাঁধা না পড়ে, দুঃখ যন্ত্রণার মধ্যে থেকে জীবনের অনন্ত প্রবাহে নিজেদেরকে উৎসারিত করবার মন্ত্র দিয়ে গেলেন কবি- নিজের জীবনের দৃষ্টান্তের মধ্যে দিয়েই! শোককে দেখলেন বন্ধনমুক্তির উপায় হিসেবে! বিচ্ছেদকে করলেন বৃহৎ মিলনের পথের দিশারী! এই ভাবে ক্ষুদ্র আমির মোহ আবরণ কেটে বৃহৎ মানবিক আমিতে পৌঁছাতে মৃত্যুরও যে একটা সদর্থক ভূমিকা থাকতে পারে, সে সত্যই প্রমাণ করে গেলেন কবি, তাঁর ব্যক্তি জীবনের মৃত্যুশোকের বলয়ে! তাই মৃত্যু মানেই বিলুপ্তি নয়! নয় শূন্যতা! নয় রিক্ততা! মৃত্যুই জীবনকে পূর্ণতা প্রদান করে! তাই জন্ম মৃত্যুর মধ্যে জীবনের মূল অভিপ্রায়, তাঁর মতে- অনন্ত আনন্দরূপম!
আলোচনা শেষ করব একটি পত্র দিয়ে, শান্তিনিকেতন থেকে Mrs George Engel কে লিখছেন কবি, "I have some experience of death myself and I have come to realise that being inevitable it must have as great a meaning as life itself. The suffering which it causes is owing to a sudden interruption in our faith in life's reality; but we must know that every moment that passe carries the footstep of death which walks hand in hand with life as its ceaseless compenion. Life; only in its inseparable unity with death; is complete in its reality."

আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু,
বিরহদহন লাগে!
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ,
তবু অনন্ত জাগে!!
তবু প্রাণ নিত্যধারা,
হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে
বিচিত্র রাগে!
তরঙ্গ মিলায় যায়
তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে
কুসুম ফুটে!
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ,
নাহি নাহি দৈন্যলেশ---
সেই পূর্ণতার পায়ে
মন স্থান মাগে!

(সংকলিত)

এমএস/