ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

কিশোর মুক্তিযোদ্ধা মোশাররফ মাশারের অজানা গল্প

অমিতাভ চক্রবর্তী

প্রকাশিত : ১০:২৫ পিএম, ১৭ এপ্রিল ২০২০ শুক্রবার

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের একজন নারায়নগঞ্জের আশা সিনেমা হলের মালিক প্রয়াত মেহেবুব হোসেনের ছেলে মোশাররফ হোসেন মাশার। তখন উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, বয়স মাত্র আঠার। দীপ্ত তারুণ্যে উচ্ছল মাশার বাল্যকাল থেকেই ছিল বন্ধুবৎসল ও পরোপকারী। স্কুলে অনেক গরিব সহপাঠীকে বই খাতা কলম কিনে দিত। ঝগড়া বিবাদ মারামারির মীমাংশায় সর্বদাই ছিল বিচারকের ভূমিকায়। অনেক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে ওর প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় সংযোগ ছিল। টানবাজার শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিল।

একজন সমাজসেবক ও রাজনীতি সচেতন হিসেবে নারায়ণগঞ্জ শহরে বিপুল জনপ্রিয়তা থাকলেও শত্রুর অদৃশ্য কালো হাত তাকে বাঁচতে দেয়নি। টানবাজারের কুখ্যাত অবাঙ্গালী দালাল কাপাডিয়া গণহত্যাকারী পাক হানাদার বাহিনীকে নিয়ে এসে হত্যা করে মাশারকে। শহরে কারফিউ থাকায় বুলেটবিদ্ধ মাশারকে হাসপাতালে নেওয়া যায়নি। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মায়ের কোলে মাথা রেখে মা বাবা ভাই বোনদের সামনে ২৯ মার্চ মাশার মৃত্যুবরণ করে।

মাশারের মতো লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়। শহীদের স্মৃতি রক্ষার্থে নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসে ছাত্রলীগ বা সিটি করপোরেশনে শহীদ মাশারের জীবন ও কর্মের উপর কোনো তথ্য সংরক্ষিত আছে কিনা আমার জানা নেই। শীতলক্ষ্যার পাড়ে নির্মিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবনে একটি শহীদ স্মৃতি জাদুঘর করা যেতে পারে।

ব্যক্তিগতভাবে মাশার আমার স্কুল জীবনের সহপাঠী বন্ধু ছিল। আমাদের অনেক মধুর বিধুর স্মৃতি রয়েছে। আমরা উভয়ে উভয়ের বাসায় মাঝে মাঝেই এক থালায় ভাত খেতাম। রাতে এক বিছানায় শুয়ে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়তাম। ঈদে পূজোয় জন্মদিনে নববর্ষে আমরা পরস্পরকে কার্ড বিনিময় করতাম। একই শহরে কাছাকাছি থেকেও প্র‍য়োজনে অপ্রয়োজনে চিঠি লিখতাম। অধিকাংশ স্মৃতিচিহ্নই আজ বিলুপ্ত হয়েছে। এখনও দু'একটি যা আছে তার মধ্যে আমার একাত্তরের দিনলিপির পাতার ভাঁজে রক্ষিত কয়েকটি ছবি ও টিস্যু কাগজের রুমালে মুদ্রিত একটি "ঈদ মুবারক"।

সেখানে চার লাইনের পদ্য-

ঈদের দিনে দিলাম তোমায়
এইটুকু মোর দান
তুচ্ছ বটে এ দেওয়া মোর
তুচ্ছ না তার মান।

এতে স্বাক্ষরের নিচে সিলমোহরে লেখা -
Mosharraf Hossain Mashar
President
Tanbazar Student League

আমি তখন ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত ছিলাম। রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আমাদের বন্ধুত্বে কখনোই ফাটল ধরেনি।

খুব ছোটবেলায় মাশার একটু বেঁটে ছিল। তাই ওর জ্যেঠা মাহতাব সাহেব ওকে আদর করে বাটখারা নামে ডাকতেন। সেই থেকে মাশার নিজেও ওর নামের সাথে 'বাটখারা' লিখতো। একটি ছাপানো লেটারহেডও তৈরি করেছিল "বাটখারা এন্ড সন্স" নামে। এ সবই ছিল ওর ছেলেখেলা। আমরা দুজন পার্টনারশিপে নিয়মিত ব্যাডমিন্টন খেলতাম ওদের আশা সিনেমা হল প্রাঙ্গণে। জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতিযোগিতামূলক খেলায় অংশগ্রহণ করে আমরা সর্বদাই চ্যাম্পিয়ন হতাম।

করোনাকালীন দুঃসময়ে এমন কতো স্মৃতি যে আমার অখন্ড অবসরকে অধিকার করে আছে!

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড।