ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

সামাজিক দূরত্ব নয়, প্রয়োজন শারীরিক দূরত্ব

ডা. হাসনাইন নান্না

প্রকাশিত : ০১:০০ পিএম, ২০ এপ্রিল ২০২০ সোমবার | আপডেট: ০৩:৪৩ পিএম, ২০ এপ্রিল ২০২০ সোমবার

পৃথিবীর দেশে দেশে চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা করোনা মোকাবিলায় গুরুত্ব দিচ্ছেন একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে। একে সাধারণভাবে বলা হচ্ছে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং। বাংলায় সামাজিক দূরত্ব। কিন্তু সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং বা সামাজিক দূরত্ব অনেক নির্দয় ও নিষ্ঠুর। এমনকি অসামাজিক প্রস্তাবও বটে। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, প্রবক্তারা মানুষের সাথে মানুষের সামাজিক ও মানসিক দূরত্ব বাড়ানোর কথা মোটেই বোঝাচ্ছেন না। তারা কেবল পরিবারের ভেতরে, পাড়া-মহল্লা কিংবা জাতীয় জীবনে ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির শারীরিক দূরত্ব বজায়ের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। তারা মেপে মেপে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখা, করমর্দন ও কোলাকুলি পরিহার করা ইত্যাদির উপর জোর দিচ্ছেন। কিন্তু ‘সামাজিক দূরত্ব’ কথাটার বিপরীত প্রভাব পড়ছে যেন জনজীবনে।

‘সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং’ বা ‘সামাজিক দূরত্ব’ পরিভাষাটিকে আমরা হয়তোবা ভুল প্রয়োগ করে ফেলছি। এর পরিবর্তে ‘ফিজিক্যাল ডিসট্যান্সিং’ বা ‘শারীরিক দূরত’¡ কথাটাই অনেক বেশি উপযুক্ত। করোনা রোগের হাত থেকে বাঁচতে সবাইকে যার যার ঘরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ঠিকই কিন্তু বন্ধুবান্ধব বা পরিবার বা প্রতিবেশীর সাথে সামজিক ও মানবিক যোগাযোগ ছিন্ন করতে বলা হয়নি। বরং এই দুঃসময়ে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তা বেশি বেড়েছে। বিশেষ করে, যাদের করোনা টেস্টে পজিটিভ রিপোর্ট এসেছে, তাদের পাশে মমতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন আছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যদি তাদেরকে সঠিকভাবে যত্ন করা যায়, সেবা দেয়া যায় তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা সুস্থ হয়ে উঠবেন।

একজন মানুষ থেকে আরেকজন মানুষের যে দূরত্ব, যেটাকে ‘সামাজিক দূরত্ব’ বলা হচ্ছে; এই শব্দটি ‘শারীরিক দূরত্ব’ হওয়াটাই জরুরি। দুর্যোগকালীন এই সময়ে ব্যবহার করা উচিত ‘শারীরিক দূরত্ব’ বা ‘দৈহিক দূরত্ব’। অবশ্যই ‘সামাজিক দূরত্ব’ নয়। বরং এখন প্রয়োজন ‘সামাজিক নৈকট্য’। প্রয়োজনীয় শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সামাজিক মমত্ব যত বাড়ানো যাবে, করোনা মোকাবিলায় ততই আমরা সফল হতে পারবো।

একজন মানুষ যখন একা থাকে, যখন সে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করে, যখন সে মনে করে যে তার প্রতি কারও কোনো মমত্ব নেই, তখন বেঁচে থাকার প্রয়োজনটাও অনেক সময় তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে না। আমরা চলাফেরার ক্ষেত্রে, বাইরে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখব। কিন্তু আমাদের অন্তরের যে টান সামাজিক মমত্বের মধ্য দিয়ে এবং দুর্গত যে-ই হোক না কেন, যিনি-ই অসুস্থ হোক, তার প্রতি মমত্বের প্রকাশ আমরা যত ঘটাব, যত দেখাতে পারব, তত তার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা, সুস্থ হওয়ার সুযোগ বাড়বে। মানুষের ভরসা পেলে তার ভেতরের ইমিউন সিস্টেমটাও তখন বাড়তে থাকবে। মানুষের মমতা, চিকিৎসকের মমতা, আত্মীয়ের মমতা, আপনজনের মমতা যে-কোনো রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

সামাজিক মমত্বে করোনা জয়

আমরা যদি দেখি, বিশ্বের যেখানেই মানুষের প্রতি মমতা আছে, সেখানেই তারা খুব সুন্দরভাবে করোনা মোকাবিলা করতে পারছেন। এতো দুঃখ এতো বেদনার পাশেও আশার বাণী হচ্ছে- পৃথিবীতে এখনও ভালো মানুষ আছেন। পৃথিবীতে এখনো সবাই শোষক নয়। সবাই অত্যাচারী নিপীড়ক নয়, সবাই ভোগী নয়, সবাই স্বার্থপর নয়। ত্যাগী মানুষও রয়েছেন এবং যেখানেই এই ত্যাগ আছে, যেখানেই মানুষের প্রতি মমতা আছে, সেখানে তারা খুব সুন্দরভাবে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারছেন এবং মোকাবিলা করে যাচ্ছেন।

ভিয়েতনামের কথাই ধরি। সেখানে করোনা সংক্রমণ তারা খুব চমৎকারভাবে সীমিত করেছেন। কেরালার কথা ধরি, যেখানে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের ভয় ছিল কিন্তু তাদের সামাজিক মমত্ব এতোটাই যে কেরালা সরকার বলেছিল যে বিদেশ থেকে যত মানুষ আসুক, সবাইকেই তারা গ্রহণ করবে। এবং সামাজিক মমত্ব সেখানে করোনার প্রকোপকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সহায়ক হয়েছে।

কিউবা: বৈশ্বিক মমত্বের উদাহরণ

মানুষের প্রতি মানুষের জাতিগত মমত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে ক্যাস্ট্রোর কিউবা। ব্রিটিশ ক্রুজ শিপ এমএস ব্রেইমার। ওই জাহাজে ৫০ জন প্যাসেঞ্জার করোনা-আক্রান্ত হয়ে গেল। পুরো ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে কোনো দ্বীপ তাদেরকে বন্দরে ভিড়তে দেয়নি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত তাদের বন্দরে ভিড়তে দেয়নি। যুক্তরাজ্যের বিদেশ মন্ত্রক পাঁচদিন ধরে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে যত দেশ ছিল, প্রত্যেক দেশকে অনুরোধ জানায়। কিন্তু কেউ তাদেরকে ভিড়তে দেয়নি। সেই দুঃসময়ে তাদের প্রতি মমতা দেখাল কিউবা। জাহাজটিকে নিজেদের দ্বীপে ভিড়তে দেয় তারা। এক হাজার প্যাসেঞ্জার এবং ক্রুকে নামিয়ে নিয়ে আসে তারা এবং সেখান থেকে জাহাজের যাত্রীরা চার্টার্ড বিমানে করে যুক্তরাজ্যে ফিরে যান।

শব্দের ভুল নাকি হৃদয়ের ভুল?

‘সামাজিক দূরত্ব’ শব্দটার ভুল প্রয়োগেই কি দেশে এসব অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল? নাকি হৃদয়ের মধ্যে এই ভুল নিয়েই আমরা বাস করি? স্বামী ইটালি থেকে আসার খবর শুনে স্ত্রী বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। বিদেশফেরত একজন মানুষকে সহজভাবে নিতে পারছে না এলাকার মানুষ। অথচ বিদেশ থেকে যে এসেছে সে আমাদেরই ভাই আমাদেরই বোন আমাদেরই সন্তান। সে হয়তো দেশে ফিরে এসেছে। এই দেশ যেমন আমাদের, সেরকম সেই সন্তানেরও। তারা বিদেশে যাওয়াতে তাদের উপার্জিত অর্থ আমাদের দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সাহায্য করেছে। অতএব এই দুর্যোগকালে তাকে সামাজিক মমত্ব নিয়েই গ্রহণ করা উচিত। আপনজনকে ছেড়ে অন্যরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বৃদ্ধা মাকে জঙ্গলে ফেলে চলে যাচ্ছে সন্তান। স্বজনেরা কাছে আসতে চাইছে না। অনেক হাসপাতাল রোগী ভর্তি করতে চাইছে না। টেস্টে পজিটিভ ধরা পড়লে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করছেন বাড়িওয়ালা, এমনকি ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীদেরও বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। (অবশ্য এ অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সময় মত পুলিশ, প্রশাসন, দুদক এমনকি সিটি করপোরেশনও সোচ্চার হয়েছে)।

‘মানবিক’ মানুষ হতে হবে সবাইকে

এক করোনা অনেক অমানবিক ঘটনার জন্ম দিয়ে ফেলেছে ইতোমধ্যেই। আরও ঘটনা ঘটুক আমরা চাই না। কিছু না পারি দূরত্ব বজায় রেখে আমরা একজন করোনা পজিটিভ ব্যক্তিকে মানসিক শুশ্রুষা বা মেন্টাল সাপোর্ট তো দিতে পারি। আর এখন যে মৌসুম তাতে অনেকেরই সর্দি কাশি জ্বর হতে পারে। সিজনাল ফ্লু হতে পারে। এটা হলেই তাকে ‘করোনা পজিটিভ’ মনে করে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়া যৌক্তিক নয়, মানবিক নয়। বরং তাকে ঘরে রেখেই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। কারণ পরিসংখ্যান বলে, শতকরা ৮০ জন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির হাসপাতালেই যাওয়ার প্রয়োজন হয় না (নিউইয়র্ক টাইমস ১৮ মার্চ ২০২০)।

করোনা পজিটিভ হলে তাকে অচ্ছুৎ না ভেবে যথাযথ চিকিৎসার আওতায় আনার উদ্যোগ নিতে হবে। এবং এটা নিতে হবে পরিবারের মানুষকেই। আপনজনদেরকেই। প্রতিবেশি, বন্ধু, স্বজনদেরকেই। তাহলেই প্রমান হবে সে শুধু ‘শব্দগত’ মানুষ নয়, ‘মানবিক’ মানুষ। এখন যে ক্রান্তিকাল আমরা পার করছি তাতে স্বার্থপর অমানুষের কোন প্রয়োজন নেই। দরকার মানবিক মানুষের। মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন মানবিক মানুষের সংখ্যা বেশি ছিল বলেই আমরা জয়ী হয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সাথে যদি তুলনা করি তাহলে করোনা ভাইরাস হল পাকিস্তানী হানাদার এবং চিকিৎসক নার্স স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ ও প্রশাসনের যারা দায়িত্ব পালন করছেন, সাংবাদিক, ওষুধ শিল্প ও অন্যান্য জরুরি সেবার সাথে জড়িত ব্যক্তি যারা নিয়মিত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তারা হলেন মুক্তিযোদ্ধা। আর রাজাকার কারা? ত্রাণচোর, বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাওয়া বাড়িওয়ালা, দাফন করতে অস্বীকৃতি জানানো মাওলানা, খাটিয়া দিতে অস্বীকৃতি জানানো প্রতিবেশি, জরুরি সেবায় নিয়োজিতদের কাজে বা চলাচলে বাধা প্রদানকারী ব্যক্তি, চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানানো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, প্রাথমিক সাহায্য দিতে এগিয়ে না আসা স্বজন। এরা সবাই হল রাজাকার।

শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার মানসিক ও শারীরিক উভয় পরিচ্ছন্নতাই জরুরি। তবে অকারণে অ্যালকোহলযুক্ত স্যানিটাইজার ব্যবহার করাটা জরুরি নয়। বরং এসময়ে দেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত ‘সোপিওয়াটার’ ব্যবহারে সামাজিকভাবে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করা যায়। অযথা হ্যান্ড স্যানিটাইজারের পেছনে না দৌঁড়ে পানির সাথে কাপড় ধোয়ার ডিটারজেন্টের মিশ্রণে তৈরি সোপিওয়াটার ব্যবহার নিজে করা এবং এক টাকায় ৮০ বার হাত ধোয়ার এ পদ্ধতি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া যায়। অর্থাৎ সমাজের মানুষের অপচয় কমাতেও ভূমিকা রাখা যায়।

ঘরে ঘরে মোবাইল ফোন এখন সবার হাতে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমেও সামাজিক বন্ধন, পাড়া-মহল্লার নানাবিধ যোগাযোগ, কর্মপরিকল্পনা, পারিবারিক দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করার মধ্যদিয়ে মানুষে মানুষে আত্মিক বন্ধন দৃঢ় করা যেতে পারে। করোনাপূর্ব সময়ে কোথাও আগুন লাগলে বা অন্য কোনো দুর্যোগে মানুষ যেমন স্বেচ্ছায় দৌঁড়ে যেত তেমনি এসময়েও নিজস্ব পাড়া-মহল্লায় মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়ানো যেতে পারে। অযথা মহল্লার রাস্তা আটকে না রেখে (কারণ রাস্তায় যদি জায়গায় জায়গায় বেরিকেড দেয়া থাকে তাহলে ডাক্তার, নার্সসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর্মী, সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারী যারা বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের কারণে বাসার বাইরে যান, স্বেচ্ছাসেবক, ওষুধ শিল্পের সাথে জড়িত ব্যক্তি প্রমুখের যাতায়াতে বিঘ্ন ঘটবে) বরং সকলের ঘরে খাবার, ওষুধ পৌঁছে দেয়ার জন্য ও সকলের খোঁজ নেয়ার জন্য স্বেচ্ছাসেবক হওয়া যেতে পারে। যা এই দুর্যোগকালে সামাজিক দূরত্ব নয় বরং সামাজিক দায়িত্ব হিসেবেই বিবেচিত হবে।

এই সময়ে করোনা-আক্রান্ত রোগীর সেবা করলেই কেউ করোনায় আক্রান্ত হবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। প্রয়োজন শুধু সতর্কতা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রয়োজন সামাজিক মমত্ব। মমত্বটাকে যত প্রবল করা যাবে তত আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হবে। এ মমত্ব শুধু করোনা আক্রান্ত রোগীকে নয়, ব্যক্তির নিজেকেও মানসিক দিক দিয়ে সুস্থ রাখতে পারে, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে শরীরেও। তাই করোনা কালে শারীরিক দূরত্ব বজায় যেমন থাকবে; তেমনি সামাজিক নৈকট্যেরও খুবই প্রয়োজন। মমতাময় হৃদয়ে সমাজকে, দেশকে, দেশের মানুষকে উপলব্ধি করার মধ্যদিয়ে বর্তমানের দুর্যোগ মোকাবিলায় সামাজিক মমত্ব, সামাজিক নৈকট্য, সামজিক বন্ধনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

লেখক: হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও সহযোগী অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ, খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

এমবি//