মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে
রাশেদ আহমেদ
প্রকাশিত : ০৭:৩১ পিএম, ১৪ এপ্রিল ২০২০ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৮:৩১ পিএম, ১৪ এপ্রিল ২০২০ মঙ্গলবার
আমাদের হৃদয়ের গহীন থেকে উদ্ভাসিত চেতনার নাম একুশ। আর আমাদের সংষ্কৃতির উচ্ছাসের নাম পহেলা বৈশাখ। একুশ আমাদের জাগ্রত করে। বৈশাখ আমাদের রক্ত কনিকা উজ্জীবিত করে স্পর্ধার আবরণে। বাঙালির চেতনা ও সংষ্কৃতির আবরণের নির্যাস থেকে নামকরণ করা হয়েছে একুশে টেলিভিশন। এই নাম শরীরে স্পন্দন জাগায়। এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী নতুনের কেতন ধরতে উৎসাহিত করে।
একুশে টেলিভিশন আমার কাছে অসংকোচ প্রকাশের বিশাল ক্ষেত্র বলে মনে হয়েছে। এক যুগ আগে আমি যখন সেখানে কাজ করেছি কোন বাঁধা মানতে চাইনি। নিজেরই অজান্তে দুরন্ত সাহস জেগেছিল মনে। এই সাহস হয়তো প্রতিষ্ঠানটির নাম ও জন্মদিন পহেলা বৈশাখের উচ্ছাস থেকেই পাওয়া। অসাধারণ একটি নাম একুশ। আর তা সম্প্রচারে আসে পহেলা বৈশাখে। এর কৃতিত্ব অবশ্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তিনিই পছন্দ করে এই নামটি দিয়েছিলেন।
শুরুতে যাই, একুশ যেমন নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে চেতনা শাণিত করেছে বৈশাখ দেখিয়েছে দাপট। তেমন আমরাও একুশে টেলিভিশনে দাপট দেখাতে চেয়েছিলাম। বার্তা বিভাগে আমাদের ভালো একটি কর্মপ্রাণ জোটবদ্ধ দল ছিল । ২০০৭- ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নানা বিধি-নিষেধের মধ্যেও অনেক সংবাদ মানুষকে দিতে চেষ্টা করেছি। তখন সম্প্রচার মাধ্যম ছিল হাতে গোনা কয়েকটি। তাই কিছু একটা করলেও দর্শক, সরকার ও কর্তৃপক্ষের নজর কাড়তো। ওই সময় সংবাদ প্রচার নিয়ন্ত্রিত একটা পরিবেশের মধ্যে থাকলেও আমরা দেশের গণতন্ত্র ও মানুষের মুক্তির আকাংখা নিয়ে কাজ করতাম। দিনরাত পরিশ্রম করতে পারতাম। কোন ক্লান্তি ছিলনা।
আমার মনে আছে ২০০৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে যখন নিত্যপণ্যের দাম হঠাৎ করে আকাশচুম্বি হয়ে গেলো তখন সাধারণ মানুষের দু:খ-দুর্দশা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি, গ্রাম-গঞ্জ থেকে। সরকারকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি-যে ভালো নেই কোন কিছু। এক পর্যায়ে গ্রেফতার হলেন শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা। এরপর গ্রেফতার হন বেগম খালেদা জিয়া। গ্রেফতারের তালিকা বাড়তে থাকলো বিএনপিতেও। এ অবস্থায় সংবাদ করতে হয়েছে অনেক সাহস নিয়ে।
যখন সাধারণ নির্বাচন হওয়ার আশা দেখা দিল, নানা প্রতিবেদন করতে হয়েছে সেই জনমত তৈরিতে। ২০০৮ সালের অক্টোবর-নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে সারাদেশে ছুটছি তো ছুটছি কাঁধে ট্রাইপড হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে। শুধু আশা গণতান্ত্রিক একটি শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন হোক রাষ্ট্রে। ওই বছর ডিসেম্বর মাসের কথা বলি এবার। আগের দিন ঢাকার বাইরে থেকে ফিরে ১৪ ডিসেম্বর ভোররাতে মীরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে গেলাম রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধার অনুষ্ঠান কভার করতে। ফিরে আরেকটি অনুষ্ঠান কভার করে এই রাতে রওনা হলাম সিলেটে। ১৫ ডিসেম্বর সকালে সেখানে সুশীল সমাজের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মতবিনিময় করেন। সেটি কভার করে নিউজ পাঠিয়ে খেয়ে-দেয়ে বিকেলে রওনা করলাম ঢাকার পথে। মধ্যরাতে ফিরলাম। সামান্য একটু ঘুমিয়ে আবার রাত সাড়ে ৪ টায় রওনা দিলাম সাভার স্মৃতিসৌধে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধাঞ্জলির এস্যাইনমেন্টে। ভিআইপিদের অনুষ্ঠান কভার করতে হলে আগেভাগে সেখানে উপস্থিত হতে হয়, সেটি সবারই জানা। যাহোক সাভারের অনুষ্ঠানিকতা, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যাশা, সাধারণ মানুষের চাওয়া সব মিলিয়ে একটি প্যাকেজ করলাম, কারওয়ান বাজার একুশে টেলিভিশন অফিসে এসে। তখন আমার চোখে রাজ্যের ঘুম। দুপুরে বাসায় ফিরতেই শরীর ছেড়ে দিল বিছানায়। ছেলে-মেয়ে আমাকে কাছে পায়না তাই মেয়ের আবদারে সন্ধ্যায় যেতে হলো একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে। সেখানে বসেই অফিস থেকে ফোন পেলাম ভোরে যেতে হবে বিএনপির নির্বাচনী সফরে। উত্তরাঞ্চলে তিন দিনের সফরএ যাবেন খালেদা জিয়া। প্রচণ্ড শীত তাই বেশি করে গরম কাপড় নিতে হবে। এই তিন দিনের সফর শেষ করে আবার যেতে হবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী সফরে। বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার সফর কাভার করলে নির্বাচনী হাওয়া কোন দিকে আছে তার একটি আন্দাজ পাওয়া যাবে। তখন পর্যালোচনা করা সম্ভব হবে নির্বাচন নিয়ে-এ ধরণের চিন্তাভাবনা ছিল অফিস ম্যানেজমেন্টের।
১৭ ডিসেম্বর সকালে ক্যান্টনমেন্টে খালেদা জিয়ার বাসার সামনে দাঁড়ালাম। খালেদা জিয়া ৮টার দিকে রওনা দিলে তার পেছনে পেছনে ছুটলাম। প্রতি ঘণ্টার সংবাদ বুলেটিনে নিউজ আপডেট দিচ্ছি, ফোনো লাইভে। খালেদা জিয়া বিভিন্ন জায়গায় পথ সভা করেন। দৌঁড়ে গিয়ে তার বক্তৃতা ও ছবি নিতে হয়। দুপুর ১ টার সংবাদ বুলেটিনে আমি ঢাকার স্টুডিওর সঙ্গে ফোনে সংযুক্ত হয়ে আছি আর আমার গাড়ি ছুটছে। জায়গাটি সিরাজগঞ্জের হাটিকমরুল। অপরদিক থেকে আসা একটি বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ। আমার গাড়ি দুমড়ে-মুচড়ে গেলো। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় স্টুডিওর সঙ্গে সংযোগ। আমার মাথা ফেটে রক্তস্রোত বের হচ্ছে। মুখের চোয়াল ভেঙে ঝুলে গেছে। সামনের ৫টি দাঁত খসে পড়েছে। ডান হাতের কনুই ভেঙে উল্টো হয়ে আছে। আমার ক্যামেরাম্যান আসাদ, ড্রাইভার রুবেলও দুর্ঘটনায় রক্তাক্ত-বিধ্বস্ত। তাৎক্ষণিকভাবে অফিস কিছুই বুঝতে পারেনা, বোঝাও সম্ভব ছিলনা। বিভিন্ন টেলিভিশনে ব্রেকিং নিউজের স্ক্রল চলার পর একুশে টেলিভিশনে কান্নার রোল পড়ে যায়।
যা হোক অন্য টেলিভিশনের সহকর্মীরা আমাদের তিনজনকে উদ্ধার করে পুলিশের সহায়তায় প্রথমে সিরাজগঞ্জের একটি মেডিকেল ক্লিনিক, পরে সেখান থেকে বগুড়া হাসপাতালে নিয়ে গেলো। জটিল পরিস্থিতিতে দু’দিন পর আনা হলো ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। আমি তখন জীবন-মৃত্যুর সীমান্তে। অনেকেই বাঁচার আসা ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমার জ্ঞান আসলো তিনদিন পর। এই সময়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ড. ফখরুদ্দিন আহমদ, সেনাবাহিনীর প্রধান মইন উ আহমদ ও উপদেষ্টাসহ অনেকেই আমার চিকিৎসার নিয়মিত খোঁজ খরব নিতেন।
ডিসেম্বরের শেষে নির্বাচন হলো, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের জয় এবং সরকার গঠন হলো, দেশে গণতন্ত্র এলো। আমি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখলাম।
একেবারে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা ওই ঘটনার পর আমার দ্বিতীয় জীবন শুরু। পুরো ৬ মাস আমাকে বিছানায় শুয়ে কাটাতে হয়েছে। কিন্তু তখনও আমার উদ্দোম কমেনি। সুস্থ হয়ে আবারও মাঠে ছোটার আকাংখা তাড়িত করতো। শুধু মনে হতো আমার কথা বলার স্বাভাবিকতা যেনো থাকে, হাত দু’টোতে যেনো শক্তি পাওয়া যায় আর পা দু’টো যেনো সচল থাকে। সৃষ্টিকর্তা আমার সেই চাওয়া পূরণ করেছেন। আমি আবার মাঠে নামি বছরখানেক পর। যদিও পরে আর একুশে টেলিভিশনে থাকা হয়নি নানা কারণে। সে কথা আজ না বলি। তবে মাথা নত না করার একুশের চেতনা ও বৈশাখের দাপট আজও আমার সাংবাদিকতাকে অলোকিত করে। যেটি এ পেশায় ঢোকার শুরু থেকেই ধারণ করেছি। সল্প সময় হলেও একুশে টেলিভিশন আমাকে শাণিত করেছে।
আশা করি একুশে টেলিভিশনের বর্তমান প্রজন্মের সদস্যরা সেই চেতনা নিয়ে কাজ করবেন। মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশের কথাই পৌঁছে দেবেন।
তাদের ভেতরে সবসময় যেনো উচ্চারিত হয়-‘মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে। উদার আলোক মাঝে উন্মুক্ত বাতাসে।’ তবেই একুশ তার মর্যাদা ধরে রাখতে পারবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, মাছরাঙা টেলিভিশনে কর্মরত।