করোনা ব্যবস্থাপনা
সাব্বির আহমেদ
প্রকাশিত : ০৪:২০ পিএম, ১৯ এপ্রিল ২০২০ রবিবার
সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। পৃথিবীর এমন কোন দেশ বা অঞ্চল নেই যেখানে সে পৌঁছায়নি। অসম্ভব ছড়িয়ে পরার শক্তি নিয়ে উদ্ভূত হয়েছে করোনা ভাইরাস। এখন পর্যন্ত এর কোন প্রতিষেধক নেই; নেই কোন দমন করার ঔষধ। চীন থেকে ভাইরাসটি ভ্রমণকারীদের সঙ্গে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। চীনের পর একেক দেশে করোনা একেক দিন শনাক্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে ইউকে, ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকা, চীন, ইতালি, ইরান, তুর্কি এবং প্রতিবেশি ভারতে প্রথম ৪০ দিনে করোনাভাইরাস ছড়ানোর গতির একটা তুলনা করে দেখা গেছে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস চীন, ইতালি, ইরান, তুর্কি এবং স্পেনের তুলনায় কম গতিতে ছড়িয়েছে কিন্তু ইউকে, ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকা এবং ভারতের তুলনায় বেশি গতিতে ছড়িয়েছে।
এপ্রিল মাস শেষে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আমেরিকা ও ইউরোপের মত হওয়ার সম্ভাবনা দিন দিন বেড়ে চলছে। ভাইরাসটি বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হয় ৮ মার্চ; এই লেখার দিন থেকে ৪২ দিন আগে এবং চীনে অফিসিয়ালি প্রথম শনাক্ত হওয়ার ৬৭ দিন পরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভাইরাসের ছড়ানোর ক্ষমতা এবং বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পরার সম্ভাবনা নিয়ে প্রথম থেকেই হুশিয়ারি উচ্চারণ করে এসেছে। তারপরেও এই ৬৭ দিনে বাংলাদেশ এর মোকাবেলায় যথার্থ প্রস্তুতি নিয়েছে বলে সাধারণ মানুষ মনে করে না।
জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে করোনাভাইরাস যখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশ সরকার তখন মুজিববর্ষ উদযাপন আয়োজনে ব্যস্ত ছিল। এ সময়ে আইইডিসিআর কয়েকটি সংবাদ সম্মেলন করে করোনাভাইরাসে কি কি করণীয় এবং কি কি করা উচিৎ নয় সে সম্পর্কে নাগরিকদের জানিয়ে আসছিল। সরকার তখন করোনা মোকাবেলার জন্য যথার্থ পদক্ষেপ নিয়েছে–এমন বলা যাচ্ছে না। ৮ মার্চ প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ার পর যেন সরকারের টনক নড়েছে। সেদিন সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখা হাসিনা মুজিববর্ষের মূল অনুষ্ঠান স্থগিত করেছেন; করোনায় নাগরিকদের এবং সরকারের কি কি করণীয় সে সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এটা সরকার প্রধানের অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত। তবে তার বাস্তবায়ন ঠিকমত দেখা গেল না। কয়েক লক্ষ মানুষকে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়া হল। বিমানবন্দরে ভাইরাস স্ক্রিনিং এর নামে কিছু কিছু জ্বর পরীক্ষা হল। বিদেশ ফেরতদের হজ্বক্যাম্পে সঙ্গনিরোধ করে রাখার কথা বলা হল।
বাস্তবে দেখা গেল, ইউরোপ থেকে আসা একটি ফ্লাইটের সকলকে সেখানে নেয়া হলে তারা পানি, খাবার ইত্যাদি অপ্রতুলতার অজুহাতে সেখানে থাকলেন না, পুলিশের সঙ্গে ঝামেলা করে বেড়িয়ে গেলেন। এরপর আর কাউকে সেখানে নেয়া গেল না। এরপর বিদেশ ফেরত সবাইকে নিজ ঘরে সঙ্গরোধ করে থাকতে বলা হল। তারা ওসবের তোয়াক্কা না করে দেশময় ঘুরে বেড়ালেন। সুব্যবস্থাপনার অভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন কার্যক্রম মুখথুবড়ে পড়ল।
স্বাধীনতা দিবসের ছুটির সঙ্গে নয় দিন সাধারণ ছুটি যোগ করে সকল চিকিৎসা, খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এবং সীমিত পরিসরে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু রেখে অন্য সকল অফিস-আদালত, কারখানা, দোকান, লঞ্চ, রেল বন্ধ করে দেয়া হল। তখন বন্ধ করা হয়নি হাইওয়ে, বাস, ফেরি। ঈদের ছুটির আমেজ নিয়ে প্রায় এক কোটি মানুষ ঢাকা ছাড়ল। দেশময় ছড়িয়ে পড়ল করোনা ভাইরাস। কারখানার ব্যাপারটা কি হবে তা স্পষ্ট করে বলা হল না সরকারী প্রজ্ঞাপনে। এর সুযোগে শারীরিক দূরত্বের নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পরা তৈরি পোশাক শ্রমিকদের চাকরি খাওয়ার হুমকি দিয়ে ৫ এপ্রিল কাজে যোগ দিতে বললেন কারখানা মালিকরা। গণপরিবহন বন্ধ থাকা দেশে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক অবর্ননীয় দুর্ভোগ সহ্য করে, শত মাইল পায়ে হেঁটে, চাকরী বাঁচাতে ঢাকা চলে আসে। ঢাকায় পৌঁছাতে না পৌঁছাতে খবর হয়ে যায় যে কারখানা খুলবে না। এতগুলো মানুষের সঙ্গে মালিক পক্ষ থেকে কোন রকম দেখা না করে, বিগত মাসের বেতন না দিয়ে, এমন কি যাতায়ত খরচ না দিয়ে তাদের কারখানা ফটক থেকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই চরম অমানবিক ঘটনা এই দেশে ঘটেছে কারখানা মালিকদের মাত্রাতিরিক্ত লোভ আর প্রশাসনের ভেতরে সমন্বয়ের অভাবে সৃষ্ট দিকনির্দেশনাহীনতায়।
দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা সামনে আসল। বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালকে করোনা রোগ শনাক্ত করার পরীক্ষা এবং চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হল। করোনা মোকাবেলা বিষয়ে দেশের দুই তৃতীয়াংশ চিকিৎসা সক্ষমতার অধিকারী বেসরকারী হাসপাতালগুলোর সঙ্গে কোন রকম সমন্বয় করা হল না; তাদের করণীয় সম্পর্কে কিছু বলা হল না সরকারের পক্ষ থেকে। নাগরিকদের জানিয়ে দেয়া হল কতগুলো সরকারী ফোন নম্বর। বলা হল, করোনা সন্দেহ হলে এখানে ফোন করে করণীয় সম্পর্কে জানতে হবে।
পরীক্ষা বা হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হবে কি-না তা টেলিফোনে জানানো হবে। বাস্তবে দেখা গেল আধুনিক কলসেন্টার প্রযুক্তি সেখানে নেই; নেই পর্যাপ্ত টেলিফোন লাইন। প্রয়োজনে এবং অপ্রয়োজনে আতংকিত হাজার হাজার মানুষ ওসব নম্বরে ফোন করে লাইন পাচ্ছে না; কেউ লাইন পেলেও যথার্থ পরামর্শ পাওয়া যাচ্ছে না। রোগী নিয়ে সাধারণ মানুষ উদ্রান্ত হয়ে পড়ল। করোনা টেস্ট করার যন্ত্রপাতি এবং কিটের অভাবে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম করোনা টেস্ট করা হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে প্রচুর ভেন্টিলেটর লাগবে। দেশে ভেন্টিলেটর বানানো হবে এমন কথা একবার শোনা গিয়েছিল। তারপর সে বিষয়ে গণমাধ্যমে আর কোন আপডেট নেই। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারী হাসপাতালগুলো সময়মত প্রস্তুত করা যায়নি। ডাক্তার এবং অন্যান্য চিকিৎসা কর্মীদের নিরাপত্তা সামগ্রী পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়েছে। যারা সরকারী হাসপাতালে করোনার চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছেন তারাও সময়মত ডাক্তারের সেবা, ঔষধ এবং খাবার পায়নি।
মরার উপর খরার ঘাঁয়ের মত উদ্ভব হল জ্বর-কাশির রোগীদের সরকারী এবং বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়া। ডাক্তার এবং অন্যান্য স্বাস্থকর্মীদের করোনা প্রতিরক্ষা সামগ্রী না থাকার অভিযোগ তুলল হাসপাতালগুলো। প্রশাসন সারাদেশের সকল মেডিকেল কলেজ, জেলা এবং উপজেলা হাসপাতালগুলোকে করোনা চিকিৎসা কেন্দ্র ঘোষণা করে দিলেও সেখানে যাথার্থ মাস্ক এবং অন্যান্য পিপিই সামগ্রী পৌঁছাতে দেরী করল অনেক। এ সময়ে সরকারী হাসপাতালের ডাক্তারগণ বিভিন্ন অজুহাতে অনুপস্থিত থাকতে শুরু করলেন। দীর্ঘকাল ধরে স্বাস্থ্য সেবাকে ব্যবসায়ের পণ্য বানানোর ফসল বেসরকারী হাসপাতালগুলো নিজেদের ডাক্তার এবং অন্যান্য স্বাস্থকর্মীদের জন্য প্রতিরক্ষা অনুষঙ্গ সরবরাহ করল না। সমন্বয়হীনতার ফলাফল দাঁড়ালো এই যে অসুস্থ রোগী নিয়ে স্বজনেরা হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরতে লাগল। কেউ তাদের দিকে ফিরেও তাকাল না। চিকিৎসা না পেয়ে মরল অনেক মানুষ। গণমাধ্যমে এসব খবর দেখে আঁতকে উঠল জনসাধারণ। চরম দুর্দিনে বেসরকারী হাসপাতাল মানুষের পাশে দাঁড়ালো না। এই দুঃসময়ে জনগণের শিক্ষা হল–বেসরকারী হাসপাতালগুলো রোগীদের শুধুই টাকার উৎস মনে করে। ভবিষ্যতে বেসরকারী হাসপাতালের ভূমিকা কি হবে তা নিয়ে গভীর ভাবে ভাবার সময় হয়েছে।
সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যক্তি পর্যায়ে-গণমাধ্যমে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও মানুষকে ঘরে থাকার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ ও সেবাহিনীর সদস্যরা হ্যান্ড মাইক দিয়ে মানুষকে ঘরে থাকতে বলছেন। মসজিদে, মন্দিরে, গীর্জায়, প্যাগোডায় একত্রিত হতে নিষেধ করা হচ্ছে। তবুও এড়ানো যাচ্ছে না জনসমাগম। কাঁচাবাজারে, ওএমএস এর চালের লাইনে, সরকারী রিলিফে এমনকি পোশাক তৈরির কারখানায় বেতনের দাবিতে শত শত মানুষের ভিড়। লক্ষ মানুষ একত্রিত হয়ে জানাজার নামাজ আদায় করেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।
কোনভাবেই শারীরিক দূরত্ব রাখার নীতি মেনে চলা যাচ্ছে না। ওএমএস এর চালের লাইনে, সরকারী রিলিফ দেয়ার সময় পুলিশ বা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে না। কাঁচা বাজারগুলো চালু রাখতে হবে। সেগুলোকে কাছের কোন মাঠে বা রাস্তায় বসার ব্যবস্থা করা গেলে এক জায়গায় অনেক মানুষের ভিড় এড়িয়ে যাওয়া যায়। এসব কাজে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে পুলিশ এবং সেনাবাহিনী সদস্যদের সমন্বয় হচ্ছে না। একজন সেনাকর্মকর্তার কাছ থেকে জানা গেল, তারা মাঠে আছেন প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য, প্রশাসন সহায়তা না চাইলে তাদের কিছুই করার নেই। প্রশাসনের দুর্বল নেতৃত্বের কারণে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে না। শারীরিক দূরত্বের নীতি মেনে চলা যাচ্ছে না।
করোনাভাইরাস শুধু স্বাস্থ্যের জন্যই নয় অর্থনীতির জন্যেও বিরাট হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। করোনা মোকাবেলায় কার্যত স্থবির হয়ে আছে দেশ; অর্থনীতি। দোকানপাঠ, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, কারখানার প্রায় সবই বন্ধ। কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে ৫ থেকে ৬ কোটি মানুষের। এর সঙ্গে আছে দুঃস্থ মানুষেরা। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে খাদ্য ও নগদ অর্থ সরবরাহ করার ঘোষণা দিয়েছেন সরকার প্রধান। নগদ অর্থ এখন পর্যন্ত কর্মহীন মানুষদের কাছে পৌঁছানো যায়নি। শুধু খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করে করোনা সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলা করা যাবে না। দুর্ভিক্ষাবস্থা এড়াতে হলে, বর্তমান এবং করোনা পরবর্তী সময়ের অর্থনীতি চালু রাখতে হলে, দ্রুত স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ফিরে আসতে হলে কর্মহীন প্রায় ১.৫ কোটি পরিবারের কাছে সাপ্তাহিক বা মাসিক ভিত্তিতে ব্যাংকিং বা মোবাইল চ্যানেলে নগদ টাকা পৌঁছে দিতে হবে।
প্রধানতঃ দুইভাবে খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছেঃ ওএমএস এর মাধ্যমে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রয় এবং জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধায়নে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিনামূল্যে চাল এবং অন্যান্য খাদ্য সামগ্রী বিতরণ। এই দুই ক্ষেত্রেই খাদ্য দ্রব্য বিতরণের সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শারীরিক দূরত্বের নীতি মেনে চলা হচ্ছে না; সরকার প্রধানের ঘোষণা থেকে মাঠ পর্যায়ে বিতরণের মধ্যে সময়ের ব্যবধান বিরাট; অনেক গ্রামে এখনও খাদ্য সাহায্য পৌঁছায়নি; ব্যাপক চাল চুরির সংবাদ গণমাধ্যমে; সরকারী গুদাম থেকে সরবরাহকৃত চালের বস্তায় নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাল কম পাওয়া যাচ্ছে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্থানীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য বিভাগ, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে যথার্থ সমন্বয় করে কাজ করলে উপরে উল্লেখ করা অব্যবস্থাপনা সমূহের অনেক কিছুই ঘটত না।
প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা শুধু স্থানীয় পর্যায়েই নয় জাতীয় পর্যায়েও পরিলক্ষিত হচ্ছে। করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটা জাতীয় কমিটি করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমে জানা গিয়েছিল কিন্তু তার কার্যক্রমের পরিধি কি বা কিভাবে সে কমিটি কাজ করছে তা কেউ জানে না। জাতীয় কমিটি আদৌ কাজ করছে কি-না সে বিষয়ে জনমানসে সন্দেহ রয়েছে। কিছুদিন আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, কিভাবে কি হচ্ছে তা তিনি জানেন না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রতিদিন জনসম্মুখে যেসব বিষয়ে কথা বলছেন তা বলার জন্য স্বাস্থ্য কর্মকর্তারাই যথেষ্ঠ। তাঁর মধ্যে দেশবাসী বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেখতে পাচ্ছ না। করোনা যুদ্ধে প্রধান সেনাপতির ভূমিকা পালনে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন বলেই সচেতন মানুষেরা মনে করেন। একজন বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অধিকারী এবং স্বাস্থ্য সঙ্কট মোকাবেলা করার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষকে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর স্থলাভিষিক্ত করা দরকার। এই মহাদুর্যোগকালে তিনিই হবেন প্রধান সেনাপতি। কমান্ডার-ইন-চিফ এর দ্বায়িত্ব সর্বজন সমর্থনে পালন করছেন প্রধানমন্ত্রী।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকারী এবং বেসরকারী পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে একটা করোনা অপারেশন টিম দরকার। যারা সার্বক্ষণিক ভিত্তিতে সিচ্যুয়েশন রুমে উপস্থিত থাকবেন; স্বাস্থ্য এবং অর্থনীতি (বাজারদর, আমদানি, রফতানি, উৎপাদন, সরবরাহ, বিতরণ, ফরেক্স, ইত্যাদি) পর্যবেক্ষণ করবেন; নির্দিষ্ট সময় পর পর প্রধানমন্ত্রীকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করবেন এবং তাঁর সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ণের জন্য প্রশাসনের উপযুক্ত কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেবেন এবং কিছু সময় পর পর তা কতটুকু বাস্তবায়িত হলো সে সম্পর্কে হাল নাগাদ তথ্য নিয়ে তা প্রধানমন্ত্রী এবং একই সঙ্গে জনসাধারণকে অবহিত করবেন। করোনাকালে প্রধানমন্ত্রীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করার জন্য ঝানু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং উপদেষ্টাদের সমন্বয়ে একটা এডভাইসরি গ্রুপ থাকলে সুবিধা হবে।
শেক্সপিয়ার চারশ বছর আগে লিখে গেছেন, “Adversity brings out the best in man”। শুধু তখনই নয় তার আগে এবং পরেও দেখা গেছে চরম দুর্যোগের সময় মানুষ বড় বড় সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে বুদ্ধিমত্তার জোড়ে। পৃথিবীর বহু যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়েছে যুদ্ধকালে। যুদ্ধ জয়ের জন্য চাই প্রশিক্ষিত ও সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী, পর্যাপ্ত রসদ, কার্যকর কৌশল, সর্বপরি একাগ্রচিত্তের জনকল্যাণকামী নেতৃত্ব। আমাদের ডাক্তারেরা এবার আমাদের সেনাবাহিনী, তারা সংখ্যায় এবং প্রশিক্ষণে যথেষ্ট, দেশবিদেশে প্রশংসিত। তাদের শৃঙ্খলার কিছু অভাব রয়েছে যার অনেকখানি ইতোমধ্যে কেটে গেছে। রসদের (কিট, পিপিই, ভ্যন্টিলেটর) ঘাটতিও বহুলাংশে কেটেছে, বাকিটাও কেটে যাবে। ভ্যান্টিলেটর পর্যাপ্ত পাওয়া যাবে এমন লক্ষণ দেখছিনা। পর্যাপ্ত ভ্যান্টিলেটর পাওয়া না গেলে কিভাবে সে সমস্যা সমাধান করা যাবে তার উপায় উদ্ভাবন করতে হবে। উপযুক্ত কৌশলের দুর্বলতা কেটে যাবে একজন উপযুক্ত প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হলে। একাগ্রচিত্তের জনকল্যাণকামী নেতৃত্বের অভাব আমাদের নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কয়েকটি জাতীয় দুর্যোগে দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে বিজয়ের মুকুট অধিকার করেছেন।
বাংলাদেশ তথা সমগ্র পৃথিবী একটা মহাসংকটকাল অতিক্রম করছে। এই সময়ে সকলের দায়িত্ব হচ্ছে সরকারের নির্দেশ মেনে চলা, সরকারকে সাহায্য করা। জনগণের মধ্যে এই মানসিকতা রয়েছে। একাত্তরের তারা যেমন যুথবদ্ধ হয়ে অনেক প্রতিকুল পরিস্থিতিতে, অনেক কষ্ট সহ্য করে, অনেক সাহসে ভর করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে ঠেকিয়ে দিয়েছে এবারো তারা একই রকম মানসিকতা নিয়ে প্রস্তুত আছে। সঠিক দিকনির্দেশনাও প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সময়মতই আসছে। দরকার শুধু সময়মত বাস্তবায়ন।
লেখকঃ চার্টার্ড একাউন্টেন্ট (এফসিএ) এবং লিড কনসালট্যান্ট ও চেয়ারম্যান, ঢাকা কনসাল্টিং লিমিটেড।