ঢাকা, বুধবার   ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪,   আশ্বিন ১০ ১৪৩১

লকডাউন থেকে বলছি

মোহাম্মদ শাহজাহান চৌধুরী 

প্রকাশিত : ০৪:৪০ পিএম, ১৬ এপ্রিল ২০২০ বৃহস্পতিবার

মোহাম্মদ শাহজাহান চৌধুরী 

মোহাম্মদ শাহজাহান চৌধুরী 

গোটা বিশ্বের মানুষ আজ যেন করোনায় হার মেনেছে। কোন শক্তিই কাজে আসছেনা। পরাক্রমশালী পরাশক্তিরাও হাবুডুবু খাচ্ছে। অর্থাৎ, করোনায় যেকোন সময় যে কারো মৃত্যু অনিবার্য। আমাদেরও প্রায় একই অবস্থা। গরীব, ধনী কিংবা ক্ষমতাবান কোন ভেদাভেদ নেই। যারা কানাডা, আমেরিকা বা ইউরোপে বাড়ি-গাড়ি সম্পদ গড়েছেন তারাও আজ অসহায়। 

চার মাস পার হতে চলছে। বিশ্বব্যাপী যেন একটি (ভৌগোলিক বা সামাজিক) সিনেমা প্রদর্শিত হচ্ছে। কেউ বলতে পারছে না চলচ্চিত্রটি কখন শেষ হবে।

দুনিয়ার মানুষ লকডাউনে তালাবদ্ধ হয়ে আছি এবং সময়ের সাথে ছবির আপডেট গুনছি। কেউ হাই তুলছি, খাচ্ছি দাচ্ছি কেউবা ঘুমাচ্ছি, কেউ অন্তিম ঘুমে ঢলে পড়লে কাছেও যাচ্ছি না। কেমন যেন দয়া মায়াহীন এক বিভীষিকা গ্রাস করছে সবাইকে। শুধু শিহরণ জাগছে না মনে।

মনে হচ্ছে কেউ যেন একটা সীমাহীন ফিতায় সেলুলয়েটে ছেড়ে দিয়েছে এই সিনেমা। কি অপূর্ব মিল মানুষের তৈরি ছকে বাঁধা সিনেমা ‘কন্টাজিয়ন’ ও ‘ট্রেন টু বুসান’ এর সাথে। যেন এই ছবিগুলির বাস্তব প্রতিফলনই হলো ‘করোনা ভাইরাস পালা’।

সমগ্র বিশ্বের মানুষ আজ নিজের অজান্তে এই ছবির দর্শক, ইচ্ছা করুক বা নাই করুক। কোন সিনেমা হল নেই, টিকেট কাউন্টার নেই, চেকার নেই, সবাই সবার আবাসে নীরব দর্শক।

হলিউডের ভৌতিক ছবিগুলো প্রদর্শিত হবার সময় যেমন ভয়ে পাশের জনের দিকে তেমন খেয়াল থাকে না, এই ছবি শুরু হওয়ার পর থেকেও আমরা কেউ কারো নই। সবাই আপন সবাই পর। প্রদর্শনী থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। ছবি শেষ হচ্ছে না।

হয়তো কোন একদিন সবকিছু স্বাভাবিক হবে। ব্যবসায়ী ব্যবসায় যাবে, শিক্ষক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কৃষক মাঠে, সবাই তার পেশায় ফিরে যাবে। কিন্তু, পর্দায় যবনিকা চিত্রটি কেন এখনও ভেসে উঠছে না কে জানে। রিলে মাষ্টার কে? চলছে ছবি বিরামহীনভাবে। সহস্র কোটি দর্শকের প্রশ্ন শেষ হবে কবে? ছবির শেষ দৃশ্যের মিলন দেখতে যে আমরা বড় ভালবাসি।

কিন্ত মিলন হবে কত দিনে?
আমাদের যেন কিছুই করার নেই। শুধু বলছি প্রভু আমাদের ক্ষমা ও দয়া করো। এই মহামারি থেকে আমাদের মুক্ত করো। 

তবে এই মহামারি আমাদের অনেক নৈতিক উন্নতি করেছে বলে মনে হয়। মাত্র ক’দিন আগেও মানুষের মূল্যবোধ তেমন করে উপলব্ধি করা খুবই কষ্টকর হতো। প্রায় সবার মাঝে এক ধরনের অহমিকাপূর্ণ দূরত্ব বিরাজমান পরিলক্ষিত হতো। 

ক্ষমতার জোর, অতি ধার্মিকের বড়াই, নদী ভোজনকারীদের জোর, বন খেকোদের জোর, ভূমি দস্যু দের দৌরাত্ম, ক্যাসিনো মাফিয়াদের আস্ফালনসহ আরো কতোকি? সারাদেশেই একইচিত্র ছিল। পৃথিবীজুড়ে অস্ত্র নিয়ে হোলি খেলা, কেউ সোনার দাম নিয়ে, কেউবা জ্বালানি নিয়ে, কেউ লগ্নি আর কেউ সুদের দর কষাকষি নিয়ে।

পৃথিবী নামক গ্রহটাকে কিছু মানুষের (যারা নিজেদেরকে ভিন্ন গ্রহের মানুষ ভাবত) করাল থাবায় বিষাক্ত করে ফেলেছিল। হয়ত এখনও ওঁত পেতে আছে। বিশ্বময় এই সংকট (করোনা ভাইরাস) কেটে গেলে আবারও তারা পুরনো মুখোশ নিয়ে নেমে পড়বে।

অবশ্য তার কিছু আলামত ইতিমধ্যে আঁচ করা যাচ্ছে। সরকারি ত্রাণ নিজের নামে চালিয়ে দিচ্ছে, কেউবা তা নিজের বাসায় মজুদ করছে। আধা কেজি চাউল দিতে ১৪ জনের ফটোসেশন শুভ ইঙ্গিত বহন করছে না। 

এই কদিন আগেও মানুষের মূল্যবোধ তেমন করে উপলব্ধি করা খুবই কষ্টকর হতো। আসলে তাই, বাবা ছেলেকে বুঝতে কষ্ট হতো, স্বামী তার সহধর্মিণীকে, শ্রমিক তার মালিককে, ক্রেতা বিক্রেতাকে, দরদামের কোন সামন্জ্স্য নেই, কথা বার্তার মধ্যে তারতম্য।

সর্বোপরি মানুষ একরকম ধোঁয়াশার মধ্যে দিনাতিপাত করতে ছিল। কেউ কাউকে সময় দেবার একটু সময় হাতে ছিল না। হোক সে সরকার।

এমনি এক পরিস্তিতিতে সারা বিশ্ব দিশেহারা ঠিক তখনই পৃথিবীজুড়ে বিশাল করাল থাবা নেমে এলো সবার অলক্ষ্যে। কেউ জানে না এটা কি? কি তার পরিচয়? কে তার আবিষ্কারক? কে তার মালিক?
বলা হচ্ছে চীনের উহান শহর থেকে তার সৃষ্টি? উহান হবে কেন শুধু? কেউ কি এর আগে এরকম সিনড্রম নিয়ে পৃথিবীতে মৃত্যু বরণ করেনি? এর আগে কি কারো গলা ব্যাথা হয়নি?

হয়ত হয়েছে, মানুষ ও মরেছে। কিন্তু এ রকম দুনিয়াজুড়ে মহামারি রুপে মানুষের মৃ্ত্যুর মিছিল এই গ্রহের মানুষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর দেখেনি।

করোনা নামক ভাইরাসটি চীনের উহান শহরে প্রথম আক্রমণ করলেও এখন পর্যন্ত এত বড় চীনের অন্য শহরগুলোতে ছড়ায়নি। এমনকি চীনের আশেপাশে প্রচুর দেশ রয়েছে ওইসব দেশগুলি থেকেও সংক্রমণের তেমন কোন খবর আসেনি।

অথচ চীন থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের মহাদেশ ইউরোপ ও আমেরিকায় রীতিমত মৃত্যুর মিছিল চলছে। প্রতিক্ষণ সবাই হয়তো ক্ষণ গণনায় জপছে যে তার পালা বুঝি এই এলো। করোনাভাইরাস ব্যাপারটা রীতিমত রহস্যঘেরা। একবার মনে হয় পৃথিবী নামক গ্রহে আমরা যে অনাচার, অত্যাচার করছি এটা মহান সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে তার নির্দশন। আরেকবার মনে হয় হয়তো আমাদের পৃথিবীর হিস্যা নিয়ে আমাদের কর্তৃক হিংসার বহিঃপ্রকাশ। তাহলে কেউ কি এই করোনাকে বানিয়েছে?

যেহেতু আমার কাছে জোরালো তথ্য প্রমাণদীর সংকট আছে, তাই আমার প্রথম মনে হওয়া সন্দেহকে মেনে নিয়েই মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রতিনিয়ত ক্ষমা ভিক্ষার রত আছি।

মূল্যবোধের দিক দিয়ে করোনা ভাইরাসের কারণে পৃথিবীর মানুষ যারা আপনজন ভুলে শুধু ব্যবসা, ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তাদেরসহ সবাইকে একটা সুযোগও করে দিয়েছে যে সবাই হোম কোয়ারেন্টাইনে। এ থেকে আপনজনদেরকে সময় দিতে পারছে, যা তারা কোন দিন ভাবতেও পারেনি যে এরকম অখণ্ড অবসর পাবে।

সবাই সবার মতো পরিবারের সুখ, দুঃখের খবরা-খবর গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারছে। সৃষ্টিকর্তার ইবাদত করতে পারছে। সর্বোপরি মানবিক হওয়ার চেষ্টা করছে।

তবে ঘরে থাকার এ সময়ে সবচেয়ে সংকটে আছেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা। কারণ, তাদের তো দিন এনে দিন খাওয়া অবস্থা। কিভাবে চলবে তাদের জীবন। 

আমরা পৃথিবীর সাধারণ মানুষরা সৃজনশীলতা ও স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি যে একদিন সুদিন আসবে, আবার মানুষ অধিকার নিয়ে কথা বলবে। ন্যায়কে ন্যায়, অন্যায়কে অন্যায় বলবে। মানুষ বুঝার এই রকম মোক্ষম সময় হয়ত আমাদের জীবদ্দশায় আর পাব না।

যেহেতু কোথাও নিরাপত্তা নেই, তাই শেষ সময়ে আসুননা একটু মানবিক হই। অসহায় মানুষদের প্রতি মানবিক হাত বাড়িয়ে দিই। সরকার একা সবকিছু পারবে না। আপনাদের সামর্থ ও সম্পদের সামান্য কিছু দিলেই অসহায় ক্ষুধার্ত মানুষের জীবন বেঁচে যাবে। আর এই মানবিক উদ্যোগ ও দানের কারণে আপনি ও আপনার পরিবারও বেঁচে যেতে পারে। স্রষ্টার দয়ায় আপনি সুস্থ থাকতে পারেন।

এমবি//