ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

অবরুদ্ধ জীবনে বাংলা নববর্ষ ও একুশের একুশ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৪:০৮ পিএম, ১৪ এপ্রিল ২০২০ মঙ্গলবার

‘আজি হতে শতবর্ষ পরে/ কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতুহল ভরে/ আজি হতে শতবর্ষ পরে/ আজি নববসন্তের প্রভাতের আনন্দের/ লেশমাত্র ভাগ/আজিকার কোনো ফুল, বিহঙ্গের কোনো গান/ আজিকার কোনো রক্তরাগ/ অনুরাগে সিক্ত করি পারিব না পাঠাইতে/ তোমাদের করে/ আজি হতে শতবর্ষ পরে।’- কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই যুগদর্শী কবিতাখানি বাঙালীর বর্ষবরণ উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। প্রেরণার উৎস। বাংলা নববর্ষ এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ এক সূত্রে গাঁথা। আজ ১ বৈশাখ, ১৪২৭, বাংলা নববর্ষ। আজ একুশে টেলিভিশনের জন্মদিন। একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশ মানে প্রতিবাদ। সেই উৎসব আজ করোনা নামের ভাইরাসে আক্রান্ত। অদৃশ্য এই শক্তি মানুষের প্রাণের স্পন্দনকে আজ অবরুদ্ধ করে রেখেছে। বন্ধ করে রেখেছে চার দেয়ালের মধ্যে। এমন দিনে অর্থাৎ বৈশাখের প্রথম দিনে দেশের প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন একুশে টিভির জন্মদিন। অবরুদ্ধ জীবনে একুশে টিভি আজ একুশ বছরে পদার্পণ করেছে।

বৈশাখী উৎসব যেমন একদিনে আসেনি; ঠিক তেমনি একুশের এই পথ চলাও অনেক ত্যাগ, সংগ্রাম ও উত্থানপতনের। করোনার মত অদৃশ্য শক্তিকে পরাজিত করে একুশ আজ শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

১৯৯৩ সালের বর্ষবরণ ছিল বঙ্গাব্দ ১৪০০ সালের সূচনা। উৎসব-আয়োজন ছড়িয়ে পড়েছিলো দেশজুড়ে। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শান্তি, গণতন্ত্র ও বাঙালীর জাতি স্বত্ত্বার প্রতীক হিসেবে মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়ে উঠেছিলো জাতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। 
বাঙালীর এ প্রাণের উৎসবকে সার্বজনীন করার ইতিহাস-যাত্রার দির্ঘ পথ ফুল বিছানো কোমল সড়ক ছিলো না। তৎকালীণ ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার এই আবহমান সংস্কৃতির চেতনাকে বাধাগ্রস্ত করেছিলো। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সব আয়োজন বন্ধে সরকারের ছিলো কড়া আদেশ। বঙ্গবন্ধুর বাঙালী দমেনি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার মহানায়কের এক ডাকেই বাঙালী অস্ত্র হাতে নিয়েছিলো যেমন, তেমনি স্বাধীনতার লাল সবুজ পতাকা নিজের করে তবেই যুদ্ধের ময়দান ছেড়েছে। জাতির পিতার রক্ত যার ধমনীতে তিনি কি শাসকের রক্তচক্ষু ভয় করেন? সে সময়ের বিরোধী দলীয় নেতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা কবি সুফিয়া কামালকে আহবায়ক করে নতুন শতাব্দী বরণে পর্ষদ গড়ে তুলেছিলেন। বাঙালীর আত্মপরিচয় আরো একবার প্রকাশ পেয়েছিলো চিরসংগ্রামী হিসেবে। আর সেক্ষণেও দৃঢ় নেতৃত্ব ছিলো শেখ হাসিনার। বাধা নিষেধ ভেঙে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সবখানেই চূড়ান্ত আবেগে  নতুন শতাব্দীকে বরণ করে নিয়েছিলো নিয়ত সংগ্রামশীল বাঙালী। সাম্প্রদায়িকতা, কুপমন্ডকতা আর তৎকালীন রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতার বেড়াজাল ডিঙিয়েই পুর্ণতা পায় বর্ষবরণ উৎসব। সেই স্রোতধারার অন্যতম পেরণা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

এর আগে সময়টা ১৯৮৫ সাল। ক্ষমতায় স্বৈরাচারী এরশাদ। কয়েকজন তরুন মাত্র চারুকলার পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ফিরে গেছেন নিজ শহর যশোরে। সেখানে গিয়ে তারা ‘চারুপীঠ’ নামে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন। উদ্দেশ্য রঙ, পেন্সিল আর কাদামাটি দিয়ে শিশুদের শৈশব রাঙানো। এই চারুপীঠ থেকে তাঁদের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। কেউ কি তখন জানতো এই মঙ্গল শোভাযাত্রা একদিন জাতীয় উৎসবে পরিণত হবে! স্বীকৃতি পাবে ইউনেস্কোর। হবে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ! পালাপার্বণ, হালখাতা কিংবা মিঠাইমন্ডাইয়ের মতো বৈশাখী মেলাও হয়ে উঠবে একান্ত বাঙালী সংস্কৃতি!

জাতিসংঘের সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় ২০১৬ সালের ৩০ শে নভেম্বর অন্তর্ভুক্ত হয় বাংলাদেশের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। অশুভ শক্তির বিরূদ্ধে শান্তি, গণতন্ত্র ও বাঙ্গালী জাতিসত্বার ঐক্যের প্রতীক হিসেবে মঙ্গল শোভাযাত্রা আজ জাতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এ উৎসব সার্বজনীন করতে এতটুকু কার্পণ্য করেননি সংস্কৃতির একান্ত অনুরাগী সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। ধর্মীয় আবরণ কিংবা সাম্প্রদায়িকতার খোলস ভেঙে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষকে অবাধে এক কাতারে নিয়ে আসতে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা ভাষাভিত্তিক এই রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ অর্জনের অংশ। জাতিসত্বা ও স্বাধীনতার ইতিহাস মুছে ফেলতে সংস্কৃতি আর ভাষার ওপর ক্রমাগত আঘাত প্রতিহত করেই আজ বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি বিশ্ব দরবারে আপন মহিমায় প্রতিষ্ঠিত। আমাদের দূতিময় সংস্কৃতির সবচেয়ে বেশি আলো ছড়ানো হীরক খণ্ড নববর্ষের অসাম্প্রদায়িক চেতনা।

২০ বছর আগের কথা। ২০০০ সালের ১৪ এপ্রিলও ছিল বাংলা নববর্ষ বাঙালির চিরায়ত উৎসবের দিন। ওইদিনই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে বেসরকারি খাতে প্রথম টেরেস্ট্রেরিয়াল টেলিভিশন স্টেশন একুশে টেলিভিশন।
পরিবর্তনের অঙ্গিকারবদ্ধ স্লোগান নিয়ে প্রতিষ্ঠা হওয়া একুশে টেলিভিশন মাত্র ২৮ মাসের মধ্যে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ, বৈচিত্রময় অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য্য ছড়িয়ে জয় করে কোটি মানুষের মন। এরপরেই ২০০২ সালে রাজনৈতিক রোষের শিকার হয় একুশে টেলিভিশন। আইনী জটিলতার অজুহাতে বন্ধ করে দেয়া হয় দর্শকপ্রিয় চ্যানেলটি। কিন্তু আইনী লড়াইয়ে ২০০৫ সালে আদালত একুশে টেলিভিশন সম্প্রচারের বৈধতা দেয়। বন্ধ করতে যতটা তাড়াহুড়া, খুলে দিতে ততোটাই টালবাহানা। শেষ পর্যন্ত ২০০৭ সালে আবারো সম্প্রচারে আসার পর থেকে নানা ঘাত প্রতিঘাত পার করে একুশে টিভি পা রাখলো গৌরবের একুশ বছরে। 

বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার আলোকবর্তিকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, করোনা যুদ্ধের কঠিন সময়েও ভুলে যাননি বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতিকে। ভোলেননি একুশে টেলিভিশনকে। জন্মদিনের শুভেচ্ছা বাণীতে অবাধ তথ্য প্রবাহ এবং সুস্থ বিনোদনে একুশের ভুমিকার প্রশংসা করেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সংবাদ ও অনুষ্ঠান দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের পাশে দাঁড়াবে, এ অঙ্গীকার প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধরের।
যদিও এবার একুশে টেলিভিশন জন্মদিন পালন করছে এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। বিশ্বব্যাপি করোনা মহামারী চলছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশ মোকাবেলা করছে এই সংকটকাল। প্রশাসনের পাশাপাশি গণমাধ্যম কর্মীরা দায়িত্ব পালন করছে ঝুঁকি নিয়ে।

একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশ মানে অহংকার। পরিবর্তনে অঙ্গীকারাবদ্ধ স্লোগান নিয়ে যে একুশ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। তার মাথা যেন সবসময় উঁচুই থাকে। এই যাত্রার শুভ নব চেতনায় একুশের পাল তুলে একুশ এগিয়ে যাক দৃপ্ত পায়ে সামনে আরও সামনে। দশ দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ুক একুশের চেতনা।

সংবাদ বিনোদনে দেশের কোটি দর্শকের চাহিদা পূরণে একুশে টেলিভিশন এগিয়ে যাবে স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে এটাই সবার প্রত্যাশা।

এসএ/