সমন্বিত ত্রাণ ব্যবস্থাপনা জরুরি
মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ
প্রকাশিত : ০৭:০৬ পিএম, ১৬ এপ্রিল ২০২০ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১০:৫২ পিএম, ১৬ এপ্রিল ২০২০ বৃহস্পতিবার
সম্প্রতি রাজধানীর এক এলাকায় ত্রাণের জন্য অপেক্ষারত মানুষ- সংগৃহীত
বিশ্ব এখন কঠিন একটা সময় পার করছে। এ বাস্তবতার কঠিনতম অবস্থার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের আক্রমণে সবকিছু স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রায় একমাস ধরে চলা বিছিন্নতার (লকডাউন) জন্য বিড়ম্বনায় পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। দেশে বিভিন্ন স্থানে ত্রাণের দ্রব্যাদি বন্টনে দেখা যায় অবস্থাপনা। প্রকৃত অসহায়রা পাচ্ছেন না যথাযথ সহযোগিতা।
ত্রাণ কার্যক্রমে বেশিরভাগ ধারাবাহিকতা এখনও আসেনি। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থা এবং বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা শহরে এবং শহর এলাকার বাইরে গ্রামে স্বল্প পরিসরে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই মুহূর্তে দরকার সমন্বিত একটি ত্রাণ ব্যবস্থাপনা কমিটি। যে কমিটি সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড বা ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহল্লা, থানা, উপজেলা, জেলা, বিভাগ এবং কেন্দ্রকে সমন্বয় করবে। এতে করে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যাদেরই সাহায্য প্রয়োজন তারাই ত্রাণ পাবেন। সম্পদের স্বল্পতা দিয়েও প্রয়োজন মেটানো যায় তাতে দরকার হয় সঠিক ব্যবস্থানা ও পরিকল্পনা। তেমনি সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার মধ্যমে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করা গেলে দুর্যোগের এ সময় অন্তত ক্ষুধায় কষ্ট পাবে না একজন নাগরিকও।
একইসঙ্গে প্রয়োজন ত্রাণ কার্যক্রমে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। বিশেষ করে ব্যক্তি উদ্যোগে দেয়া সাহায্যদাতার নিজ নিজ এলাকায় ত্রাণ দেওয়ার ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলে ভালো হয় বলে মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। তারা বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাকে ভিন্ন ভিন্ন আকারে ভাগ করে দেওয়া যেতে পারে। নির্দিষ্ট করা থাকলে দাতা এবং গ্রহীতার সমন্বয় করা সহজ হয়। এক্ষেত্রে যথাযথ মানুষজনের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হয়। কিছুদিন আগে ত্রাণ কার্যক্রম নিয়ে এক প্রতিবেদনে একুশে টেলিভিশনকে নিজের মতামত তুলে ধরেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. সানজিদা ফরহানা। ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালার প্রয়োজন রয়েছে উল্লেখ করে এ নৃবিজ্ঞানী বলিছিলেন, ‘আমাদের দেশে প্রায়ই বিভিন্ন দুর্যোগ দেখা দেয়। এক্ষেত্রে একটা নীতিমালা অবশ্যই জরুরী। এ নীতিমালায় ত্রাণদাতা থেকে শুরু করে ত্রাণ প্রত্যাশী এবং এসবের সমন্বয়ের কথা উল্লেখ থাকবে।’
গত ৮ এপ্রিল (২০২০) প্রকাশিত প্রতিবেদন: ত্রাণ কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতা প্রয়োজন নীতিমালা ।
গত কয়েকদিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেছি এবং দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার ত্রাণ কার্যক্রম দেখেছেন আমাদের প্রতিনিধিরা। বিভিন্ন স্থানে ত্রাণপ্রার্থী অসহায় মানুষকে দলবেঁধে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। কেউ কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও কিছুই পাচ্ছেন না। এখন ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে বিচ্ছিন্নভাবে। যারা রাস্তায় নামতে পারছেন তারাই শুধু ত্রাণ পাচ্ছেন। যারা রাস্তায় যেতে পারছেন না তারা ত্রাণ পাচ্ছেন না। আবার রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও সাহায্য পাচ্ছেন না কেউ কেউ।
বরিশাল নগরীতে গত ১৫ এপ্রিল ত্রাণের জন্য বিক্ষোভ করেন কর্মহীন মানুষজন- একুশে টেলিভিশন
করোনাকালের এ সময় দেখা যাচ্ছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা এবং ব্যক্তি উদ্যোগেও ত্রাণ বা সাহায্য সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। এরপরও খাদ্যের কষ্টে আছেন কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমজীবী মানুষ। বোঝা যাচ্ছে ত্রাণের পর্যাপ্ততা থাকলেও অসহায়দের হাতে পৌঁছাচ্ছে না। আবার এমনও দেখা যাচ্ছে যে, এই এক মাসের মধ্যে কেউ কেউ পেয়েছেন মাত্র এক বা দুই কেজি চাল, আধা কেজি ডাল, কয়েকটা পেঁয়াজ এবং একটা বা দুইটা সাবান।
বিশিষেজ্ঞরা বলছেন, ব্যবস্থাপনাটা ঠিক যথাযথ এখনও হয়ে ওঠেনি। এ ক্ষেত্রে একটা কমিটি করা যেতে পারে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এ কমিটি গঠন করে তা কার্যকর করা যেতে পারে। প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কেন্দ্রীক একটি ত্রাণ কেন্দ্র থাকবে। দেশের সব এলাকাতেই কোন না কোন ইউনিয়ন বা পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভূক্ত। সেক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের ওয়ার্ডে ত্রাণ কেন্দ্র করতে হবে। এই কেন্দ্র থানা বা উপজেলা, জেলা, বিভাগ হয়ে কেন্দ্র বা রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। এ ক্ষেত্রে ত্রাণের কোন অব্যবস্থাপনা হবে না। কেউ যদি ত্রাণ দিতে চান তাহলে তিনি সরাসরি তার ওয়ার্ডের কেন্দ্রতে যোগাযোগ করবেন। তিনি ত্রাণের জন্য দ্রব্য বা নগদ অর্থ বা যে কোন সাহায্যই দিতে পারেন। এতে করে ওই কেন্দ্র তার এলাকায় ঘাটতি পূরণ করবে। এখানে জনসংখ্যার অনুপাতে ত্রাণ পর্যাপ্ত হলে কেন্দ্রটি আর উদ্বৃত্ত রাখবে না। কোন ত্রাণ মজুদ করা হবে না। প্রয়োজনের বেশি থাকলে সেটা থানা বা উপজেলায় দেওয়া হবে। উপজেলা আবার নিজের প্রয়োজন পূরণ করে জেলায় পাঠাবে। এমনভাবে বিভাগ এবং এক পর্যায়ে কেন্দ্র বা রাজধানীতে আসবে। এ ক্ষেত্রে দেখা যাবে নীলফামারিতে কেউ ত্রাণ দিল সেই ত্রাণ দিয়ে রাঙ্গামাটির প্রয়োজন পূরণ হলো। আবার রাঙ্গামাটির ত্রাণ যশোরে গেল। তবে বিষয়টি হতে হবে খুবই দ্রুত। এখানে তথ্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তবে যারাই এ কার্যক্রমে যুক্ত থাকবেন তারা অবশ্যই দক্ষ হবেন।
রাজধানীতে ‘সঙ্গে থাকি’ নামের একটি সংগঠন কিছুদিন যাবত অসহায়দের ত্রাণ দিচ্ছে। এ সংগঠনের প্রধান জসিম উদ্দিন খান বলেন, ‘রাস্তায় নেমে ত্রাণ বিতরণ করা কঠিন হয়ে উঠেছে। কারণ ত্রাণ দিতে দেখলেই মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এতো বেশি মানুষ আসে যে তাদের সবাইকে দেয়া সম্ভব হয়ে উঠছে না।’ তিনি জানান, এখন তারা একটা অ্যাপ তৈরী করছেন। রাজধানীর মধ্যে কেউ তাদের কাছে সাহায্যের আবেদন করলেই তারা বাসায় পৌঁছে দিচ্ছেন সাহায্য।
জসিম উদ্দিন খানের কথায় দেখা যাচ্ছে, তাদের কাছে অসহায়দের দেয়ায় মতো ত্রাণ থাকলেও শুধু মাত্র ব্যবস্থাপনার কারণে দেওয়া যাচ্ছে না। একই সঙ্গে যে এলাকায় দিচ্ছেন সে এলাকায় হয়ত অন্য কেউ দিয়েছেন অর্থাৎ ঐ দিন ঐ এলাকায় আর ত্রাণের প্রয়োজন নেই। কিন্তু অন্য এলাকায় প্রয়োজন আছে তা হয়ত তারা জানেন না। এ ক্ষেত্রে সমন্বিত কার্যক্রম অনেক কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে। এছাড়া ত্রাণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় সামাজিক দূরত্ব বা স্যোসাল ডিসটেন্স না মানার যে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তাতে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। সহায়তা বা ত্রাণ প্রত্যাশীদের নিশ্চিত করতে হবে যে, তারা ত্রাণ পাচ্ছেন। তাদেরকে ক্ষুধা নিয়ে থাকতে হবে না। ব্যবস্থা হচ্ছে। তাহলে অন্তত তাদের ঘরে রাখা যাবে। ক্ষুধা পেটে মানুষদের বেশি দিন বন্দি রাখা যাবে না।
অধ্যাপক সানজিদা ফরহানাও একুশে টেলিভিশনকে জানিয়েছিলেন, ত্রাণ দানে কিছুটা সমন্বয়হীনতা কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক সমন্বয় জরুরী। অতিসত্ত্বর এলাকাভিত্তিক কমিটি করে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করতে বা অব্যাহত রাখতে হবে। ওই কমিটিরই দায়িত্ব থাকবে সংশ্লিষ্ট এলাকায় ত্রাণ কার্যক্রম নিশ্চিত করা।
এমএস/এনএস