ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

ইথানল নয়, করোনা থেকে বাঁচাতে পারে সচেতনতা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৬:০৪ পিএম, ১৩ এপ্রিল ২০২০ সোমবার

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম

ইথানল দিয়ে করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) চিকিৎসা সম্ভব বলে সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের গবেষকদের রেফারেন্স উল্লেখ করে বিভিন্ন অনলাইন, প্রেস ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ইথানলের দ্রবণ দিয়ে কুলকুচা করে বা ইথানলের বাষ্প নিয়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা সম্ভব বলে উক্ত গবেষক দল উল্লেখ করেন। 

তবে এর বিরোধিতা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের আইডিতে একটি পোস্ট দেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম। তারা করোনা ভাইরাসের পরিবর্তে অন্য একটি আরএনএ ভাইরাসে আক্রান্ত মুরগির ওপর গবেষণাটি চালিয়েছেন বলেও তারা দাবি করেন তিনি।

সম্প্রতি এ বিষয়ে এবং করোনা থেকে বাঁচতে মানুষের করণীয় সম্পর্কে একুশে টিভির নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদদাতার সঙ্গে কথা হয় ইউজিসি থেকে এ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত ও ফার্মাকোজিনমিক্স এবং ক্যান্সার জিনোমিক্স গবেষক ড. মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামের সাথে।

তিনি বলেন, যুক্তিসংগত কারণেই আমি মনে করছি- এটি একটি অপরিপক্ক সিদ্ধান্ত। বাস্তবে ৭০% ইথানল অনেক ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও কিছু কিছু ভাইরাসের লিপিড বাই ল্যায়ার ও প্রোটিন ভেঙ্গে দেয় বিধায় হয়তো তাদের মারতে পারে। আর তাই আমরা স্যানিটাইজার হিসাবে শরীরের ত্বকে বা কোনকিছু জীবাণুমুক্ত করতে এটি ব্যবহার করি, যাতে ইথানল বা আইসো প্রোপাইল অ্যালকোহল থাকে। কিন্তু কোনো ধরনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ছাড়া মানব দেহের অভ্যন্তরে করোনা নির্মূলে ইথানল ব্যবহারের পরামর্শ দেয়াকে আমি গবেষণার এথিকসের লঙ্ঘন মনে করি। আমাদের এখানে মনে রাখতে হবে যে কোনো পদার্থ করোনা ভাইরাস বা অন্য কোনো অণুজীব মারতে পারলেই আমরা তা শরীরের ভেতর ব্যবহার করতে পারি না। এতে আমাদের জীবন নাশসহ নানা ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে। ইথানল দিয়ে কুলকুচা করলে তা যে কোনো সময় গলা থেকে পাকস্থলীতে এবং পরিশেষে তা লিভার ও রক্তে চলে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিষক্রিয়া তৈরি করতে পারে। ফলে মুখের মিউকাস আবরণী, লালাগ্রন্থি, মাড়ি, দাঁত, খাদ্যনালী, পিত্তাশয় ও হাড়ের ক্ষয় এবং লিভার ড্যামেজ হতে পারে।

ড. শফিক বলেন, ইথানলের বাষ্প আমাদের জন্য ইথানল পানীয়ের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর। কারণ ইথানলের বাষ্প সরাসরি মস্তিষ্ক ও ফুসফুসে যায়। বারবার ব্যবহারের ফলে এটি মস্তিষ্কে গিয়ে তীব্র নেশার সৃষ্টি করে। অন্যদিকে ফুসফুসে গিয়ে ফুসফুসকে ধীরে ধীরে ড্যামেজ করে দেয়। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, ইথানল মস্তিষ্কে হিস্টোন মোডিফিকেশনের মাধ্যমে ডিএনএ পরিবর্তনসহ জিনের এক্সপ্রেশন প্রভাবিত করে। ইথানলে বা মদে নেশাগ্রস্ত হলে মস্তিষ্কের বিচার বুদ্ধি কমে যাওয়া, বোধশক্তি বিকৃত হওয়া, সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া ও আত্ম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নষ্ট হওয়াতো আছেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ইথানলের ব্যবহার সম্পর্কে আগেই সতর্ককরে ইথানলের মারাত্নক ক্ষতির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। তা সত্ত্বেও, কোনো ধরনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ছাড়া শুধুমাত্র শরীরের বাহ্যিক পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে মানবদেহে এটি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে একটি গবেষক দল দেশের মানুষকে স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। সুমোরি শিন্তাকে নামে জাপানি এক গবেষক কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় ইথানল ব্যবহারের সম্ভাব্যতার কথা বলেছেন, অনলাইন রিপজিটরির একটি আর্টিকেলের মাধ্যমে। কোনো পিয়ার রিভিউ জার্নাল না এবং তিনি বার বার সতর্ক করেছেন যে, এটা তার ধারণা এবং এটা নিয়ে অনেক গবেষণার প্রয়োজন আছে ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া এই ব্যাপারে কাউকে সিদ্ধান্ত নিতে নিষেধ করেছেন। অথচ শরীরের ভেতর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া বিবেচনা না করে, এটি ব্যবহার করতে বলা হচ্ছে। 

ইথানল পান করলে মৃত্যুর ঝুঁকি আছে কি না- এ বিষয়ে ড. শফিক বলেন, অলরেডি আমাদের দেশের মানুষ ইথানল খোঁজা শুরু করে দিয়েছে এবং ইতিমধ্যেই অ্যালকোহল পান করে পাবনার ঈশ্বরদীতে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। যেহেতু মিথানল ও অন্যান্য ক্ষতিকারক পদার্থ মিশ্রিত ইথানলই (ভেজাল মদ) সস্তায় বা সহজে পাওয়া যায়। তাই সেটি খেয়েই ইরানের মতো একটি ট্রাজেডিও ঘটতে পারে। সম্প্রতি ইরানে ভেজাল মদ খেয়ে প্রায় ৬০০ লোক মারা গেছে ও ৩ হাজারেরও বেশি লোক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছে। জেনে রাখা ভালো যে, মিথানল ইথানলের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকর, যাকে বিষ বলা হয়ে থাকে। 

করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে আমাদের করণীয় কি জানতে চাইলে ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, করোনা ভাইরাস পুরোপুরি নিরাময়ের কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা বা ঔষধ এখন পর্যন্ত বের হয়নি। বের হলে, মৃত্যুর মিছিল উন্নত দেশগুলোতে এত বড় হতো না, যাদের মধ্যে অনেকেই আবার ইথানল ব্যবহারকারী। তাই আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দিতে হবে। তাছাড়া, সঙ্গরোধ প্রক্রিয়া মেনে চলতে হবে, ঘর থেকে এই সময়ে বের হওয়া যাবেনা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, সন্দেহভাজন করোনা রোগী এড়িয়ে চলতে হবে। নিজে নিজে ঔষধ না খেয়ে জ্বর, সর্দি বা কাশি হলে ডাক্তারের পরামর্শ মত ঔষধ খেতে হবে। এছাড়া করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য, ভিটামিন-সি যুক্ত খাবার যেমন লেবু, কমলা এবং টমেটো খেতে হবে। কালোজিরা, মধু, শাকসবজি, সিজনাল ফল ও সুষম খাবার খেতে হবে। কাঁচা হলুদ, আদা এবং লেবুর শরবত বা চা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। পানি খেতে হবে প্রচুর পরিমাণে ও মাঝে মাঝে গরম পানি দিয়ে কুলকুচা করতে হবে এবং বেশি ঠান্ডা লেগে গেলে বা নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা দিলে ফুসফুসকে জীবাণু মুক্ত করার জন্য গরম পানির বাষ্প নেয়া যেতে পারে। অবশ্যই হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা সাবান বা ডিটারজেন্ট ব্যবহার করে ২০ সেকেন্ডব্যাপী হাত ধৌত করতে হবে। হাঁচি বা কাশি দেবার সময় হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতে হবে এবং থুথু বা কাশির ড্রপলেট ভালভাবে পরিষ্কার করতে হবে। নাকে, মুখে বা চোখে হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে এবং মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামের জন্ম ১৯৭৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর, কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দিতে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। 

এই ফার্মাকোজিনোমিক্স এবং ক্যান্সার জিনোমিক্স গবেষক ঢাবি থেকে ফুসফুসের ক্যান্সার জিনোমিক্স নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি ও জাপানের সিমানে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মাকোজিনোমিক্স নিয়ে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৫ সালে এশিয়া প্যাসেফিক ইউনিভার্সিটি, এর পূর্বে নোভারটিজ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ও মিডল ইস্টে ফার্মাসিস্ট হিসাবে চাকরী করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনালগ্নে ২০০৬ সালে ১৮ জুন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন।

এনএস/