মধ্যবিত্ত
বরজাহান হোসেন
প্রকাশিত : ০৩:১৭ পিএম, ১২ এপ্রিল ২০২০ রবিবার | আপডেট: ০৩:৩৩ পিএম, ১২ এপ্রিল ২০২০ রবিবার
গরমে মুখটা ঘেমে চুপসে গেছে মতিন মিয়ার। প্যান্টের পকেটে টিস্যু আছে কিন্তু মুখটা মুছার সাহসে কুলাচ্ছে না, কারণ লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলো যদি বুঝে ফেলে সে পুরুষ মানুষ। হাতে হ্যান্ড গ্লাভস পরেছে যেন পুরুষ মানুষের হাত সেটা বোঝা না যাই। এই মুহূর্তে বোরকা পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তিকর পোশাক মনে হচ্ছে মতিনের কাছে, আর হবেই বা না কেন জীবনে কখনও তো বোরকা পরে নাই মতিন মিয়া। পুরুষ মানুষ হয়ে বোরকা পরার নিয়মও নেই কোন দেশে।
কিন্তু আজ বাধ্য হয়েই স্ত্রীর বোরকাটা চুরি করে পরে বের হতে হয়েছে মতিন মিয়াকে। অবশ্য খুব কৌশলে স্ত্রীর বোরকাটা নিয়েছিল মতিন। সামান্য একটুর জন্য ধরা পরার হাত থেকে বেঁচে গেছে। ধরা পড়লে হয়তো কৈফিয়ত দিতে হতো স্ত্রীর কাছে মতিনকে। পুরুষ মানুষ হয়ে রাতে বোরকা পরে বের হচ্ছে এমন প্রশ্নের কোন জবাব ছিল না মতিনের কাছে। শুধু মতিন মিয়া না পৃথিবীর কোন স্বামীর কাছেই হয়তো এ প্রশ্নের কোন জবাব নেই। জবাব থাকবারও কথা না। রাতের খাবার শেষে স্ত্রী যখন রান্না ঘরে থালা-বাসন গোছাচ্ছিলো ঠিক তখনই কৌশলে স্ত্রীর অজান্তে বোরকাটা নিয়ে বেরিয়ে গেছে মতিন।
বাইরে এসে পড়লো আরেক বিপাকে। করোনা আতংকে লকডাউন চলছে। সন্ধ্যা ৬ টার পর চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। রাস্তা-পথ জনমানব শূন্য। রাত প্রায় সাড়ে নয়টা। ঢাকা শহরের রাস্তায় মতিন একা। একা মানুষ তাতে ভয় ছিল না, ঢাকা শহরের রাস্তায় রাতের বেলায় একা চলার অভ্যাস আছে মতিন মিয়ার। কিন্তু বড় ভয় সাথে থাকা বোরকাটা নিয়ে। পুরুষ মানুষ সাথে মেয়ে মানুষের বোরকা! তাও আবার রাতের বেলায়!
কিছুক্ষণ পরপরই সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাবের গাড়ী টহল দিচ্ছে। যদি সামনে পড়ে? যদি প্রশ্ন করে বোরকা কেন সাথে? উত্তর জানা নেই মতিনের কাছে। জানা থাকবার কথাও না। অতি বিপদে পড়েই আজ বোরকাটা নিয়ে বেরিয়েছে মতিন। বিপদে পড়লে নাকি মানুষের হিতাহিত জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়। মনীষীদের কথা এটা। মতিনের বেলায় হয়তো আজ তার ব্যতিক্রম ঘটবে না। যা ঘটে ঘটুক। বুকে শক্তি নিয়ে হাঁটতে থাকে মতিন।
রাস্তার পাশে একটা বন্ধ দোকানের চিপায় গিয়ে দাঁড়ালো মতিন। বোরকাটা বগলের নিচ থেকে বের করলো পরার জন্য। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো, বোরকা পরে একা একা রাতের বেলায় হাঁটবে বখাটে পোলাপান যি মেয়ে মানুষ ভেবে আটকায়? সেটাও তো একটা কথা। চাল চোরদের যেমন মানবতা নাই জঘন্য নিকৃষ্ট মনের মানুষ। গরীব দুঃখীদের জন্য সরকারের দেওয়া ত্রাণের চাল চুরি করছে বখাটেদের চরিত্রও তো ঠিক সেই চাল চোরদের মত জঘন্য! নিকৃষ্ট! নিষ্ঠুর! বোরকাটা বগলে নিয়েই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করে মতিন।
গত মাসের বেতনটা যদি হয়ে যেত তাহলে পরিবার নিয়ে এমন বিপাকে পড়তে হতো না মতিনকে। কোভিড-১৯ করোনা আতংকে লকডাউন চলছে। পেট তো আর লকডাউন মানে না? নিজে না খেয়ে একটু সামাল দেওয়া যায় কিন্তু স্ত্রী-সন্তানদের মুখে তো খাবার দিতে হবে। মধ্যবিত্তের জ্বালাটা আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মতিন মিয়া। তাই বাধ্য হয়েই বোরকা পরে ঢাকা হইকোর্ট মাজারের গেটে ছিন্নমূল মানুষগুলোর সাথে সাহায্যের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছে সে।
সহযোগিতা করবার যে কেউ নেই তা কিন্তু না। চক্ষু লজ্জায় নিজের পরিস্থিতির কথা অন্যের কাছে বলার সাহস নেই মতিনের। শুধু মতিন না মধ্যবিত্ত সব মানুষগুলো এ জায়গায় ভিতু। পাশের ফ্লাটের মোমিন ভাইয়ের কাছে চাইলেও সহযোগিতা করবে। কিন্তু মোমিন ভাই তাকে যে চোখে দেখে নিজের দুর্বলতার কথা জানলে সারা জীবন মাথা নিচু করে চলতে হবে তাকে। ব্যবসা করে বেশ ভালো পয়সা আয় করে মোমিন। নিজস্ব ফ্ল্যাট ঢাকা শহরে। গাড়ীও আছে নিজের।
লকডাউন হওয়ার দ্বিতীয় দিনই রিক্সা বোঝায় করে মাছ-মাংস কিনে আনলো। বাসার নিচে মতিনের সাথে দেখা হয়েছিল। মতিন নিজেই সহযোগিতা করে মাছ-মাংসের বস্তাটা উপরে তুলে দিলো। সিঁড়িতে উঠতে গিয়ে মতিন প্রশ্ন করেছিল এত মাছ-মাংস কেন? মোমিনের জবাব, লাকডাউন চলছে, ডীপ ফ্রিজটা নষ্ট ছিল সারিয়ে আনা হয়েছে। ফ্রিজ লোড করে খাবার থাকলে লকডাউন যতদিনই চলুক টেনশন থাকবে না।
কথা তো সত্যিই। লকডাউন মাসের পর মাস চললেও বড় লোকদের কোন চিন্তা থাকবে না। কারণ ডীপ ফ্রিজে বেশি জায়গা। অনেক দিনের খাবার রাখা যায়। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষের তো আর ডীপ ফ্রিজ নাই, লকডাউন নিয়ে তাদের টেনশনটা একটু বেশিই।
ডীপ ফ্রিজ কেনার সামর্থ নাই মতিনের। মাস গেলে যে কয় টাকা বেতন পায় তা মাস শেষ হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। বাকি দিন চলতে হয় ধারের উপর। অনেক কষ্টের সংসার তার।
লাইনে দাঁড়িয়ে অনেক কথায় ভাবলো মতিন। ঠিক রাত এগারটার দিকে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে একটা গাড়ী এসে থামলো গেটে। লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলোর মাঝে এক এক করে দেওয়া শুরু করে চাল ডালের ব্যাগ। বার বার ফোন টা বেজেই যাচ্ছে মতিনের। কয়েকবার কেটেও দিলো। তবুও বাজতে থাকে ফোনটা। স্ত্রী ফোন দিয়েছে বাসা থেকে। নিচু গলায় ফোনটা রিসিভ করে মতিন মিয়া বলে.. কতক্ষণ আর ঘরে থাকা যায় বলো? একটু হাঁটতে এসেছি তুমি শুয়ে পড়ো, গেটের চাবি আছে আমার কাছে অসুবিধা হবে না।
ফোনটা কাটতেই পেছন থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে আসে। মতিন ভাই...! পেছনে তাকিয়ে বিস্মিত মতিন! আকরাম মিয়াও লাইনে দাঁড়িয়েছে চাল-ডাল নেবার জন্য। কণ্ঠ শুনে মতিনকে চিনে ফেলেছে সে। মতিনের অফিসের কলিগ আকরাম। দুজন এক অফিসে চাকরি করে। আফসোস করে আকরাম মিয়া বলে, ‘কি আর করা মতিন ভাই... আমরা মধ্যবিত্ত!’
বাস্তবতা এটাই। লকডাউনের এ সময়ে শত শত মধ্যবিত্ত পরিবার পেটে ক্ষুধা আর চোখে লজ্জা নিয়ে দিনযাপন করছে তার কোনো ইয়ত্বা নেই। কী নিদারুণ কষ্টের মধ্যে দিন কাটছে তাদের তা হয়ত অনেকেই জানেন না। এদের দেখার কেউ নেই। খোঁজও রাখে না কেউ। রাখার প্রয়োজনও মনে করেন না আশপাশে থাকা বিত্তবানরা। কষ্ট করে হলেও কিছু কিছু ত্রাণ সামগ্রী পাচ্ছেন সমাজের অসহায়, গরীব দুঃখী মানুষগুলো। তারা কোথাও না কোথাও হাত পাততে পারছে। কিছু সহযোগিতাও পাচ্ছে। কিন্তু সমাজের এই মধ্যবিত্ত মানুষগুলো তারা কোথায় যাবে? কার কাছে হাত পাতবে? কে দিবে তাদের সান্ত্বনা?
লেখক-নাট্যকার
এমবি//