ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

করোনা সঙ্কটের আর্থ-সামাজিক স্বরূপ

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ০৪:৪৫ পিএম, ১৫ এপ্রিল ২০২০ বুধবার | আপডেট: ০৪:৫০ পিএম, ১৫ এপ্রিল ২০২০ বুধবার

না, করোনা সম্পর্কে ‘কেউ কিছ বলতে পারে না’। এর সংক্রমণের ব্যাপারে আমরা কিছু কিছু জানি, সবটা জানি না; এর প্রতিকার বিষয়ে কিছু কিছু জ্ঞান আমাদের আছে, তবে পুরোটা নয়। এই ঘাটতি শুধু সাধারণ মানুষের নয় - চিকিৎসক, গবেষক, বিশেষজ্ঞ সবারই প্রায় এক অবস্থা। তাই একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, একটা কথাই সত্যি - আসলে করোনার ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে কোন বিশেষজ্ঞই বিশেষজ্ঞ নয়। আমি বলি, আসলে আমরা সবাই ‘বিশেষভাবে অজ্ঞ’।

বর্তমানে সারা বিশ্ব যখন করোনা সামলাতে ব্যতিব্যস্ত - সংক্রমণ রোধে ও মৃত্যু ঠেকাতে, তখন নানান তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহের কোন সময় নেই এবং এটা এ মুহূর্তে অগ্রাধিকারও পাবে না। কেউ এখন বলতে পারবেন না, যাঁরা সংক্রমিত, যাঁরা হাসপাতালে চিকিৎসারত, কিংবা যাঁরা মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন, তাঁরা সমাজের কোন জায়গা থেকে এসেছেন, কোন আয়-স্তরের মানুষ তাঁরা, শিক্ষাগত অর্জন সেখানে কোন তারতম্য করে কি না ইত্যাদি। আগামী দিনে কোন একদিন এসব প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত লভ্য হবে এবং তখন গবেষকদের কাজের মাধ্যমে করোনা সঙ্কটের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটটি সঠিকভাবে বোঝা যাবে।

তবে নানান বিষয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও বর্তমান অবস্থায় করোনা সঙ্কটের আর্থ-সামাজিক বিষয়ে তিনটি প্রবণতা সুস্পষ্ট - এক, যাঁরা বিশেষ কতগুলো রোগ - যেমন, ক্যান্সার, হৃদরোগ, প্রমেহ, হাঁপানি ইত্যাদি দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, করোনা মৃত্যুর মূল শিকার তাঁরা; দুই, পুরুষের চেয়ে নারীর এবং তরুনদের চেয়ে বৃদ্ধদের অনুপাত বেশি; এবং তিন, জাতিগত বা বর্ণগত সংখ্যালঘুদের অনুপাত বেশি।

প্রথম প্রবণতা স্বব্যাখিত। যে সব রোগের কথা বলা হয়েছে, তাতে যাঁরা ভুগছেন, সে সব জনগোষ্ঠীর যে কোন জীবাণু প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক ভাবে কম। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই তারাই করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর মূল শিকার হয়েছেন।

দ্বিতীয় প্রবণতা সম্পর্কে কিছুটা বলা প্রয়োজন। নারী তুলায় পুরুষেরা করোনা মৃত্যুর মূল শিকার। চীনের ৩ হাজার ৫০০ করোনা মৃত্যুর মধ্যে ৬৪ শতাংশ পুরুষ, আর ৩৬ শতাংশ নারী। বৃটেনে এ পর্যন্ত করোনা মৃত্যুর ৭০ শতাংশ পুরুষ ও ৩০ শতাংশ নারী। অর্থাৎ পুরুষের মৃত্যুর হার নারীর দ্বিগুণ। এর কারণ বিবিধ। নারীর একটি জৈবিক শারীরিক সু অবস্থা আছে, যার কারণে নারীর প্রত্যাশিত গড় আয়ু বেশি। সেই সঙ্গে ধূমপান ও অতিরিক্ত মদ্যপানের প্রকোপ পুরুষের মাঝে বেশি, সুস্বাস্থ্য অভ্যাস পুরুষের চেয়ে নারীর ভালো, এবং হৃদরোগ বা প্রমেহের মতো রোগের আপাতন পুরুষের চেয়ে নারীর মধ্যে কম। যে কোন জীবাণু প্রতিরোধের ক্ষমতা বয়োবৃদ্ধদের কম তরুণদের চেয়ে। করোনাও তার ব্যত্যয় নয়। ফলে করোনা মৃত্যুহার বয়োবৃদ্ধদের চেয়ে বেশি। 

তৃতীয় প্রবণতায় আসি। যুক্তরাষ্ট্রে দেখা গেছে যে প্রতি চারজন করোনা সংক্রমিত মানুষের একজন কৃষ্ণাঙ্গ। বৃটেনেও এ জাতীয় প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। হয়তো আগামী সময়ে যখন অন্যান্য দেশের উপাত্ত লভ্য হবে, তখন হয়তো দেখা যাবে যে, সংখ্যালঘুরাই সংক্রমিত হয়েছিলেন বেশি এবং মৃত্যুর আপাতনও তাঁদের মাঝেই বেশি ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে উচ্চতর সংক্রমণের কারণের কিছু কিছু কাঠামোগত এবং কিছু কিছু প্রায়োগিক। কাঠামোগত দিক থেকে বিচার করলে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী ঐতিহাসিক দিক থেকেই দরিদ্র, বঞ্চিত ও অসমতার শিকার। তাঁরা স্বল্প শিক্ষিত, তাঁদের পুষ্টির অভাব রয়েছে এবং তাঁদের জীবনযাত্রার মান নিম্ন। ন্যূনতম সামাজিক সুবিধাও তাঁদের কাছে লভ্য নয়। সুতরাং কাঠামোগত দিক থেকে তাঁরা যে কোন সঙ্কট-ভঙ্গুর। 
সেই সঙ্গে প্রায়োগিক অনেক কারণও এর সঙ্গে যুক্ত। কৃষ্ণাঙ্গরা বেশির ভাগই কর্ম-মইয়ের নীচের দিকে অবস্থান করেন। এর ফলে একদিকে যেমন তাঁদের সঞ্চয় কম, অন্যদিকে কাজের জন্যে তাঁদের ঘরের বাইরে আসতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাঁদের জীবনযাত্রা প্রণালীর প্রকৃতির কারণেও ঘরের মধ্যে সেমাজিক জনদূরত্ব বজায় রাখা তাঁদের জন্যে কষ্টকর। তাঁরা যে সব অঞ্চলে বসবাস করেন, সেখানে স্বাস্থ্য সুবিধা ও সেবাও সীমিত। এই সব প্রায়োগিক কারনেও তাঁদের করোনা-ভঙ্গুরতা বেশি। সুতরাং কাঠামোগত ও প্রায়োগিক কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে করোনার আপাতন ও মৃত্যুর হার বেশি।

শেষের কথা বলি, সারা বিশ্বেই দেখা যাচ্ছে যে করোনা শিশুদের তেমন একটা স্পর্শ করছে না। কি আছে শিশুদের যে তারা করোনাকে এড়িয়ে চলছে? এ মুহূর্তে এর কোন উত্তর নেই। কোন একদিন হয়তো এর ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। কিন্তু এ মুহূর্তে আমার একটি পরম তৃপ্তি সেখানেই যে আমাদেরকে শিশু সংক্রমণ ও মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হচ্ছে না।