ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

আহা! আজ যদি টিসিবির সেই কার্যকর ব্যবস্থাপনা থাকত!

রাজু আহমেদ

প্রকাশিত : ০২:৫৫ পিএম, ২০ এপ্রিল ২০২০ সোমবার | আপডেট: ০২:৫৬ পিএম, ২০ এপ্রিল ২০২০ সোমবার

রাজু আহমেদ

রাজু আহমেদ

যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য এবং শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ ও সরবরাহ সংকট মোকাবেলায় ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ৬৮ নম্বর অধ্যাদেশের মাধ্যমে টিসিবি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জনগণের কাছে ন্যায্যমূল্যে ভোগ্যপণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা। এছাড়া দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সচল করাও ছিল এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম দায়িত্ব। 

সে সময় টিসিবির উদ্দেশ্য ও কার্যাবলী ছিল ১. ন্যায্যমূল্যে ভোগ্যপণ্য সরবরাহ। ২. আমাদানি-রপ্তানির মাধ্যমে পণ্যের সুষম সমন্বয়। ৩. দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য সরকারের নীতি অনুযায়ী পণ্য আমদানি করে দেশের বাজারে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি। ৪. দেশের প্রচলিত ও অপ্রচলিত পণ্যের বিশ্ববাজার সৃষ্টি করে জাতীয় আয় বাড়ানো। ৫. বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা।

ওই সময় সাধারণ জনগণের কাছে সহনীয় মূল্যে ভোগ্যপণ্য সরবরাহের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা হয়। সারা দেশে নির্বাচিত ডিলারদের কাছে এসব পণ্য সরবরাহের দায়িত্ব পালন করে টিসিবি। ওই ব্যবস্থায় পণ্য আমদানি ও পাইকারি পর্যায় পর্যন্তই টিসিবির দায়িত্ব সীমিত ছিল। সাধারণ ব্যবসায়ী বা ব্যক্তি ডিলারশিপ নিয়ে রেশন সরবরাহ করতো। পাশাপাশি ভোক্তা সমবায় দোকানের (কস্কর) মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থাও চালু ছিল। এছাড়া ‘মূল্য ও বাজার নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর’ সক্রিয় থেকে পণ্য মূল্য মনিটরিং করেছে।

জাতীয়-আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ঘটনা প্রবাহ, বড় ব্যবসায়ীদের মজুদদারি প্রবণতা, ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অদক্ষতাসহ নানা কারণে বিভিন্ন সময়ে নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের সংকট তৈরি হয়েছিল।

ব্যক্তি পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের ডিলারের দায়িত্ব অর্পণ করায় রেশনিং ব্যবস্থায় দুর্নীতির সুযোগও তৈরি হয়েছিল। দূর্বলতা ও ত্রুটি সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর থেকে আশির দশক পর্যন্ত ভোগ্যপণ্য সরবরাহ ও বিপণনে সরকারী ব্যবস্থাপনা অব্যাহত ছিল। মূলত এ কারণেই সামগ্রিকভাবে ভোগ্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা সম্ভব হয়েছিল। আর এক্ষেত্রে মূল নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে টিসিবি।

যেভাবে অকার্যকর হলো টিসিবি

নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই সরকার ‘মুক্তবাজার’ নীতি গ্রহণ করে। জাতীয় বাস্তবতা ও জনগণের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় না নিয়েই ঢালাও উদারীকরণের পথে অগ্রসর হয় বাংলাদেশ। এরই অংশ হিসেবে ভোগ্যপণ্যের বাজারকেও ব্যক্তি-ব্যবসায়ীদের হাতে পুরোপুরি ছেড়ে দেয়া হয়। মুক্তবাজারের নামে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এডিবির মতো ঋণদাতাদের পরামর্শে নব্বইয়ের দশক থেকে বাজারে নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের যেসব প্রথা-প্রতিষ্ঠান সক্রিয়া ছিল সেগুলোকে বিলুপ্ত কিংবা নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। রাষ্ট্রীয় সংস্থা ‘মূল্য ও বাজার নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর’ বিলুপ্ত এবং টিসিবির কার্যক্রম একেবারে গুটিয়ে নেয়া হয়। বন্ধ হয়ে যায় আমদানি-রপ্তানি, পণ্য সরবরাহ ও বিপণনে টিসিবির কার্যক্রম। ধীরে ধীরে কমিয়ে দেয়া হয় জনবল। এভাবে প্রতিষ্ঠানটিকে সম্পূর্ণ পঙ্গু করে দেয়া হয়।

১৯৭২ সালে ৪৩১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে টিসিবির কার্যক্রম শুরু হয়। পরে ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করে জনবল ১৩৩৬ জনে উন্নীত করা হয়। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে স্বল্পমূল্যে ভোগ্য পণ্য পৌঁছানোর কাজে সরকারের মূল হাতিয়ারে পরিণত হয় টিসিবি। কিন্তু ১৯৯২ সালে এক আদেশের মাধ্যমে টিসিবিতে সব ধরনের নিয়োগ বন্ধ করে দেয়া হয়। তারপর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসর গ্রহণ, শূন্যপদে নিয়োগ বন্ধ থাকা, সরকারের সংকোচন নীতি ইত্যাদি কারণে ১৯৯৫ সালে টিসিবির জনবল কাঠামো পুনর্গঠন করে একজন চেয়ারম্যান ও তিনজন পরিচালকসহ ৭১৪-তে নামিয়ে আনা হয়। 

২০০২ সালে টিসিবির জনবল কাঠামো আরো কমিয়ে ২৫০ করা হয়। ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেক’-এর মাধ্যমে অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বিদায় করে ২৩৫ জনকে রাখা হয়। এরপর টিসিবিতে আর নতুন কোনো জনবল নিয়োগ দেয়া হয়নি। অবসরসহ নানা কারণে ২০০৮ সালের জুন মাসে টিসিবি’র জনবল মাত্র ১৭৯ জনে দাঁড়ায়।

গত ১০ বছরে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বার বার টিসিবিকে কার্যকর করার কথা বললেও প্রয়োজনীয় জনবলই নিয়োগ দেয়া হয়নি। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ৪৯টি পদ শূন্য রয়েছে। এরমধ্যে ৩৫টিই প্রথম শ্রেণীর। চাকরির বয়সসীমা শেষ হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে কর্মরত কেউ না কেউ প্রতিমাসেই অবসরে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় টিসিবি পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

লেখক: সাংবাদিক

এমবি//